
প্রভাষ আমিন ||
করোনাকে
আমি বলি বৈষম্যমুক্তির ভাইরাস। জাতি-ধর্ম, ধনী-গরিব নির্বিশেষে করোনা
আক্রান্ত হয়েছেন। সব অর্থেই বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রেই
লেগেছিল করোনার সবচেয়ে বড় ধাক্কা। শুরুতে করোনার ভয়ংকরতার সামনে অর্থ নিছকই
কাগজে পরিণত হয়েছিল। বিপুল অর্থ, বিশাল হাসপাতাল, আণবিক অস্ত্র,
যুদ্ধবিমান, প্রবল ক্ষমতা- সবকিছুই করোনার সামনে অর্থহীন ছিল। এমনকি শুরুতে
চিকিৎসা বিজ্ঞানকেও অসহায় মনে হচ্ছিল। করোনার প্রবল সুনামি ভাসিয়ে নেয়
সবকিছু।
করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল বৈষম্য না করতে,
গোটা বিশ্বকে একপাল্লায় তুলে মাপতে। সবাইকে এক চোখে দেখার এই ধারণা কিন্তু
সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব নয়, এ নিষ্ঠুর বাস্তবতা। শুরুর দিকের ধাক্কায়
বাংলাদেশের অনেক বিত্তশালী পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন।
খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাদের পরিবারে করোনা ঢুকেছে ড্রাইভার বা বাসার
সহকারীদের মাধ্যমে। বিত্তশালীরা নিজেদের জন্য সর্বোচ্চ সুরক্ষার ব্যবস্থা
করলেও ড্রাইভার বা সহকারীদের সুরক্ষার কথা ভাবেনি, যার মূল্য দিতে হয়েছে
তাদের জীবনের বিনিময়ে। আসলে করোনা শিখিয়েছিল, সবার জন্য সমান সুরক্ষা
দরকার। কিন্তু আমরা শিখিনি। কোনও কোনও পরিবারের প্রবীণ ও অসুস্থ সদস্যরা
সারা দিন নিজেদের বাসায় বন্দি রেখেও বাঁচতে পারেননি। হয়তো সে পরিবারের ১০
সদস্যের মধ্যে ৯ জনই বাসায় ছিলেন, সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছেন। কিন্তু
পরিবারের তরুণ সদস্যটি হয়তো কিছু মানতে চাননি, বাইরে গেছেন, ঘোরাঘুরি
করেছেন, আড্ডা মেরেছেন এবং বাইরে থেকে করোনাভাইরাস ঘরে নিয়ে এসেছেন। আর
তাতে আক্রান্ত হয়ে সারাক্ষণ ঘরে থাকা প্রবীণ সদস্যটি মারা গেছেন।
করোনা
সত্যি সত্যি সবার জন্য সমান সুরক্ষা, সমান সুবিধা, সমান চিকিৎসার কথা
বলেছে। আমরা সেটা শুনিনি। করোনা বৈষম্য দূর করার কথা শিখিয়েছে। আমরা আরও
বেশি করে বৈষম্য সৃষ্টি করেছি।
করোনা গোটা বিশ্বকে একটা ইউনিট বা ‘ওয়ান
ওয়ার্ল্ড’এর ধারণা শিখিয়েছিল। আমরা শিখিনি। বন্দরে বন্দরে পাহারা বসিয়েছি।
কিন্তু করোনার বিস্তার ঠেকানো যায়নি। দিকে দিকে করোনা তার বিস্তার ঘটিয়েছে।
এ যেন বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার। নিশ্ছিদ্র বাসরঘর বানিয়েও যেমন বাঁচতে
পারেননি লখিন্দর। আমরাও নানাভাবে নিজেদের লখিন্দরের বাসরঘরে আটকে রেখেও
রেহাই পাইনি। সুতানলি সাপের মতো করোনাভাইরাস ঢুকে সব তছনছ করে দিয়েছে।
শুরুর
দিকে করোনার কোনও চিকিৎসা ছিল না, এখনও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আসেনি।
চিকিৎসকরা নানা লক্ষণের চিকিৎসা করে রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।
করোনার ব্যাপারে বিশ্বের সব চিকিৎসকের অভিজ্ঞতাই সমান। দুই বছরের কাছাকাছি।
তাই করোনা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিনই ছিল। প্রথমে বলা হচ্ছিল, করোনা
শুধু প্রবীণদের জন্য বিশেষ করে অন্য রোগে আক্রান্তদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু পরে দেখা গেলো, প্রবীণদের ঝুঁকি বেশি বটে, তবে সব বয়সের মানুষই
করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন।
প্রথমে বলা হচ্ছিল, করোনা একবার হলে আর হবে না। পরে দেখা গেলো, এই ধারণাও ভুল। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বারবার করোনা হতে পারে।
করোনা
আসার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানীরা বসে গেলেন গবেষণায়। দ্রুততম সময়ে আবিষ্কার
