২
এপ্রিল ২০২৫ বিশ্বের বাণিজ্য ব্যবস্থায় একটি বিরল ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকা তার
প্রায় সকল বাণিজ্য অংশীদারদের উপর বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাসের লক্ষ্যে পাল্টা
শুল্ক আরোপে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ৯ এপ্রিল,
২০২৫ থেকে কার্যকর হবে বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। বিশ্বায়নের বর্তমান সময়ে এ
উদ্যোগ বেশ বিতর্কের জম্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিনই বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার
উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনা, সেমিনার, লেখালেখি হচ্ছে। বাংলাদেশের
উপর ৩৭% পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল এবং এর ফলস্বরূপ আমাদের রপ্তানী
বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, হলে কি মাত্রায় হবে, এর প্রভাবকে কিভাবে
সহনীয় করে সামনের দিনগুলোতে বাণিজ্য আরো এগিয়ে নেয়া যায় তা নিয়ে সরকারি,
বেসরকারি ও গবেষণা সংস্থাগুলো আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি তরফ থেকে
এরই মধ্যে পত্র যোগাযোগ করা হয়েছে এবং নেগোসিয়েশন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে আমেরিকা এ বিধানের কার্যকারিতা ৩ মাসের জন্য স্থগিত করেছে। বর্ণিত
পাল্টা শুল্কের আরোপের প্রভাব বিশ্লেষণ করা এ নিবন্ধনের উদ্দেশ্য নয়। বরং
আমেরিকা বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নেত্বতৃ দিচ্ছে সেটার ভিত্তি আমেরিকা কিভাবে
অর্জন করলো সে বিষয়ে তথ্য উপাত্ত পাঠকদের কাছে এ নিবন্ধের মাধ্যমে তুলে
ধরার চেষ্টা করা হবে।
বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৈচিত্রমন্ডিত, বহু সংস্কৃতির
দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মধ্য ভাগে
অবস্থিত আমেরিকা প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যস্থলে পঞ্চাশটি
অংগরাজ্য নিয়ে গঠিত। এ দেশের স্বাধীনতার ঘোষনা হয় ০৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে।
উত্তরে কানাডা ও দক্ষিণে মেক্সিকো দ্বারা পরিবেষ্টিত বিশে^র তৃর্তীয়
বৃহত্তম দেশ আমেরিকার আয়তন ৯৮.৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ৩৪
কোটির কাছাকাছি। কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিশ্বের দীর্ঘতম
আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে যা ৮৮৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ। অন্যদিকে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ৩১৪১ কিঃমিঃ লম্বা সীমান্ত দিয়ে মেক্সিকোর সাথে সংযুক্ত।
১৯৩০
এর দশকে অর্থনৈতিক মহামন্দার শিকার হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম পরমানু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে।
প্রতিনিধিত্বমূলক গনতন্ত্র অনুসরণকারী আমেরিকা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম
প্রধান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিধর রাষ্ট্র। শীতল যুদ্ধের
শেষভাগে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের
একমাত্র মহাশক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের
দুই-পঞ্চমাংশ খরচ করে এই দেশ।
মিশ্র অর্থনীতির নীতি অনুসরনকারি আমেরিকা
নামমাত্র (নমিনাল) জিডিপি ও মোট সম্পদ অনুযায়ী বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি
এবং ক্রয় শক্তি সমতা (পিপিপি) বিবেচনায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের তথ্যমতে এ সময় মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৩৭,৬৮৩ মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে
আমেরিকার মোট দেশজ উৎপাদন ছিল ২৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার এর কাছাকাছি। যা
বৈশ্বিক অর্থনীতির ২৬% (এক চতুথাংশ)। আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে
প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী অর্থনীতি এবং দেশটির অর্থনীতি প্রচুর প্রাকৃতিক
সম্পদ, উন্নত অবকাঠামো এবং উচ্চ উৎপাদনশীলতা এর উপর ভিত্তি করে দিন দিন
প্রসারিত হচ্ছে। আমেরিকার বিশ্বের পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের
বৃহত্তম উৎপাদনকারী। ২০২৩ সালে আমেরিকার অর্থনীতি ছিল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল
এবং গবেষণার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ। এ সময়
গবেষণা ও উন্নয়ন বাবদ ৭৮৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে; যা বাংলাদেশের মোট
জিডিপি’র প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি। এতে দেশটির উন্নয়নের ভিতরের রহস্যটা
সহজেই আঁচ করা যায়।
আন্তর্জাতিক সংস্থার অনেকগুলোর সদর দফতর আমেরিকায়
অবস্থিত। যার মধ্যে কয়েকটি হল জাতিসংঘ, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক গ্রুপ, আইএফসি,
ইউনিসেফ, ইউএনডিপি ইত্যাদি। ২০২৫ সালে এপ্রিল মাসে বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক
সংখ্যক বিলিওনিয়ারের (৮১৩ জন) বাসস্থান ছিল আমেরিকায় এবং তাদের মোট
সম্পদের পরিমাণ ছিল৩.৭২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ
এবং ন্যাসড্যাক বাজার মূলধন ও বাণিজ্যের পরিমাণের অনুসারে বিশ্বের বৃহত্তম
স্টক এক্সচেঞ্জ। আমেরিকার বিদেশী বিনিয়োগের মোট পরিমাণ প্রায় ৪.০ ট্রিলিয়ন
