প্রভাষ আমিন ||
আরিয়ান
খানের ছবি দেখে প্রথমে আমি চিনতে পারিনি। ভেবেছিলাম শাহরুখ খানের
ছেলেবেলার ছবি। পরে এক সেলফিতে দুই খানকে একসাথে দেখে ভুল ভাঙে। বাবার সাথে
ছেলের চেহারার অনেক মিল থাকে। কিন্তু তাই বলে এমন মিল বিস্ময়জাগানিয়া।
কিন্তু চেহারায় এই অদ্ভুত মিল থাকলেও আর কিছুতেই মেলে না দুই খানের।
শাহরুখ
খান এক সংগ্রামী মানুষের গল্প। আর আরিয়ান খান সোনার চামচ মুখে নিয়ে
জন্মানো এক রাজপুত্র। শাহরুখ খান দিল্লীর মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবাকে
হারিয়েছেন আগেই। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেন মা। কলেজে থাকতে শাহরুখ
খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইনজুরির কারণে সে স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়।
এরপর শাহরুখ অভিনয়ে মন দেন। টুকটাক টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করছিলেন। এমন সময়
মায়ের মৃত্যু তাকে পাল্টে দেয়। শোককে শক্তিকে পরিণত করে তিনি সিনেমায় অভিনয়
করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় শূন্য পকেটে, চোখ ভরা স্বপ্ন সম্বল করে দিল্লী
থেকে মুম্বাই পাড়ি জমান তিনি।
শাহরুখের গল্পটা মোটেই এলাম, দেখলাম, জয়
করলাম’এর নয়। কঠিন সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে বলিউডে নিজের অবস্থান শক্ত করতে
হয়েছে তাকে। মুম্বাইয়ে তার থাকার জায়গা ছিল না। খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না।
বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা যা নিয়ে এসেছিলেন, সব তখন শেষ। হতাশ সেই ছেলেটা একদিন
মুম্বাইয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, 'এই শহরটা আমার সবকিছু
কেড়ে নিয়েছে, আমাকে শেষ করে দিয়েছে একদম! একদিন আমি এই শহরটাকে দেখে নেব,
এই শহরের রাজা হব আমি!' শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছেন শাহরুখ খান। তাকে বলা হয়
কিং খান, বলিউডের বাদশাহ।
আরব সাগরের পাড়ে বেঞ্চে বসে পাশের সুরম্য ভবন
দেখে স্বপ্ন দেখেছিলেন, একদিন এখানেও তার বাড়ি হবে। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে
মাত্র এক দশক লেগেছে। সেই আরব সাগরের পাড়েই শাহরুখ খানের ২০০ কোটি দামের
বাড়ি ‘মান্নাত’এখন মুম্বাইয়ের পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। মুসলমান শাহরুখ খান
ভালোবেসে বিয়ে করেছেন হিন্দু গৌরী খানকে। তাদের প্রেম কাহিনীও সিনেমাকে হার
মানায়। আরিয়ান খান, সুহানা খান আর আবরাম খানকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। বড়
কোনো স্ক্যান্ডালের ঝড়ও নেই সংসারে। শাহরুখ খানের জীবনের পাত্র অর্জনে
উপচেপড়া। স্বীকৃতি, পুরস্কার, অর্থ, বিত্তের কমতি নেই। যা চেয়েছেন তাই
পেয়েছেন।
শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অভিনেতা শাহরুখ খান। তার
সম্পদের পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পাহাড় সমান এই অর্থ আজ অর্থহীন।
সাধের রাজপ্রাসাদ ‘মান্নাত’ আজ তার জন্য কারাগার। গত ২ অক্টোবর থেকে এই
মান্নাতেই নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করে রেখেছেন কিং খান। সব শ্যুটিং বন্ধ।
ঘুম-খাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ তার প্রিয় সন্তান আরিয়ান খান এখন
মুম্বাইয়ের আর্থার রোড কারাগারের ৯৫৬ নাম্বার কয়েদি। থাকতে হচ্ছে সাধারণ
কয়েদির মতই।
গত ২ অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন আরিয়ান খান। থাকতে হবে
অন্তত ২০ অক্টোবর পর্যন্ত। সেদিন তার পরবর্তী জামিন শুনানী হবে। ৫ হাজার
কোটি টাকার মালিক শাহরুখ খান তার সন্তানের জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা পাঠাতে
পেরেছেন। কারাগারে থাকাকালে একজন কয়েদিকে প্রতিমাসে তার পরিবার সর্বোচ্চ