হলো করোনার টিকা। বেশ কয়েকটি করোনার টিকার প্রয়োগও শুরু হলো দেশে দেশে।
কিন্তু করোনা যে বৈষম্যহীন ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’এর ধারণা আমাদের শেখাতে চেয়েছিল,
টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা ভুলে গেলাম। আবার আমরা অর্থ, প্রভাব,
প্রতিপত্তি দিয়ে করোনা মোকাবিলার ভুল চেষ্টা করতে লাগলাম। করোনা একবার নয়,
বারবার ধাক্কা দিয়েও আমাদের শেখাতে পারছে না। উচিত ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থা বা কোভ্যাক্সের নিয়ন্ত্রণে বিশ্বজুড়ে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা।
গোটা বিশ্বের সীমানা ভুলে, যেখানে যেখানে যাদের যাদের আগে টিকা দরকার;
তাদের আগে টিকা দেওয়া। কিন্তু সেটা হয়নি। টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে ধনী
দেশগুলো তা কিনে নেয়। স্বাস্থ্য নয়, টিকা হয়ে ওঠে বিশ্ব কূটনীতির মূল
হাতিয়ার। গরিব দেশগুলোতে যখন টিকার জন্য হাহাকার, তখন ধনী দেশগুলোর ফ্রিজে
টিকা নষ্ট হয়েছে। কোনও কোনও দেশে যেখানে ৭০ ভাগ মানুষ টিকা পেয়েছে, সেখানে
কোনও কোনও দেশে টিকা পেয়েছে ৭ ভাগ মানুষ। উন্নত বিশ্ব যখন বুস্টার ডোজ নিয়ে
কথা বলছে, গরিব দেশগুলোর অনেক মানুষ তখন টিকার চেহারাও দেখেনি।
কিন্তু
আগেও যেমন এখনও তেমন, করোনার শিক্ষা হলো, বৈষম্য করে বাঁচা যাবে না। যেসব
এলাকায় প্রয়োজনীয় টিকা পৌঁছায়নি, সেসব এলাকা অরক্ষিতই থেকে গেছে। এখন
সেখান থেকে ওঠে আসছে করোনাভাইরাসের নতুন নতুন ধরন। আফ্রিকা থেকে ওঠে আসা
করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন এখন নতুন করে কাঁপিয়ে দিচ্ছে গোটা
বিশ্বকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুরুতেই এই ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগজনক বলে
অভিহিত করেছে। কারণ, ওমিক্রন দ্রুত ছড়ায়। মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিতে পারে
প্রতিরোধের সব বাধ। এরই মধ্যে উন্নত বিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে নিজেদের
বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিচ্ছে। কিন্তু গত দুই বছরের অভিজ্ঞতা বলে, এভাবে
করোনার বিস্তার ঠেকানো যাবে না। ওমিক্রন নিয়ে বেশি ভয়ের কারণ হলো, এতদিনের
টিকায় ওমিক্রন ঠেকানো যাবে কিনা, সংশয় দেখা দিয়েছে তা নিয়েও। বিজ্ঞানীরা
এরই মধ্যে নতুন টিকার জন্য গবেষণায় বসেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বৈষম্যহীন
‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’এর ধারণা বাস্তবায়ন করতে না পারলে টিকা দিয়ে বাঁচা যাবে
না।
করোনায় একা বাঁচার কোনও উপায় নেই, বাঁচতে হবে সবাইকে নিয়ে। আপনার
পাশের লোকটি যদি করোনার ঝুঁকিতে থাকে, আপনিও কিন্তু সমান ঝুঁকিতে থাকবেন।
আপনার বাসায় করোনা থাকলে, আপনিও নিরাপদ নন। আপনার পাশের দেশে করোনার
বিস্তার ঘটলে তার ঢেউ আপনার ঘরেও লাগবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন
ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে তারাই শুধু মরবে, আপনি আমেরিকায় বসে নিরাপদ
থাকবেন; সেই ভাবনার দিন শেষ। করোনা থেকে বাঁচতে হলে আপনাকে স্বার্থপরতা
ভুলে যেতে হবে। নিজের স্বার্থে প্রয়োজনে নিজের অর্থে গরিব দেশগুলোকে টিকার
ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
করোনা কবে আবিষ্কার সে তারিখটি সবাই জানেন, ২০১৯
সালের ৩১ ডিসেম্বর; কিন্তু কবে যাবে, সেটা কেউ জানেন না। তাই করোনা থেকে
বাঁচতে স্বার্থপরতা ভুলে সত্যিকারের বৈষম্যহীন ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ গড়ে তুলতে
হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