মনুষ্যত্বের
কার্যকর অস্তিত্বের মধ্যেই মানুষের প্রকাশ। মনুষ্যত্ব আছে বলেই মানুষ
অর্থাৎ মনুষ্যত্ব ধারণ বা লালন করলেই তাকে মানুষ বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর বলেছেন “ভালোমন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে মানুষ ভালোকে বেছে নেবে
বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয়। মানবতা যখন হারায়, তখন সভ্যতাও নিঃস্ব
হয়ে পড়ে। মানবতা ছাড়া সভ্যতা মূল্যহীন”।
মানুষের যেসব গুণ জগতের
অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষকে পৃথক করেছে, মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা
দিয়েছে, সেই গুণগুলোই মনুষ্যত্বের উপাদান। মানুষের চেতনায়, মানুষের
প্রতিভায় এসব গুণ সুপ্ত থাকে। মানুষকে তার চলার পথে প্রেরণায়, দুঃখে,
সান্ত্বনায়, উদ্যোগে, উদ্যমে, আদরে, আপ্যায়নে, ভালোবাসায় এসব গুণের চর্চা
করতে হয়।
আকার-আকৃতি, রঙে-ঢঙে মানুষ পৃথক হতে পারে: কিন্তু মানুষ
মানুষকে ভালোবাসবে, মানুষের অধিকার দেবে, মানুষকে সম্মান করবে এটাই
মনুষ্যত্ব। একই সঙ্গে প্রকৃতিকে ভালোবাসবে, জীবজগৎকে ভালোবাসবে এবং সেবা
করবে এটাই মানুষের ধর্ম। কেননা জীবকে ভালোবাসলে, তাদের প্রতি দয়া করলে
স্রষ্টাও খুশি হন। বিনয়, সৌজন্য, পারস্পরিক মর্যাদাবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা
ও কর্মযজ্ঞের বন্ধন সমাজকে সুন্দর ও সৌহার্দপূর্ণ করে তোলে।
বইয়ের
পাতায় আছে ছাত্রজীবনই মনুষ্যত্ব লাভের উপযুক্ত সময়। কথাটি বাস্তবে সত্য।
তবে সেই কথাটির গুরুত্ব দেয় কমসংখ্যক শিক্ষার্থী। যারা কথাটি ঠিকমত কাজে
লাগাতে পারে তারাই জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারে। আর যারা কথাটির গুরুত্ব দেয়
না তদের জীবনে শেষ পরিণতি হয় দুঃখ। বর্তমানের যুগ সভ্যতার যুগ। সভ্যতার
যুগে টিকে থাকতে হলে জীবনকে এমন ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে
কোন বাধা বিঘ্নে পড়তে না হয়।
খারাপ যিনি যেমন মানুষের কাজে ঘৃণ্য তেমনী
মনুষ্যত্বহীন মানুষকে সমাজের মানুষ অবজ্ঞার চোখে দেখে। এই মনুষ্যত্বকে
অর্জন করার একমাত্র পন্থা হলো বই। বই ও শিক্ষা ছাড়া কেউ জীবনে উন্নতি লাভ
করতে পারে না। কিন্তু সেই মনুষ্যত্বকে অর্জন করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী
মেধাবী হয়েও অর্থের অভাবে ব্যর্থতার মুখে পতিত হতে হয়। অথচ সমাজের ধনী
ব্যক্তিরা যদি তাদের একটু সাহায্য করত তাহলে তাদের ব্যর্থতার মুখে পতিত হত
না। মনুষ্যত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি সেই যিনি সহানুভূতিশীল, করুণাময়, উদারতা
ক্ষমাশীল ইত্যাদি গুণের অধিকারী। অনেক মানুষ নিজেকে জ্ঞানী মনে করে মানুষের
কাছে জাহির করতে চায়। কিন্তু মনুষ্যত্ব হৃদয়ের অধিকারী মানুষ নিজেকে ছোট
বলে মানুষের কাছে পরিচয় দিয়ে থাকে।
মানুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষ নিজের
জীবনকে বির্সজন দিয়ে অসহায়কে বিপদ থেকে উদ্ধার করে আনে। প্রয়োজনে নিজে না
খেয়ে তার খাবার তুলে দেয় দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের মুখে। আমরা সবাই মানুষ
বলে পরিচিত। কিন্তু প্রকৃত মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষ সমাজে খুব কম। প্রকৃত
