Published : Saturday, 13 March, 2021 at 12:00 AM, Update: 13.03.2021 2:22:18 AM
বিশেষ
প্রতিনিধি ॥ ১৩ মার্চ, ১৯৭১। অনিবার্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। লাখো
মুক্তিকামী বাঙালীর উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র প্রস্তুতিতে শঙ্কিত
হয়ে পড়েন পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা। বিরোধী দলের নেতারা পাকিস্তানের
অনিবার্য ভাঙ্গন নিশ্চিত বুঝতে পেরে একাত্তরের এদিন জরুরী বৈঠকে মিলিত হন।
বৈঠক শেষে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে মতা হস্তান্তরের
আহ্বান জানান। কিন্তু সেদিকে তোয়াক্কা না করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধীনতার
সংগ্রাম দমনে নিষ্ঠুর পরিকল্পনা নিতে থাকে হানাদাররা। একাত্তরের মার্চ মাসে
যত দিন গড়াচ্ছিল, স্বাধীনতাকামী বাঙালীর ঐক্য ততই সুদৃঢ় হচ্ছিল।
বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে তখনকার চলমান অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়,
প্রত্যয়দৃঢ় একাত্মতা ঘোষণা করছিল স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন।
পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের আকাক্সায় আন্দোলন-সংগ্রামে মুখর
জনপদ। প্রতিটি গৃহে ও ভবনের শীষে উড়ছে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা আর কালো
পতাকা। অবিরাম চলছে সভা-শোকসভা। অসহযোগ আন্দোলনের এক সপ্তাহ পর দেশ
পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষক, শ্রমিক, চাকরিজীবী,
সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, শিক সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব
রার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা বাংলার দামাল ছেলেদের
এই আন্দোলন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
আজ সামরিক শাসন কর্তৃপ ১৫ নং সামরিক
আইন জারি করে আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিরা বিভাগের বেসামরিক
কর্মচারীদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়। নির্দেশে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে
কাজে যোগদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্টদের চাকরিচ্যুত ও পলাতক ঘোষণা করে সামরিক
আদালতে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা
হয়।
এই নির্দেশ জারির কড়া সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বলেন, সামরিক কর্তৃপরে আজ এই সত্যটি উপলব্ধি করা উচিত, জনগণ আজ তাদের
ইস্পাতকঠিন সংকল্পে ঐক্যবদ্ধ। সামরিক সরকারের এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনের মুখে
তারা কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না। এদিকে সকালে রমনা পার্কে ছাত্র সংগ্রাম
পরিষদের উদ্যোগে জনসভা এবং শীতল্যায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন শ্রমিক
ফেডারেশনের উদ্যোগে দীর্ঘ নৌ মিছিল বের করা হয়। চট্টগ্রামে বেগম উমরতুল
ফজলের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত মহিলাদের এক সমাবেশে বাংলাদেশের জনগণের
পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বিলাস দ্রব্য বর্জন ও কালোব্যাজ
ধারণের জন্য নারী-পুরুষ সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বিশিষ্ট
শিল্পী জয়নুল আবেদিন ও সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল হাকিম পাকিস্তান
সরকার প্রদত্ত খেতাব ও পদক বর্জন করেন। ঢাকাস্থ জাতিসংঘ ও পশ্চিম জার্মান
দূতাবাসের কর্মচারী ও এদের পরিবারবর্গসহ ইতালী, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র,
যুক্তরাজ্য ও কানাডার ২৬৫ জন নাগরিক বিশেষ বিমানে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
ভৈরবে এক জনসভায় ন্যাপ প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন,
বর্তমানে পূর্ব বাংলা আসলে স্বাধীন। আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার গঠনের অপোয়
আছি। তিনি খাজনা প্রদান বন্ধ রাখার জন্য শেখ মুজিব যে নির্দেশ দিয়েছেন তা
মেনে চলার জন্য আহ্বান জানান। এদিকে পাক স্বৈরাচাররা পূর্ব পাকিস্তানের
বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে। তারা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে থাকে।
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে পাকিস্তানের বাঘা বাঘা নেতারাও শঙ্কিত
হয়ে পড়েন। একই দিনে জমিয়াতুল ওলেমা ইসলামিয়া সংসদীয় দলের নেতা মাওলানা
মুফতি মাহমুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভা থেকে তিনটি আহ্বান জানানো হয়।
আহ্বানগুলো হলো- পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২৫ মার্চের
আগে মতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই সঙ্গে
প্রতিটি গ্রাম, শহর, বন্দর, নগরে চলতে থাকে তীব্র অসহযোগ আন্দোলন।
স্বাধীনতা-
এই একক একটিমাত্র কেন্দ্রীয় ল্য সামনে রেখে জাতি চূড়ান্ত পর্বের জন্য তখন
প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একাত্তরের উত্তাল সেই সময়ে শিা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। স্বাধীনতার স্বপে দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ।
আন্দোলন পরিচালনার মহৎ কাজে তাঁরা নিজেদের একদিনের বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত
নেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম
হয়ে রাজপথে মিছিল করে। মহান স্বাধীনতার জন্য উৎসুক, উন্মুখ বাঙালী জাতির
ভাবনা তখন ছিল একটাই পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের অচলায়তন কিভাবে ভাঙ্গা যাবে।
আগুন ঝরানো মার্চ মাসে জাতির এই প্রবল উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ এবং মাতৃভূমিকে মুক্ত
করার অদম্য আকাক্সা পরবর্তীকালে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে রূপ নেয়। চরম ত্যাগ
তিতিা রক্তের সিঁড়ি বেয়ে বাঙালী শেষ পর্যন্ত ছিনিয়ে আনে মহার্ঘ স্বাধীনতা।