নৌপথ
কিংবা সড়কপথ, কোনোটাই নিরাপদ নয়। গত বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটায় ঝালকাঠির
কাছে সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০-এ আগুন লেগে ৩৮ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আবার
তা প্রমাণিত হলো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন
ব্যক্তিরা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। সে ক্ষেত্রে মৃত মানুষের সংখ্যা আরও বাড়তে
পারে। দুর্ঘটনার পর লঞ্চটি সম্পর্কে যেসব তথ্য বেরিয়ে এল, তা খুবই
উদ্বেগজনক। লঞ্চটির ইঞ্জিন বদল করা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে;
ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন করা হয়েছিল, ইঞ্জিনে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে
লঞ্চটি পাড়ে না ভিড়িয়ে চালক চালিয়ে যাচ্ছিলেন। লঞ্চে যে অগ্নিনির্বাপণের
ব্যবস্থা ছিল, তা-ও অপ্রতুল। ছবিতে দেখা যায়, পুরো লঞ্চটিই পুড়ে গেছে,
কঙ্কালের মতো কাঠামো কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা,
আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটি কূলে ভেড়ানো সম্ভব হলে ক্ষয়ক্ষতি ও
প্রাণহানি অনেক কম হতো।
ফায়ার সার্ভিসের বরিশাল বিভাগের মতে, লঞ্চটির
ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, রাত পৌনে একটায় বরিশাল নৌবন্দর ত্যাগ করার পর
লঞ্চটির পুরো ডেক উত্তপ্ত হয়ে যায়। শীত ও কুয়াশার কারণে ডেকের চারপাশ
ত্রিপল দিয়ে আটকানো ছিল। রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠি স্টেশন থেকে
দেউড়ী এলাকায় আসতেই আগুন লাগে। কিছুটা দূরে এলে ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায়
এবং পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে।
ফিটনেস সনদ অনুযায়ী, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি
২০১৯ সালে নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ৬৪ মিটার ও গভীরতা ২ দশমিক ৮০ মিটার।
লঞ্চটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০১-২৩৩৯। কেবল অভিযান-১০ নয়, সব রুটে সব লঞ্চই
অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে থাকে। বেশি মুনাফার আশায় প্রায় প্রতিটি রুটে
মালিকেরা রেশনিং পদ্ধতিতে লঞ্চ পরিচালনা করে থাকেন। কোন কোম্পানির লঞ্চ কোন
দিন চলবে, তা তাঁরাই ঠিক করেন; কর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকে না। আরও
উৎকণ্ঠার বিষয় হলো, জরুরি সেবা ৯৯৯-এ টেলিফোন করে সহায়তা চাইলেও সকালের আগে
অগ্নিনির্বাপণ বাহিনী সেখানে যায়নি। স্থানীয় বাসিন্দারাই জীবনের ঝুঁকি
নিয়ে নদী ও লঞ্চ থেকে লোকজনকে উদ্ধার করেছেন। তাঁরা প্রমাণ করলেন, মানুষ
মানুষের জন্য।
এর আগে বিভিন্ন রুটে লঞ্চ ডুবে বহু প্রাণহানি হয়েছে।
এমনকি অন্য বাহনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে লঞ্চডুবির ঘটনাও কম নয়। কিন্তু অতীতে
কোনো লঞ্চে আগুন লেগে এত বেশি মানুষ মারা যাননি। একটি লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন
লাগার পরও চালকের সেটি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল হঠকারী ও আত্মঘাতী।
সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু তদন্তে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে কি
না, সে বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। অতীতে এ ধরনের তদন্ত কমিটির ফল জনগণকে
জানতে দেওয়া হয়নি; দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও কম।
যাঁদের
অবহেলা ও অবিমৃশ্যকারিতার জন্য অভিযান-১০-এ এত লোক মারা গেলেন, তাঁদের আইন
ও শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। সেই সঙ্গে নিহত যাত্রীদের পরিবারকে উপযুক্ত
ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।