তানভীর দিপু:
ট্রেনে
কাটা পড়ে প্রাণহানির ঘটনা কুমিল্লায় প্রায়ই ঘটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ
ডাবল লাইন হবার পর থেকে গতি বেড়েছে এপথে। তাই অরক্ষিত এলাকা এবং মানুষের
অসচেতনতায় প্রাণহানির ঘটনা আলোচনা সৃষ্টি করে কয় দিন পর পরই। গতকাল বুধবার
সকালেও কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার মাধবপুর এলাকায় রেললাইনের উপর থেকে তিন
যুবকের ক্ষত বিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, নিহতরা
ভবঘুরে, চাহিদা সম্পন্ন পরিবারের সন্তান- প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে,
মঙ্গলবার রাত সাড়ে তিনটায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী ডাউন লাইনে উদয়ন
এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে ট্রেনেকাটা পড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। অপর দিকে
বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুই পা
বিচ্ছিন্ন হয়ে ভোর ৬টায়ও তিন জনের মধ্যে এক যুবক জীবিত ছিলেন- পানি খেতে
চেয়েছেন। অর্থাৎ দুর্ঘটনার আড়াই ঘন্টা পরও জীবিত ছিলেন একজন। যদি আরো আগে
কেউ এসে তাদের উদ্ধার করতো তাহলে- হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন কেউ। কিন্তু
নিয়তি জীবনের এই গল্পটি রচনা করেছে ভিন্ন ভাবে।
এদিকে সাইফুলের মা আসমা
বেগম ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ভাগ্যটাই খারাপ- ছেলের বাবারও কোন কাজ
কর্মের কোন ঠিক নাই। ছেলেটাও ঠিক হলো না।’
কিন্তু ঘুম, নেশা নাকি ভাগ্য- কোনটি কেড়ে নিয়েছে এই তিন যুবকের প্রাণ? এ নিয়ে রয়েছে নানান আলোচনা।
প্রত্যক্ষদর্শী
ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া সাইফুল
ইসলাম কুমিল্লা রেলস্টেশনেই বাবা-মায়ের সাথে অস্থায়ী ছাপড়ায় থাকেন।
দেবিদ্বার উপজেলার মাটিয়া মসজিদ এলাকায় তাদের বাড়ি থাকলেও জমিজিরাত নেই। রং
মিস্ত্রীর কাজ করলেও পরে নানান বাজে অভ্যাসে ভবঘুরে হয়ে যান সাইফুল।
মাদকের নেশায়ও আক্রান্ত ছিলো বলে জানিয়েছে পরিচিত কয়েকজন। অপর এক যুবক
তুহিনের নাম জানা গেলেও জানা যায় নি ঠিকানা, আরেক জনের কিছুই পাওয়া যায় নি-
মৃতদেহ ছাড়া।
এই তিন যুবকের মৃত্যুর কারণ আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ভাষ্যমতে
দুর্ঘটনা হলেও- দুর্ঘটনার কারন নিয়ে রয়েছে নানান মত। কেউ বলছেন, ভবঘুরে হয়ে
ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে মাঝরাতে রেললাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়াই
হয়েছে ‘কাল’।
রেলওয়ে পুলিশের কুমিল্লা স্টেশন ফাঁড়ি ইনচার্জ সোহেল
মোল্লা জানান, সাইফুলের পরিচয় সূত্র ধরে বুঝা গেছে- তারা তিনজনই একই দলের।
তারা ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে হয়ে প্লাস্টিক টোকাইয়ের কাজ করে। আবার রেল লাইনের
পাশে পাশেও হাঁটা চলা আছে তাদের। এমনও হতে পারে তারা টোকাইয়ের কাজ শেষে
মাধবপুর এলাকায় বসে বিশ্রাম নেবার সময় ঘুমিয়ে পড়লে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু
