
তানভীর দিপু:
প্রায়
২৫ বছর বয়সী বট গাছ। যে গাছের ছায়ায় মানুষ-পশুপাখি বিশ্রাম নেয়ার কথা-সেই
গাছ এখন বিশ্রাম নিচ্ছে টবে। প্রায় শত ফুট উচ্চতার বাঁশঝাড় শোভা পাচ্ছে
হাতে তুলে নেবার মত পাত্রে। প্রাপ্ত বয়স্ক তুলা, চন্দন, কৃষ্ণচূড়া গাছ দুই
হাতে দু’টি তুলেই অনায়াসে হাঁটা যায়। টবে রাখা গাছের অবয়বে ফুটে উঠেছে মহান
আল্লাহ- নবী মুহম্মদ(স:) এর নাম। শক্তকান্ডের দীর্ঘজীবী নানা গাছের
বনসাইয়ের এক কৃত্রিম অরণ্য তৈরী করেছেন কুমিল্লার শুভপুর এলাকার
বৃক্ষপ্রেমি হাসান ফিরোজ। এক ছাদের উপর আছে ২৩০টি বৃক্ষের বনসাই।
বাগান
করার শখ থেকেই শুরু বনসাই সংগ্রহ ও উৎপাদন। ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করে এই
পর্যন্ত ২৩০ টি উদ্ভিদের পূর্নাঙ্গ বনসাই পরিচর্যা করে আসছেন বাংলাদেশ
টেলিভিশনের সাবেক পরিচালক হাসান ফিরোজ। বর্তমানে হাসান ফিরোজের কুমিল্লা
শহরের শুভপুরের বাড়ির ছাদে গেলে মনে হয় যেন- এক বনসাইয়ের অরণ্য। দুই তলা
বাড়ির এই ছাদের রেলিং, কার্নিশ আর পুরো ছাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তুলা,
কৃষ্ণচুড়া, চন্দন, অর্জুন, অশ্বথ, ঝাউ, বাঁশ, কাঁঠালি বট, কৃষ্ণ বট, বাকুর,
এডোনিয়ামসহ নানান দেশি-বিদেশী প্রজাতির গাছ। একটি একটি গাছের বয়স ১০ থেকে
৩৫ বছর হলেও বনসাইয়ে রূপ দেয়া গাছ গুলো শৈল্পিক ভাবে শোভা পাচ্ছে ছোট ছোট
টবেই। কবরস্থান, বাড়ির দেয়াল কিংবা রাস্তার পাশ থেকে তুলে আনা গাছের চারা
দিয়েই তৈরী করা হয়েছে নজর কাড়া বনসাই। একাধারে লেখক ও বনসাই প্রেমী হাসান
ফিরোজ জানান, সবার চেয়ে আলাদা শখ বেছে নেয়ার তাড়া থেকেই বনসাই নিয়ে কাজ করা
শুরু। ১৯৭৫ সালের দিকে চায়না থেকে আসা একটি বনসাইয়ের ফসিল দেখে আমার মধ্যে
এই বনসাই নিয়ে আগ্রহ জাগে। এরপর আমি বাগান করা শুরু করি। মূলতঃ ১৯৮৬ সালের
দিকে শুরু করি বনসাই সংগ্রহ ও পরিচর্যা। পরে বনসাই উৎপাদনেও নজর দেই।
সহোদরা
নামে শুভপুরের ওই বাসার ছাদে শুধু উদ্ভিদ হিসেবে বনসাই তৈরী করা হয়নি। করা
হয়ছে আরবি হরফে আল্লাহু, মুহম্মদ(সঃ) এর ক্যালিওগ্রাফি। এছাড়া বিভিন্ন
খেলোয়াড়েড়র প্রতিকৃতি ছাড়াও মানুষ ও জীবজন্তুর আকৃতি দিয়েও পরিচর্যা করা
হচ্ছে গাছগুলোকে। সকাল বিকাল এসব গাছে পানি ও সার দেয়া ছাড়াও এসব গাছের
ডাল-পাতা ছাটাই করার কাজ একাই করে থাকেন হাসান ফিরোজ। মাঝে মধ্যে তার বন্ধু
ও ভাই সঙ্গ দেন এই কাজে। হাসান ফিরোজ জানান, দীর্ঘ দিন এই বনসাই নিয়ে কাজ
করা খুবই মধুর। বৃক্ষপ্রেমিক যদি গাছের কাছাকাছি থাকে তার কি যে ভালো লাগে
তা বলে বোঝানো যাবে না। যেখানে আমরা পারিপার্শ্বিক অবস্থানের কারণে নানান
দুঃসময় পার করে থাকি এসময় এই বনসাইয়ের সঙ্গ খুবই আনন্দদায়ক। গাছ যেমন
পরিবেশের জন্য ভালো-তেমনি মন মানসিকতা চাঙ্গা রাখে।

চন্দন, অশ্বথ,
তুলা, কৃষ্ণচূড়ার মত গাছের ব্যাতিক্রমী বনসাই তৈরী করেছেন হাসান ফিরোজ।
নিজের নিরলস প্রচেষ্টায় এসব অমূল্য বনসাইগুলোকে লালন পালন করছেন সন্তানের
মত। বনসাই প্রেমিকদের উদ্দেশ্যে হাসান ফিরোজ জানান, যারাই বনসাই করতে চান
তারা যেন আগে গাছ নির্বাচনে ভুল না করেন। সঠিক গাছ নির্বাচন করা গেলে একটি
সফল এবং পূর্ণাঙ্গ বনসাই তেরী করা সম্ভব। তবে এজন্য ধৈর্য্য ধারন করতে হবে
অনেক। দীর্ঘজীবী গাছ বাছাই করতে হবে। যে সব গাছের পাতাছোট সে গাছ গুলো
বনসাইয়ের জন্য বাছাই করলে ভালো।
২০০৩ এবং ২০০৬ সালে চট্টগ্রামে হাসান
ফিরোজের একক বনসাই প্রদর্শণী হয়েছে। তার এই বিশাল সংগ্রহ এখন শুধু নিজের
তৃপ্তি মেটানোর জন্যই। ভবিষ্যতে এসব বনসাই তিনি রেখে যেতে চান কোন
নির্ভরযোগ্য হাতে। বনসাইয়ের এই সংগ্রহে যে বিশাল অর্থ এবং সহযোগিতার
প্রয়োজন তা পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হত না বলে জানালেন। তবে যতদিন
বেঁচে থাকবেন ততদিন এই বনসাইয়ের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে চান এই নিবিড় বনসাই
প্রেমী।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান
বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক মেহেরেুন্নেছা বলেন, বনসাই হলো জীবন্ত ভাস্কর্য। এই
বনসাই তৈরী ও পরিচর্যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশের জন্য খুবই
উপযোগী। এছাড়া এর অর্থনৈতিক মূল্যও বেশ আছে। একজন লেখক ও টেলিভিশন
ব্যাক্তিত্ব হাসান ফিরোজ নিজ প্রচেষ্টায় বনসাইয়ের যে বিশাল অমূল্য সংগ্রহ
গড়ে তুলেছেন সেজন্য তাকে অভিবাদন। তার এই সংগ্রহ নিয়ে উদ্ভিদ বিদ্যায়
আগ্রহীরা গবেষণাও করতে পারেন। অদম্য আগ্রহ এবং ধৈর্য্যের অধিকারী না হলে
এমন সংগ্রহ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমরা আশা করি কৃষি বিভাগ কিংবা সামাজিক বন
বিভাগ তার এই বনসাইকে অনন্য সংগ্রহ বলে স্বীকৃতি দিতে পারেন।