এই টাকাটাই পাঠাতে পারেন। এই টাকায় কারাগারের ক্যান্টিন থেকে কিনতে পারবেন
কেক, বিস্কুটের মতো শুকনো খাবার। কারাগারের খাবার খেতে পারছেন না আরিয়ান
খান। ক্যান্টিন থেকে কেনা বিস্কুট খেয়ে থাকতে হচ্ছে বলিউডের কিং খানের
ছেলেকে। ছেলেকে মুক্ত করতে শহরের সবচেয়ে দামি উকিল নিয়োগ করেছেন শাহরুখ
খান। কিন্তু জামিন মেলেনি। করোনার কারণে এখন কয়েদিদের সাথে স্বজনদের সরাসরি
দেখা-সাক্ষাত বন্ধ। ভিডিও কলে শাহরুখ-গৌরী একবার আরিয়ানের সাথে কথা বলতে
পেরেছেন। যার বেশিরভাগ সময় কেটেছে কেঁদে।
শাহরুখ পুত্র আরিয়ান কেন
কারাগারে? এই প্রশ্নের উত্তর সবাই এতদিনে সবাই জেনে গেছেন। গত ২ অক্টোবর
মুম্বাই থেকে গোয়াগামী একটি বিলাসবহুল জাহাজ থেকে আরিয়ান খান এবং তার
বন্ধুদের আটক করে মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো। করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাদক
ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। একাধিক শুনানিতেও জামিন মেলেনি আরিয়ানের। বরং
আন্তর্জাতিক মাদক চক্রের সাথে যোগসাজশের অভিযোগে মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরো
বারবার জামিনের বিরোধিতা করছে, আর তাতেই প্রলম্বিত হচ্ছে আরিয়ানের কারাবাস।
আরিয়ান
খান গ্রেপ্তারের পর বলিউডের অনেকেই শাহরুখ খানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সালমান
খান একাধিক দিন ছুটে গেছেন মান্নাতে। অনেকেই তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে
বলছেন, আসলে আরিয়ান নয়, মূল টার্গেট শাহরুখ খান। অনেকে বলছেন, ধর্মীয়
পরিচয়ের কারণেই শাহরুখকে টার্গেট করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, লঘুপাপে গুরুদণ্ড
পাচ্ছেন আরিয়ান। গ্রেপ্তারের পর জামিন পেতে পারতেন তিনি। যে যাই বলুন,
আপাতত ২০ অক্টোবর পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত কারাগারেই থাকতে হচ্ছে তাকে।
শাহরুখ
খানের সংগ্রামী জীবন বা আরিয়ান খানের মাদককাণ্ড বা ভারতের বিচার ব্যবস্থা
এই লেখার বিষয় নয়। গ্রেপ্তারের পর এক জবানবন্দীতে আরিয়ান বলেছেন, ‘আমার
বাবা শাহরুখ খান অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন। এই মুহূর্তে একসঙ্গে তিনটি
ছবির শ্যুটিং করছেন উনি। আর বাবা এতটাই ব্যস্ত যে অনেক সময় ওনার সঙ্গে
দেখা করার জন্য ম্যানেজার পূজার কাছে আমায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়।’
আরিয়ানের এই জবানবন্দী আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমার পিতা শাহরুখ
খানের জন্য করুণাই হচ্ছে।
সেই গল্পটা আপনাদের সবার জানা। শহুরে বাবু
গ্রামে গেছেন। নৌকায় নদী পার হচ্ছেন আর মাঝির সাথে গল্প করছেন। তিনি মাঝিকে
নানান প্রশ্ন করছেন, যার কিছুই মাঝির জানা নেই। বাবু খুব অবাক হলেন। একটি
একটি অজ্ঞতায় মাঝিকে ভর্ৎসনা করে বলতে লাগলেন, তোমার জীবন চার আনা মিছে, আট
আনা মিছে, বারো আনা মিছে। একটু পর ঝড় এলো। নৌকা দুলতে লাগলো, ভয়ে কাঁপতে
লাগলেন শহুরে বাবুও। মাঝি তখন জানতে চাইলেন, বাবু আপনি সাঁতার জানেন? বাবু
বললেন, না। এবার মাঝি শান্ত গলায় বললেন, তাহলে তো আপনার জীবন ষোল আনাই
মিছে।
শাহরুখ খানের ঝুলিতে অনেক খ্যাতি, অনেক সম্মান, অনেক পুরস্কার,
অনেক গাড়ি, অনেক বাড়ি। কিন্তু তার সন্তান যখন মাদককাণ্ডে কারাগারে; সন্তান
যখন বলে, বাবার সাথে দেখা করতে তাকে সেক্রেটারির কাছ থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট
নিতে হয়; তখন আসলে শাহরুখ খানের জীবন ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়। পিতার কাছে
পরাজয় ঘটে কিং খানের। ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ দিয়ে শাহরুখ কী করবেন?
সন্তানের জন্য তো পাঠাতে পেরেছেন মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা!
আমরা
সন্তানদের সময় দিতে পারি না বলে, তাদের অনেক অন্যায় আবদার মেনে নেই। নিজের
অপরাধবোধ ঢাকতে নিজের অজান্তেই সন্তানকে বিপথে ঠেলে দিই। আর পরে সন্তানের
কাছে কৈফিয়ত চাই, তোমার তো কোনো অভাব রাখিনি, তাহলে এমন হল কেন? আমরা
বুঝতেই চাই না, সন্তানের চাহিদা তো টাকা নয়, মমতা। আমরা কি সবাই বুকে হাত
দিয়ে বলতে পারব, সন্তানের প্রতি আমরা আমাদের সত্যিকারের দায়িত্ব পালন
করেছি? প্রতিদিন কি আমরা সন্তানের সঙ্গে কথা বলেছি? সে কোথায় যায়, কার
সঙ্গে মেশে, সে কীভাবে বেড়ে উঠছে, খোঁজ নিয়েছি? তার চাওয়া-পাওয়া নিয়ে
ভেবেছি? আমরা খালি আত্মতৃপ্তি খুঁজি, আমার সন্তানকে তো আমি ভালো স্কুলে
ভর্তি করিয়েছি, ভালো টিচারের কাছে পড়িয়েছি, ভালো পোশাক কিনে দিয়েছি, ভালো
খাইয়েছি। তাহলে সন্তান কেন খারাপ রেজাল্ট করে, কেন মাদকাসক্ত হয়, এই
প্রশ্নের উত্তর আর মেলাতে পারি না। শাহরুখও আরিয়ানের কোনো অভাব রাখেননি।
বিদেশে ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন। দামি গাড়ি, দামি মোবাইল কিনে দিয়েছেন। কিন্তু
একজন পিতা হিসেবে সন্তানকে সময় দেননি। আজ তাই তার সকল অর্থ অর্থহীন মনে
হচ্ছে। এই যে আমরা এত পরিশ্রম করি, এত অর্থ উপার্জন করি কেন, কার জন্য?
শাহরুখের এত অর্থ কে খাবে?
সব শিশুই পৃথিবীতে আসে নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ
দেবশিশু হিসেবে। তারপর বড়দের মানে আমাদের ভণ্ডামি, কূপমণ্ডুকতা, হিংসা,
লোভ, লালসা, ক্যারিয়ার ভাবনা, ব্যস্ততা বদলে দেয় তাদের পৃথিবী। আস্তে আস্তে
সভ্যতার অন্ধকার দিকগুলো গ্রাস করে তাদেরও। আপনার নিষ্পাপ দেবশিশু কীভাবে,
কবে মাদকের অন্ধকার জগতে পা বাড়াল, আপনি জানতে পারলেন না কেন? ভালো মন্দ
বোঝার বয়স তো তার হয়নি। একটি শিশু কিন্তু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না।
আমরাই তাকে আনি। তাই তাকে আগলে রাখা, ঠিকমত বড় করে তোলার দায়িত্ব তো
আপনার-আমার, আমাদের।
শুধু সাফল্য বা ক্যারিয়ারের পেছনে না ছুটে
সন্তান-সংসারের জন্য কখনও কখনও আপনাকে অনেক ত্যাগও স্বীকার করতে হবে, আপোস
করতে হবে, মেনে নিতে হবে। আপনার অনেক টাকা হল, অনেক ক্ষমতা হল, অনেক নাম
হল; কিন্তু আপনার সন্তান বখে গেল। সেই টাকা আপনার কাছে অর্থহীন হয়ে যাবে,
ক্ষমতা পানসে মনে হবে, নাম ভুলে যেতে চাইবেন।
শাহরুখ শুধু একজন ভালো
অভিনেতা নন, একজন ভালো ব্যবসায়ীও। রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট নামে তার একটি
ব্যবসা সফল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আছে। আইপিএল’এর দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের
মালিকানাও শাহরুখের। ক্যারিবীয় লীগেও তার একটি দল আছে। তিনি অনেক বিনিয়োগ
করেছেন। কিন্তু সন্তানের পেছনে বিনিয়োগ করার মত একটু সময় তার কাছে ছিল না।
আরিয়ানের
বয়স মাত্র ২৩। এখনও সব ফুরিয়ে যায়নি। ভুলের ফাঁদে পা দিয়েছেন। এখনও তার
সামনে বিশাল সম্ভাবনার পৃথিবী রয়ে গেছে। কিং খান যদি এবার পিতা শাহরুখ খান
হয়ে ওঠেন, সংসার-সন্তানের পেছনে আরো বেশি বিনিয়োগ করেন; তাহলেই সবার মঙ্গল।
আর কিং খানের এই পরাজয় থেকে যদি আমরা সবাই শিক্ষা নেই, তবেই আমাদের
ভবিষ্যৎ আলো ঝলমলে হবে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