হতে পারে। তবে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে- রিপোর্ট পেলেই জানা
যাবে কোন মাদক, বিষ কিংবা কি কারণে মৃত্যু হলো।
কুমিল্লা রেলওয়ের
উর্দ্ধতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী মজুমদার বলেন, রেললাইনের উপর যদি
কেউ ঘুমিয়ে থাকে এবং রাতের ট্রেনের যে গতি থাকে- তাতে হর্ণ বা শব্দ শুনেও
দুর্ঘটনায় সম্ভাবনা বেশি। যেখানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার দুই পাশেই উত্তরে
এবং দক্ষিণে ৫০০ মিটারের মধ্যে দুইটি বাঁক আছে। দুর্ঘটনা হয়েছে মাঝামাঝি
জায়গায়। স্বাভাবিক ভাবে রাতের ট্রেনে ৮০ কিলোমিটার গতি থাকে- বাঁক পার হয়ে
ট্রেন ১৬১ নম্বর পিলারের কাছে, বাঁক পার হয়ে সেখানে ট্রেন খুব অল্প সময়ের
মধ্যে ওই জায়গায় চলে আসতে পারে। তাই কেউ ঘুমিয়ে থাকালে দুর্ঘটনা প্রায়
নিশ্চিত ।
আবার কেউ বলছেন, মাধবপুর এলাকায় যে পরিত্যক্ত ডাকবাংলো
রয়েছে- সেখানে মাদকাসক্তদের আনাগোনা রয়েছে। আর সেই বাংলোর বরাবর সামনেই তিন
যুবকের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পড়েছিলো। স্থানীয়দের ধারণা, বাংলো এলাকায় মাদক
গ্রহন করে রেললাইনের উপর শুয়ে অচেতন হয়ে পড়ে তারা। ট্রেন আসার টের না
পাওয়ায় ঘটে দুর্ঘটনা।
সংবাদকর্মী আক্কাস আল মাহমুদ হৃদয় জানান, এই
ডাকবাংলো এলাকাটি সন্ধ্যার পর মাদকপ্রবণ হয়ে ওঠে বলে আমরা প্রায় খবর পাই।
নির্জন জনমানবহীন এই এলাকাটিতে এর আগেও ট্রেনে কাট পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
আমি ধারণা করছি, যেহেতু তারা টোকায়- তারা কোন একটি ট্রেন থেকে রসুল পুর
কিংবা রাজাপুর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে হেঁটে এসে এখানে বসে এবং মাদক সেবন
করে। তাতেই তারা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়লে ট্রেন আসার বিষয়টি টের পায় নি। যদি
নেশাগ্রস্থ না হত তাহলে- ঘুমন্ত হলেও তিন জনের কেউ একজন হলেও টের পেত।
তারপরও ময়নাতদন্তের রিপোর্টই নিশ্চিত করবে - ঘটনায় মাদক সংশ্লিষ্টতা আছে কি
না?
মরদেহগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় কুমিল্লা রেলস্টেশন পুলিশ
ফাঁড়িতে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সাইফুল ইসলামের পরিচয় শনাক্তের পর তার
বাবা মা-কে খবর দিলে তারা আসে। সেসময় তারা জানায়, তাদের কোন স্থায়ী ঠিকানা
নাই, তারা মরদেহ কই দাফন করবে জানা নাই।
পরে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে,
সাইফুলের মা আসমা বেগম ও বাবা মোখলেসুর রহমান তার সন্তানকে দাফনের খরচের
জন্য অর্থ সহযোগিতা তুলছেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। টাকা উঠলে বৃহষ্পতিবার
দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে সাইফুলের মরদেহ নিয়ে যাবে দেবিদ্বার উপজেলায়
গ্রামের বাড়িতে। সেখানে নিজেদের জায়গা জমি না থাকলেও এলাকার কবরস্থানে দাফন
করা যেতে পারে। মঙ্গলবার দুপুরেও ছেলেকে বলেছিলাম ওদের সাথে না যেতে-
কিন্তু গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসলো। আমাদের এমন অবস্থা যে ছেলের মরদেহ দাফনের
খরচের জন্যও টাকা তুলতে হচ্ছে।