** ৮ বছরে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ড; 
** সংঘর্ষ-হানাহানি ঘটছে অহরহ

কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যে আতঙ্কিত নগরবাসী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত ও আবাসিক এলাকায় অস্ত্রসহ এসব গ্যাংয়ের শোডাউনে ভীত সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ। প্রকাশ্যে বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র নিয়ে ককটেল ফাটিয়ে নতুন প্রজন্মের ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোর-তরুণদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠাকে সামাজিক অবক্ষয় এবং বড় অপরাধী তৈরির পাইপলাইন বলে আখ্যায়িত করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। দিনে দুপুরে শহরের রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাগালের মধ্যে এসব বখাটেদের সক্রিয়তা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। সবশেষ শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) ছুটির দিনের বিকেলে নগরীর বেশ কয়েকটি এলাকায় কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৫ শতাধিক সদস্যের অস্ত্রের মহড়া এ প্রশ্ন নতুন করে আবারো সামনে নিয়ে এসেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিগত কয়েক বছর কুমিল্লা নগরীতে সাইফুল গ্রুপ, রতন গ্রুপ, পয়েন্ট রাব্বি গ্রুপ, বার্থ ফর ফ্লাইং, রক স্টার, চেক ইন, সিআর সেভেন, ব্ল্যাক ড্রাগন, রেক্স, ঈগল গ্যাং, ডিডব্লিউআর, ফ্লাইং ঈগল, হেপেন গ্রুপ, বিগ বস, ব্ল্যাক ফাইটার, ভিল্লা গ্রুপ, সিভিসি, আরজিএস, এক্স প্যারাগন, এলআরএন, মডার্ন, ডিস্কো বয়েজ, এক্সসিএমএইচএসসহ ২০টিরও অধিক কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয়তা দেখা গেছে। বিভিন্ন স্কুল কলেজ কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা গ্যাংগুলো কমবয়সীদের হলেওখুন, মাদক ব্যবসা, চুরি- ছিনতাই সব ধরনের অপরাধেই সংশ্লিষ্টতা রয়েছে তাদের। অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়াতেই বেড়ে ওঠেছে তারা। যদিও কিশোর গ্যাংয়ের এসব গ্রুপের শেকড় ঠিক কোন জায়গা তা এখনো খোঁজে বের করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।
পুলিশ ও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের পর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের হাতে ৮ বছরে অন্তত ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গ্যাং গ্রুপগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এর মধ্যে শহর জুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করে, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাতে নগরীর অশোকতলা এলাকায় সজীব হোসেন ওরফে বাবু (২২) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে ছুরিকাঘাত করা হলে পরদিন সকালে হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশ বলছে, ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের মাদক কারবার।
এর আগে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে নগরের দক্ষিণ চর্থা বড়পুকুর পাড় এলাকায় ‘থার্টি ফার্স্ট নাইটের পার্টি’ থেকে ডেকে নিয়ে ফয়সাল ইসলাম (১৯) নামের এক তরুণের হাত-পায়ের রগ কেটে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়। 
২০২২ সালের ১৯ আগস্ট নগর উদ্যানের সামনে শাহাদাত হোসেন নামে (১৫) এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আমিন (১৫) নামের এক কিশোরকে পিঠে ও বুকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে কিশোর গ্যাং।
এদিকে ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কয়েকমাস গ্যাংগুলোর নিরবতা থাকলেও গত তিন মাসে তাদের শোডাউনের ঘটনা নিয়মিত। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, রানীর দিঘীর পাড়, ধর্মসাগর পাড়, আদালত পাড়া, কান্দিরপাড়, মডার্ন স্কুল, রানীর বাজার, তালপুকুর পাড়সহ বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় তারা মহড়া করে আধিপত্যের জানান দেয়। মহড়া মিছিলে এসব কিশোর তরুনদের হাতে ধারালো অস্ত্র ও মোটর বাইক ব্যবহার করতে দেখা যায়। এছাড়া দেয়ালে দেয়ালে তাদের গ্যাংয়ের নাম লিখেও জানান দেয় আধিপত্যের। 
এরই ‘ধারাবাহিকতায়’ গত শুক্রবার বিকালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে ভিক্টোরিয়া কলেজ, রানীর দিঘীর পাড়, তালপুকুর পাড়, আদালত এলাকায় অন্তত ৫০০ সদস্যের একটি গ্যাং তাদের শোডাউন করে। রাস্তায় প্রকাশে ককটেল ফাটিয়ে ধারালো অস্ত্র প্রদর্শন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা। মোটরসাইকেল ও পায়ে হেঁটে এই শোডাউন এর কয়েকটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। রাতেই কিশোর গ্যাংয়ের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয় বলে জানা কোতোয়ালী থানার ওসি মাহিনুল ইসলাম। তবে তারা কোন গ্রুপের সদস্য তা জানাতে পারেনি পুলিশ। 
