আমি গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। আদালতপাড়ায় খোলা আকাশের নিচে গান গেয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু করোনার কারণে দুই বছর ধরে গানের আসর বন্ধ। জীবিকা নির্বাহ করতে পারছি না। পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে। আমি কোনো সহায়তা পাইনি।
এভাবেই কষ্টের কথাগুলো বললেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার অন্ধ বাউলশিল্পী রিয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, শুধু আমি নই; জেলার এক হাজার বাউলশিল্পীর অবস্থা একই।
শনিবার (০৫ জুন) বিকেলে জেলা বাউল কল্যাণ সমিতির মতবিনিময় সভায় দিনযাপনের গ্লানির কথা তুলে ধরেন রিয়াজ উদ্দিন। সভায় জেলার ১১ উপজেলার শতাধিক বাউলশিল্পী অংশ নেন।
বাউলশিল্পীরা জানান, জেলার এক হাজার বাউলশিল্পীর মধ্যে ১৮৭ জন সরকারি ভাতা পেয়েছেন। অধিকাংশ শিল্পী ভাতা পাননি। ২০২০ সাল থেকে তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোনও ওরস হয় না। বাউল গানের আসর বসে না। শীতকালে সুনামগঞ্জের হাওর এলাকায় শত শত বাউলশিল্পী বিভিন্ন আসরে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু পরপর দুটি শীতকাল চলে গেলেও আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হয়নি। অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের।
বাউলশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন বলেন, বাউলদের কোনও জায়গা-জমি নেই। গান গাওয়া ছাড়া অন্য কাজ জানেন না। প্রতি বছর শীতকালে একতারা, দোতারা, ঢোল, বেহালা নিয়ে গান গেয়ে অর্থ উপার্জন করেন। করোনার জন্য এখন আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ না করলে বাউল গান ও শিল্পীদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
প্রবীণ বাউলশিল্পী তছকির আলী বলেন, বাউলশিল্পীরা গানের ওপর নির্ভরশীল। এখন কোথাও গানের আসর বসে না। বাউলরা অসহায় জীবনযাপন করছেন। সরকার যে শিল্পী ভাতা দেয়; তা দিয়ে কিছুই হয় না। খুব কম সংখ্যক শিল্পী ভাতা পান।
বাউলশিল্পী উদাসী মুজিব বলেন, গান ছাড়া আমাদের চলার কোনও পথ নেই। কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। গানের আসর, ওরস মাহফিলে গান গেয়ে সংসার চলতো। এখন সব বন্ধ। তাই বাউলের প্রতি সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বাউলবিরহী রিপা বলেন, জেলায় ৭০-৮০ জন নারী বাউলশিল্পী রয়েছেন। পুরুষ শিল্পীদের পাশাপাশি তারাও আসরে, ওরসে গান পরিবেশন করে সংসার চালাতেন। তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। কষ্টে আছেন তারাও।
বাউলশিল্পী লেচু আক্তার বলেন, করোনার সময়ে কতজনকে কতভাবে সহযোগিতা করেছে সরকার। কিন্তু বাউলশিল্পীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তাদের সহায়তা প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জ জেলা বাউল কল্যাণ সমিতির সভাপতি শাহজাহান সিরাজ বলেন, জেলায় এক হাজারের বেশি বাউলশিল্পী রয়েছেন। এদের মধ্যে সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন ২০০ জন। বাকিরা পাননি। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। বাউলশিল্পীদের জন্য সরকারের বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের দাবি জানাই।
সমিতির সহসভাপতি গীতিকার মো. আসাদ আলী আল মাইজভান্ডারি বলেন, সুনামগঞ্জ বাউলের জেলা। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন হাছন রাজা, রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম, দূরবীন শাহসহ অনেক খ্যাতিমান শিল্পী। অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে সুনামগঞ্জে বাউল গানের চর্চা হয়। এজন্য বাউল সংস্কৃতি রক্ষা করতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বাউলদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাউল আল হেলাল বলেন, অনেক বাউলের থাকার ঘর নেই। আবার অনেকের ঘর তৈরির জায়গা নেই। অন্যের বাড়িতে ঘর তৈরি করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। বাউলদের সরকারি ঘর দেওয়ার দাবি জানাই।
শহরের কালীবাড়ি এলাকায় পুরাতন শিল্পকলা একাডেমির আব্দুল হাই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় ভাতাবঞ্চিত বাউলরা ভাতা ও সরকারি ঘরের দাবি জানান।
সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী বলেন, বাউলশিল্পীদের জন্য বিশেষ কোনও প্রকল্প নেই। এ পর্যন্ত ১৮৭ জন শিল্পীকে ভাতা দেওয়া হয়েছে। আরও ৭০০ জন শিল্পীকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। সরকার যদি বাউলশিল্পীদের জন্য আলাদা কোনও প্রকল্প গ্রহণ করেন, তাহলে অবশ্যই সহযোগিতা পাবেন।