মানুষ সেই ব্যক্তিকেই বলা যায়। যিনি মনুষ্যত্বের হৃদয়ের অধিকারী। মনুষ্যত্ব
এমন এক জিনিস যা মানুষকে লাঞ্ছনার পথে না ঠেলে সব সময় সম্মানের পথে নিয়ে
যায়। কিন্তু বিত্তবান পরিবারের ছেলে মেয়েরা সুখের প্রভাবে মনুষ্যত্বকে
এড়িয়ে চলে তারা দামি পোশাক পড়ে ঠিকই। কিন্তু তারা যদি জ্ঞানহীন বা
মনুষ্যত্বহীন হয় তবে তাদের পোশাকের কোন মূল্য থাকেনা। অপর দিকে সাধারণ
পোশাক পরা লোকদের উপহাস করা ঠিক নয়। কারণ তারা এমন জ্ঞানের অধিকারী হতে
পারে যা দিয়ে তারা তোমাকে পরাজিত করতে পারে।
সভ্যতার যুগে বেঁচে থাকতে
হলে একমাত্র পন্থা হলো মনুষ্যত্ব অর্জন করা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের
নির্দিষ্ট বই সমূহ পড়ে ও মনুষ্যত্ব অর্জন বর্তমান সমাজে দৃশ্যমান কম।
মনুষ্যত্বকে অর্জন করতে হলে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের বই পড়তে হয়।
মনুষ্যত্ব গঠনে বই পড়ার কোন বিকল্প খুবই কম রয়েছে।
প্রাচীন প্রবাদে বলা হয়েছে-পৃথিবীর কাছে তোমার মনুষ্যত্বের পরিচয়ই হচ্ছে তোমার সত্যিকারের নাম।
মনুষ্যত্ব
নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”-
মানবতার চূড়ান্ত রূপই ঈশ্বরভক্তি। মহাত্মা গান্ধী বলেন, “মানবতা হলো একটি
ধর্ম যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেই।” প্রকৃত ধর্ম হলো মানুষের প্রতি
ভালোবাসা। হেলেন কেলর বলেন “সবচেয়ে ভালো ও সুন্দর জিনিসগুলো চোখে দেখা যায়
না, সেগুলো হৃদয়ে অনুভব করতে হয়।” মানবতার আসল মূল্য বোঝা যায় হৃদয় দিয়ে।
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, “আমি সবসময় চেষ্টা করি মানুষ হওয়ার, শুধু একজন সফল
মানুষ নয়।” মানুষের আসল পরিচয় তার মনুষ্যত্বে।
মনুষ্যত্বকে আড়াল করে
অবলুপ্ত করে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। মানবজীবনে এবং মানব কল্যাণে
মনুষ্যত্বের বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধন অপরিহার্য। কেননা আমাদের পারিবারিক,
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ মানবতাবোধ তথা মনুষ্যত্বের ওপর
প্রতিষ্ঠিত। এ মূল্যবোধগুলো যে কোনো মূল্যে আমাদের ধরে রাখতে হবে। এগুলো
ধরে রাখলেই মনুষ্যত্ববোধের চর্চা স্বাভাবিকভাবে সবার মধ্যে গড়ে উঠবে।
উগ্রতা
বা ধর্মান্ধতা নানাভাবে আমাদের মূল্যবোধের ঐতিহ্য নষ্ট করতে পারে। তাই শুভ
বুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষকে প্রতিবাদী এমন উগ্রতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে
তুলতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবারে, সমাজে, মন্দিরে, মসজিদে, শিক্ষালয়ে নৈতিক
শিক্ষা ও মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এ সম্পর্কে সঠিক
প্রচার হলে এখনকার প্রজন্ম মনুষ্যত্বের লালন ও চর্চায় অধিকতর অনুরাগী হয়ে
উঠবে। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের অধিকার, কর্তব্য ও দায়িত্ব এবং মর্যাদা
সম্পর্কে আমরা সবাই সচেতন হলে মনুষ্যত্বের বিকাশ সহজ হয়ে যাবে। আর আমাদের
সমাজে মনুষ্যত্বের বিকাশ যত ঘটবে, ততই আমাদের সমাজ ও দেশ শান্তিপূর্ণ হয়ে
উঠবে
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ , কুমিল্লা আইডিয়াল কলেজ, বাগিচাগাঁও, কুমিল্লা।