ওসি মাহিনুল ইসলাম জানান, শহরের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের মহড়ার খবর পেয়ে পুলিশ তাৎক্ষণিক অভিযানে নেমে পড়ে। এসময় একটি গ্রুপের মহড়ায় ধাওয়া করে তিনজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিরা পালিয়ে গেছে। তাদের কাছ থেকে ছুরি, চাকু এন্টি কাটার উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের অভিযান চলছে। ভিডিও ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হবে।
ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি সদস্য রহমত বিন হানিফ সেসময়ের ঘটনা বর্ণনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন। তিনি তার পোস্টে উল্লেখ করেন, 'আজ ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে বিএনসিসির হয়ে ডিউটি দিয়েছিলাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। পরীক্ষার সময়ে বাহিরে থেকে মিছিলের শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দ শুনে দ্রুত বাহিরে আসলাম। এসে দেখি অনেক গুলো ছোট ছোট ছেলে। তাদের বয়স সর্বোচ্চ ১৬ বছর হবে। তাদের অনেকের হাতে রামদা, চুরি, চাপাতি দেখেছি। তারা আতশবাজিও ফোটাচ্ছিল। তাদের কাছে গিয়ে বললাম এখানে পরীক্ষা চলছে এভাবে আওয়াজ করবেন না। তারা আমাকে তাাদের অস্ত্রগুলো দেখিয়ে আরও বেশি আওয়াজ করে ছুটে চললো। তারপর পুলিশের কাছে যখন এই ব্যাপার বললাম তারা এই ব্যাপারে একটুও মাথা ঘামালো না।'
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হাসিন ইশরাক মিজার বলেন, '"৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা শহরে কিশোর গ্যাং এর তান্ডব আশংকাজনকভাবে বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে কুমিল্লার প্রশাসনের নীরবতা এর প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি, কেননা এরকম ঘটনা এখন প্রায়শই ঘটছে কিন্তু প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যাবস্থা নিচ্ছে না। মাঝেমধ্যে দু'একজনকে ধরপাকর হচ্ছে কিন্তু তারা আবার কিছুদিন পর ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তাদেরকে যারা আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে তারা পুরোপুরি নাগালের বাইরেই রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে এ শহর আরো অনিরাপদ হয়ে উঠবে বলে আমি আশংকা করি। শহরের এ সমস্যা নিরসনে আমি দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।'
এদিকে পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কুমিল্লা নগরীতে কিশোর জ্ঞান সদস্যদের এমন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার বিষয়টিকে আতংকের উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কোন কিশোর গ্যাংকে যেন কেউ রাজনৈতিক প্রশ্রয় না দেয় সেই আহ্বান জানিয়ে কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপু বলেন, 'আমরা রাজনীতি করি মানুষের সেবা করার জন্য। কোন রাজনীতিবিদ যদি কিশোর গ্যাং দেরকে প্রশ্ন দিয়ে থাকেন তাহলে তারা মানুষের বিপক্ষে দাঁড়ালেন। একটি প্রজন্মকে বিপথগামী করার জন্য সহযোগিতা করলেন। বিএনপি কিশোর গ্যাংয়ের এই তৎপরতা সমর্থন করে না।'
ইউসুফ মোল্লা টিপু আরো বলেন, 'অতীত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ছাত্রছায়ায় এসব গ্যাং বিভিন্ন ওয়ার্ডে গজিয়েছিলো৷ এখন সেসব গ্যাং আবার কার প্রশ্রয়ে মাথাচারা দিচ্ছে তা প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে। এমনও হতে পারে আওয়ামী লীগের কেউই তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করে রাস্তায় নামিয়েছে।'
কুমিল্লার অপরাধ বিশ্লেষক বিশিষ্ট আইনজীবী ও কুমিল্লা আদালতের পিপি কাইমুল হক রিঙ্কু বলেন, 'আবার কুমিল্লা নগরীতে কিশোরগ্যাং মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, প্রশাসনকে বিষয়টি সতর্কতার সাথে বন্ধ করতে হবে। আধিপত্য বিস্তারের জন্য কেউ যেন এই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের ব্যবহার না করে সেদিকে রাজনীতিবিদদেরও সচেতন হতে হবে। প্রতিমাসের জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিং এ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেসব সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।'
আইনজীবী কাইমুল হক রিঙ্কু আরো বলেন, 'অভিভাবকদের খোঁজ রাখতে হবে তার সন্তানেরা কোথায় যাচ্ছেন কি করছেন। অস্ত্রসহ মহড়ার মত অপরাধ থেকেই এইসব কিশোররা বড় বড় অপরাধে জড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তাদেরকে এখনই থামানো না গেলে - পরিবার তথা সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে এর দায় ভোগ করতে হবে।'
কুমিল্লা নগরীতে প্রতিবারই কিশোর গ্যাং সদস্যদের এমন শোডাউনের পর অভিযুক্ত কয়েকজনকে আটক করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক এসব অপরাধীদের নিয়ে পুলিশের সতর্ক অবস্থান জানিয়ে কুমিল্লা সদর সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের যেসব সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়েছে আমরা তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে যাচাই-বাছাই করছি। যেহেতু তাদের অনেকেই অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী সুতরাং তাদের বিষয়ে আমাদের খুব সতর্কভাবে কাজ করতে হয়। আমরা কুমিল্লার বিভিন্ন কিশোর গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছি - আশা করছি এই সমস্যা নিরসন করতে পারব।