ডলার, বিদেশী আমেরিকায় বিনিয়োগের মোট পরিমাণ ৫.৬ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
মার্কিন ডলার হল আন্তর্জাতিক লেনদেনগুলিতে সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রা এবং এটি
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিজার্ভ মুদ্রা। ব্যবসায়ে স্বাচ্ছন্দ্যতার সূচক,
বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা প্রতিবেদন এবং অন্যান্য গবেষণার হিসাবে বিশ্বের
শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিগুলির মধ্যে আমেরিকা অন্যতম।
২০২৪ সালে বিশ্ব
বাণিজ্যের বড় অংশীদার ছিল আমেরিকা। বিশ্বের ২০টি দেশের সাথে আমেরিকায়
ম্ক্তু বানিজ্য চুক্তি রয়েছে। এদেশ বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক এবং দ্বিতীয়
বৃহত্তম রফতানিকারক। ২০২৪ সালে আমেরিকার মোট পণ্য ও সেবা রপ্তানির পরিমাণ
ছিল ৩.১৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (জিডিপি’র ১৩.৮০%) এবং আমদানির পরিমাণ ছিল
৪.১১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (জিডিপি’র প্রায় ১৪%)। আমেরিকার বৃহত্তম
বাণিজ্য অংশীদার হল চীন, কানাডা, মেক্সিকো, জাপান, জার্মানি, দক্ষিণকোরিয়া,
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ভারত এবং তাইওয়ান। আমেরিকার ৩৬৯৫ টি কোম্পানীর বাজার
মূলধনের পরিমান ৫১.৮৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যার মধ্যে কয়েকটি কোম্পনী
হচ্ছে-এ্যাপেল, মাইক্রোসফট, এনডিডিয়া, এ্যামাজন, মেটা, টেসলা, ওয়ালমার্ট
ইত্যাদি। পুঞ্জিভূত সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০২৩ সালে ছিল ৫.৪
ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২০২৪ সালে প্রকাশিত মানের উন্নয়ন সূচকে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ২০তম। বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের
তালিকায় আমেরিকার নিজেরই রয়েছে ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯০১ সাল হতে শুরু করে
২০২৪ সাল পর্যন্ত বিশে^ মোট ১০১২জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নোবেল পুরস্কারে
ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী
দেশ। এটি আমেরিকা শিক্ষা-গবেষণা-সাহিত্যে উন্নততর অবস্থানের কারণেই সম্ভবপর
হয়েছে। এ দেশে ৪২০ জন নোবেল বিজয়ী আছেন (সংস্থাসহ)। উল্লেখ্য আমেরিকা
নোবেলে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে ২৩ বার যা একক দেশ হিসেবে বিশ্বে
সর্বোচ্চ। আমেরিকার চারজন রাষ্ট্রপতির নোবেল শান্তি পুরষ্কার পেয়েছেন: যার
মধ্যে রয়েছেন থিওডোর রুজভেল্ট, উড্রো উইলসন, জিমি কার্টার, এবং বারাক
ওবামা। বিশ্বের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রমেও এককভাবে আমেরিকা বড় ধরণের
ভূমিকা রেখে চলছে। জাতিসংঘের নিয়মিত মূল বাজেটের ২২% যোগান দেয় আমেরিকা এবং
জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনের বাজেট ২৬.৯৪% যোগান দেয়। এ দেশ জাতিসংঘের
শারণার্থী বিষয়ক সংস্থার সর্ববৃহৎ সরকারী দাতা, যার পরিমাণ ২০২৩ সালে ছিল
১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমেরিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্যতম বৃহৎ
অংশীদার এবং ২০২৪-২৫ সালে আমেরিকা এ সংস্থায় ৯৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
সমপরিমাণ অর্থায়ন করেছে।
শুধু শিক্ষা গবেষণা বা সাহিত্য নয়, বিশ্ব
অলিম্পিকের ইতিহাসেও আমেরিকা সবচেয়ে সাফল্য লাভকারী দেশ। গ্রীষ্মকালীন
অলিম্পিকে এ পর্যন্ত আমেরিকা ২৭৬৫টি মেডেল/পদক অর্জন করেছে। যার মধ্যে
স্বর্ণপদক অর্জন করেছে ১১০৫টি। অন্যদিকে শীতকালীন অলিম্পিকে আামেরিকা অর্জন
করেছে ৩৩০টি মেডেল তার মধ্যে স্বর্ণ পদক ছিলো ১১৪টি। ইমিগ্র্যান্টদের জন্য
আমেরিকা একটি স্বর্গরাজ্য। আমেরিকার অভিবাসন নীতি ও সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের
অতুলনীয়। যার ফলে আমেরিকার এর নেট অভিবাসন হার বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২০২৩ থেকে ২০২৪ সাল এর মাঝের সময়ে সারা পৃথিবী থেকে ২৮ লক্ষ নতুন অভিবাসন
প্রত্যাশী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিল।
উপরের সব তথ্যগুলো বিবেচনায়
নিলে খুব সহজেই বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমেরিকার গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
আমেরিকার অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা একত্রে তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা দেশ
হিসেবে গড়ে তুলেছে। মানবাধিকার, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা, উৎপাদনশীলতা,
উদ্ভাবন এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সর্বোচ্চ
স্থানে রয়েছে। আমেরিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক,
বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, কৌশলগত, গবেষণা বিষয়, অভিবাসন প্রদানে যে অবস্থান
তৈরী করেছে সেটি আমেরিকাকে বিশে^ অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত
হতে সহায়তা করেছে। তাই আমেরিকার যে কোন নীতি গ্রহণ বা পরিবর্তন বিশ্বের
ছোট-বড় দেশকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে। সামনের দিনগুলোতে এ প্রভাব আরো
বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমেরিকা নিজের
প্রচেষ্টাতেই বিশ্ব মঞ্চে অর্থনীতির সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
লেখকঃ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত।