[পিতামহ অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক]
অন্তর ভৌমিক ||
আমার ঠাকুরদা (পিতামহ) অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ১৩৫০ বঙ্গাব্দের ২৯ শ্রাবণ-/১৯৪৩ সালের ১৫ অগাস্ট, রবিবার কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পড়াশোনার সনদে জন্ম তারিখ ৩০ মার্চ ১৯৪৬ খ্রি:।
ঠাকুরদার পিতা স্বর্গীয় ইন্দুভূষণ ভৌমিক বি,এ বেসরকারি হাই স্কুলে ৫০ বছর চাকরি করেছেন, চাকরির শেষ ১৪ বছর বরকোটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সে স্কুল থেকেই আমার ঠাকুরদা ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও বি,এ অনার্স-(বাংলা) যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৬ সালে পাশ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে এম.এ (বাংলা) পাশ করে ১মে ১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৩ সালের ২৮মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি কলেজে চাকরি করেন।
আমার ঠাকুরমা স্বর্গীয় আরতিবালা দাশ বি,এ, বি-এড পাশ করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা পদে চাকরি করে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। দুঃখের বিষয় তিনি ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
আমার একমাত্র পিসি সুতপা ভৌমিক ও আমার বাবা অণীকরঞ্জন ভৌমিক-দু’জন ভাইবোন। দু’জনই স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন। পিসি স্বামীসন্তানসহ কানাডা অধিবাসী, বাবা-মা সহ আমরা চট্টগ্রামে থাকি।
আমার ঠাকুরদা কুমিল্লায় তাঁর নিজস্ব বাসায় থাকেন। বাসার নাম ‘আশালয়’ (আরতির ‘আ’+শান্তির ‘শা’=আশা+আলয়=আশালয়), ৪৩০, ঠাকুরপাড়া, কুমিল্লা-৩৫০০। ঠাকুরদা তাঁর চাকরি জীবনের ২৬ বছর কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। এজন্যই হয়ত বা কুমিল্লা শহরে তিনি স্থিত হয়েছেন। কুমিল্লা শহরের অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি রয়েছে। যেমন তিনি রামকৃষ্ণ আশ্রমের সাড়ে একুশ বছর সম্পাদক ছিলেন ও চৌদ্দ বছর যাবত সভাপতি পদে আছেন। এজন্য শহরের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই তাঁকে চিনে-জানে। তিনি কুমিল্লা সংস্কৃত কলেজের সভাপতি, অজিতগুহ মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহ-সভাপতি, কমিউনিটি পুলিসিং-এর সদস্য, যাত্রী সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা ইত্যাদি।
কুমিল্লার জনপ্রিয় ‘দৈনিক কুমিল্লার কাগজ’ পত্রিকার উপদেষ্টা এবং কলামিস্ট। এই পত্রিকায় প্রতি মঙ্গলবার তাঁর কলাম প্রকাশিত হয়। নানা বিষয় ও স্বাদের কলাম লেখক হিসেবে কুমিল্লা শহরের নানা শ্রেণি-পেশা অর্থাৎ সর্বসাধারণের কাছে খুবই পরিচিত। কুমিল্লায় গেলে যেখানেই তাঁর নাম উল্লেখ করলেই এই পরিচিতির স্বাক্ষর মেলে। ঠাকুরদার জন্য তখন গর্ববোধ করি, অহংকারও হয়।
ঠাকুরদা অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক সম্পর্কে অবশেষে আমাকেই কলম ধরতে হলো। কারণ, এই বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ব্যক্তিটি একান্তই প্রচারবিমুখ একজন নিভৃতচারী আদর্শবান ব্যক্তি। কারণ, তাঁর জগৎ, জীবনচর্চা, আদর্শযাপন ও মনগত দর্শন অন্য দশজনের সঙ্গে মেলে না। যখনই তাঁর সান্নিধ্য পাই, কোনোদিন কোনো ব্যাপারেই শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়নি। আমার মনে হয়-এ উপলব্ধিটা অনেকেই যাপন করে থাকবেন। তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং অবলোকন স্বচ্ছ ও জীবন্ত। আমি যে দিকটি নিয়ে লিখতে বসেছি, তার মধ্যেই সীমিত থাকব। কারণ, আমার ঠাকুরদা (পিতামহ) আমারই শরীরে বহমান রক্তধারার উত্তর-প্রবাহ। তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা অর্থ আমার কথাই বলা। এ বলার মধ্যে আমার আত্মতৃপ্তি থাকলেও অপরের কোনো দায় নেই। জোর করে তিতো ঔষুধ খাওয়ানোর পক্ষের লোক আমি নই, তাতে রোগীর যতটুকুই উপকার হোক। কিন্তু যে কথা বলতে তৎপর হয়েছি, এটা আমার দায়, আমার পরিবারের দায় ও দায়িত্ব।
আমার ঠাকুরদা শিক্ষকতা করেছেন, তাঁর ছাত্রদের মুখে প্রশংসা শুনেছি। তিনি পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হওয়ায় অপর চার ভাই ও তিন বোনের জন্য স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের মুখে এসব কথা শুনে ঠাকুরদার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েছি। শিক্ষকতা জীবনে কিছুটা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে জীবনযুদ্ধে চলমান ধারাবাহিকতাকে সচল রাখতে এবং কোনো কোনো গুণিজনের অনুপ্রেরণায় লেখালেখি শুরু করেছিলেন। সে সময় তাঁর প্রতিটি বই ছিল পাঠ্যপুস্তক সহায়ক। সৃজনশীল কোনো রচনা নয়।
ঠাকুরদা যখন ২০০৪ সালে পুরোপুরি অবসর জীবন যাপন করা শুরু করলেন, তখন থেকেই স্বরূপে স্বভাবনায় তাঁর বই লেখার যাত্রা। তিনি কতটি বই লিখেছেন, অর্থাৎ কতখানা বই প্রকাশিত হয়েছে, তা পরিবারের লোক হয়েও জানি না। অথচ যখনই কুমিল্লায় বাসায় আসি, তখন তাঁর লেখা নতুন বই দেখতে পাই। তিনি পড়তে বা সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেন না। আমরাও বিষয়টি এভাবে দেখিনি, আগ্রহবোধ করিনি। আলমিরা ভর্তি বই, বাংলা বিষয়ের নানা শ্রেণির বই, চোখ বুলালে ফাঁকে ফাঁকে তাঁর বইও নজরে আসে।
ঠাকুরদা যে কত বই লিখেছেন, তা যেমন জানি না, তিনি কোন মাপের লেখক, লেখক সম্প্রদায়ে তাঁর অবস্থান কি, কুমিল্লা শহর ভিন্ন বাংলাদেশে তাঁর লেখক হিসেবে পরিচিতি আছে কীনা, তাও জানতে চেষ্টা করিনি। আমার বাবা-মাও তেমনভাবে এ বিষয়টি যাপন করেন কীনা জানি না। যদি তাঁরা আন্তরিক হতেন, তবে আমি আগেই নিজের মধ্যে আগ্রহবোধ করতাম। এ বিষয়টি যখন আমার বোধে আঘাত দিল, তখন ঠাকুরদার লেখক জীবনের অনুসন্ধান করতে সচেষ্ট হই। দেখি-তিনি নজরুল ইসলামের উপর ১৫টি, রবীন্দ্রনাথের উপর ৪টি, বঙ্গবন্ধুর উপর ২টি এবং নানা বিষয়ে অনেক বই লিখেছেন এবং এ সংখ্যা মনে হলো অর্ধশত। নিজেই নিজের কাছে লজ্জিত হলাম। আমার ঠাকুরদার কথা অন্যেরা বলবে কি বলবে না, এটা তখন আমার বিবেচ্য বিষয় রলো না, আমার দায়টাই তখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। আমি তখন ঠাকুরদার প্রকাশিত বইগুলো আলমিরা থেকে খুঁজে খুঁজে এক জায়গায় জড় করলাম। ভাবলাম-আমার ঠাকুরদা, অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক পারিবারিক দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে, দ্রারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে, ভাই-সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে, কখন কীভাবে এই পাহাড়-সম সৃষ্টিশৈলীর ইমারত নির্মাণ করলেন? অনুসন্ধানে পেয়ে গেলাম, তাঁর সম্পাদিত ‘অরণিকা’ চতুর্মাসিক সাহিত্য পত্রিকার ২৯টি সংখ্যা যার মান যেকোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রথমশ্রেণি লিটল ম্যাগাজিনের সমতুল্য। অবাক হলাম-এসব কিছু তিনি লিখেছেন, প্রকাশ করেছেন এই কুমিল্লা শহরে থেকেই। কিছু অভিমান হয়-ঠাকুরদাকে প্রশাসন ডাকে, রাজনীতিবিদরা লৌকিক সম্মান জানায়, সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে আমন্ত্রণ জানায়, কিন্তু কোনো স্বীকৃতি দিয়েছে বলে শুনিনি। সামনাসামনি প্রশংসাসূচক পাঁচকথা শোনায়, কিন্তু তালগাছটির পাওনা অংশও দেয়নি। তাতে ঠাকুরদা খুবই নির্লিপ্ত। নির্লোভ হয়ত বলতে চাই না, তবে নিস্পৃহতায় আচ্ছন্ন একজন গোপনচারী পরিব্রাজক। মনের মানুষের কাছে উচ্ছ্বাসপ্রবণ ও সাবলীল, অন্যরকম খরস্রোতা নদীর মতো গতিশীল। অথচ অনেকেই তাঁকে রাশভারী ব্যক্তি হিসেবেই জানেন, আমারও একসময় মনে হতো। যখন নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ ঘটল, তাঁর মতো রসিকজন জীবনে দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাইনি।
যে উদ্দেশ্যে আমার কলম-ধরা। আমি আমার ঠাকুরদা অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের প্রতিটি বই-এর (যতটি সংগ্রহ করতে পেরেছি) তার তালিকা প্রকাশ করতে উদ্যোগ নিলাম। যদি জীবনে সুযোগ ঘটে, তবে তাঁর রচনাবলী ছাপতে প্রচেষ্টা নিব। কারণ, এ আমার অহংকার, আমাদের পরিবারের দায় এবং ঐতিহ্যের ঠিকানা, আমাদের অস্তিত্বের শেকড়। তিনি হয়ত একদিন থাকবেন না, আমরাও কি থাকব? কিন্তু ঠাকুরদার সৃষ্টি-সৌধ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকালের জন্য। কোনো না কোনোদিন, কেউ না কেউ আমার ঠাকুরদার সৌধ স্পর্শ করে ধন্য হবে-তা তো গর্ব করেই বলতে পারি। মানুষের বিত্তবৈভব কতদিনের, সুখ-সাম্রাজের অট্টালিকা কত দিনের? এ ক্ষেত্রে চিত্তের খোরাক যে পরম্পরা, তা কখনো নি:শেষ হয় না, তার প্রয়োজনও শেষ হয় না।
হে পিতামহ! আমাদের প্রণাম গ্রহণ করো। আমাদের মাঝে তুমি থাকবে অনন্তকাল। ভুল বললাম- তোমার পরিচয়েই আমরা বেঁচে থাকব চিরকাল। আর বেঁচে থাকার স্মারক হলো তোমার ধ্যানলব্ধ সাধনার সৃষ্টি-সৌধ, রচনাসম্ভার। যার মধ্যে সময়ের বইতা নদীর মতো ঠাকুরদার জীবনবেদ, দর্শন, বিশ্বাস-উপলব্ধি সবকিছু উজ্জ্বল স্বাক্ষর হয়ে রয়েছে। এখনও আত্মস্থ করার সময়-বয়স ও প্রজ্ঞা যাপনের উপযোগী হইনি। আমি একদিন এই রহস্যের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করব-এজন্য আমি আশীর্বাদপ্রার্থী।
নজরুল বিষয়ক
১. আমি নজরুল
২. যুবরাজ যখন কুমিল্লায়
৩. নজরুল ও প্রমীলা পরিবার
৪. নজরুল-চর্চা : প্রসঙ্গ কুমিল্লা
৫. পান্থজনের সখা
৬. নজরুলের বিদ্রোহী
৭. নজরুলের উপন্যাস
৮. চিঠিপত্রে নজরুল
৯. অঞ্জলি লহ মোর
১০. নজরুল সন্ধানে
১১. সমকালে রবীন্দ্র-নজরুল
১২. নজরুল ও কুমিল্লা
১৩. নজরুল কথন
১৪. শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুলের আগমন : কিছুকথা
১৫. নজরুলের নার্গিস ও প্রমীলা (নাটক)
রবীন্দ্র বিষয়ক
১. রবীন্দ্র-পরিক্রমা
২. ত্রিপুরার রাজন্যবর্গ ও রবীন্দ্রনাথ
৩. ভানুসিংহের কুমিল্লা আগমন
৪. কুমিল্লায় রবীন্দ্রনাথ
জীবনী বিষয়ক
১. মহাকবি কালিদাস
২. অন্তর্লোকে আপনজন : অজিতকুমার গুহ
৩. আমি শচীনকর্তা
৪. ফয়জুন্নেসার রূপজালাল (যন্ত্রস্থ)
সমালোচনা বিষয়ক
১. চর্চাপদ পরিচয়
২. বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়
৩. প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য
৪. সাহিত্য সুহৃদ
৫. বাংলা ছন্দ ও সাহিত্যতত্ত্ব
৬. বাংলা রূপ-রস-অলংকার-ছন্দ
ফিরে দেখা
১. কাছের মানুষ নিজের কথা
২. তুচ্ছ কথা
৩. আপনবোধে দেখা
৪. আমার যতকথা
৫. ফিরে দেখা আমার কুমিল্লা
৬. অবুঝ মনের কথা
৭. অবলোকন : ব্যক্তি-সমাজ-ইতিহাস (যন্ত্রস্থ)
আপনকথা
১. একজীবনে
২. সময়ের বহতা নদী
গবেষণা
১. বাংলা সাহিত্যে বিহারীলাল
২. কুমিল্লার উপভাষা পরিক্রমা
বঙ্গবন্ধু বিষয়ক
১. বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ
২. শক্তিধর বঙ্গবন্ধু
ধর্ম বিষয়ক
১. তব কৃপা
২. উপলব্ধি ও বিশ্বাস
বিচিত্র নিবন্ধ/প্রবন্ধ-(পত্রিকার কলাম)-প্রায় ১০০০টি।
সম্পাদনা
১. রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী
২. মানসী (বর্ণিতা)
৩. রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র প্রবন্ধ
৪. রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ
৫. বিহারীলালের রচনা সমগ্র
৬. কালকেতু উপাখ্যান
৭. মানসিংহ-ভবানন্দ কাব্য
৮. ময়মনসিংহ গীতিকা
৯. শ্রীকান্ত ১মপর্ব
কবিতার বই
কথা ও কবিতা।