ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন আইন চাই
Published : Thursday, 27 January, 2022 at 12:00 AM
বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন আইন চাইবিভুরঞ্জন সরকার ||
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল ২০২২’ উত্থাপন করার পর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে ওই কমিটি। বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানালেও তা টেকেনি। কণ্ঠভোটের মাধ্যমে বিলটি উত্থাপনের অনুমতি পান আইনমন্ত্রী।
হারুনুর রশীদ ‘এ আইন প্রশ্নবিদ্ধ’ উল্লেখ করে বলেন, এ আইন দিয়ে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে না। তিনি বিলটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। আইনমন্ত্রী তার বক্তব্যের জবাবে বলেছেন, ‘কোথাও এ রকম স্বচ্ছভাবে ইসি গঠন করার পদ্ধতি নেই। এ আইন হলে এবং এর মাধ্যমে ইসি গঠিত হলে বিএনপি চুরি করতে পারবে না। এ জন্য তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।’
সংবিধানে একটি আইনের মাধ্যমে ইসি গঠনের কথা থাকলেও গত ৫০ বছরে তা হয়নি। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগেই এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের দাবি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে তোলা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এত অল্পসময়ে এবার আইনটি করা সম্ভব হবে না। একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবারও ইসি গঠন করবেন। কিন্তু এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। বিএনপিসহ কয়েকটি দল আলোচনার ডাকে সাড়া না দিলেও আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে তাদের মত জানিয়েছে।
১৬ জানুয়ারি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে সরকারের কয়েক মন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। সেখানে কূটনীতিকরা আইনের মাধ্যমে ইসি গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন বলে গণমাধ্যম খবর বের হয়েছে। পরের দিন আকস্মিকভাবেই আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের খবর জানা যায়। একই দিন বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আইনের মাধ্যমে ইসি গঠনের প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। হঠাৎ করে সরকারপক্ষের মত বদলের পেছনের কারণ কেউ কিছু বলতে না পারলেও এটা মনে করা হয় যে, সরকার বিরোধীপক্ষের হাতে কোনো ইস্যু তুলে দিতে চায় না। নির্বাচন কমিশন আইন নিয়ে বিএনপিসহ অন্য কেউ যাতে মাঠ গরম করতে না পারে, এ জন্যই হয়তো সবাইকে অন্ধকারে রেখে এ আইনের দিকে পা বাড়ায় সরকার। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে, ইস্যু তুলে না দিতে চেয়ে সরকার কি আসলে ইস্যু তুলে দিল না?
সরকার যেহেতু চায় এবং সংসদে সরকারের রয়েছে একচেটিয়া আধিপত্য, সেহেতু আইন পাসে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। সংসদের চলতি অধিবেশনেই বিলটি পাস হয়ে আইনে পরিণত হবে এবং এ আইনেই পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। এতে সংকট যে কাটবে না, তা এই আইনের পথে সরকারের হাঁটার খবর জানার পর থেকে বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। আগে সরকারপক্ষ বলেছে আইন প্রণয়নে তাড়াহুড়া না করার কথা। এখন অন্যরা বলছে তাড়াহুড়া না করতে। কেউ বলছেন, সরকারের উদ্দেশ্য ‘ভালো নয়’ আবার কারও কথাÑ এর পেছনে সরকারের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে। কথা একই। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে একতরফা আইন করে ফেললে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ নিয়ে বিতর্ক থাকবে। তবে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অন্যদের ন্যায়সঙ্গত বক্তব্য নাকচ করার নীতি পরিহার করলে ভালো হবে। ন্যায্য কথা ক্রমাগত উপেক্ষা করলে সাধারণ মানুষও বিষয়টি সহজভাবে নেয় না।
একমত হয়ে আইন তৈরির বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশে আছে কিনা, এ প্রশ্ন আসতে পারে। আওয়ামী লীগের তৈরি আইন বিএনপির কাছে ফাঁদ মনে হবে আবার বিএনপির প্রস্তাবকে আওয়ামী লীগ দুরভিসন্ধিমূলক বলেই মনে করবে। এ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দল কোনো ইস্যুতে একমত হতে পারবেÑ এটি এখন কোনো অতিআশাবাদী মানুষও বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তন করা তো রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই দায়িত্ব। স্রোতে ভাসা আর কত?
বিএনপিদলীয় এক নারী সংসদ সদস্য বলেছেনÑ নির্বাচন কমিশনে যদি পাঁচজন ফেরেশতাও বসানো হয়, তা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতাÑ এতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচনকালীন সরকার। এ জন্যই বিএনপি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়ে রেখেছে। আগামী ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। এই সময়ের মধ্যে সরকার পরিবর্তনের কোনো আশঙ্কা বা সম্ভাবনা কোনো রাজনৈতিক জ্যোজিষী দেখছেন কি? বিএনপি কি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, এই সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটিয়ে তাদের পছন্দের সরকারের অধীন নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে পারবে?
নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে যে আইনের কথা উল্লেখ আছে, ওই আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করলেই যে নির্বাচন ভালো হবেÑ এর কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেটি এখন বিএনপির কেউ কেউ বলছেন। একটি নির্বাচন ভালো হবে কিনা, তা নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা আর নির্বাচন কমিশনের ওপর। সংবিধানে তাদের অনেক ক্ষমতা দেওয়া আছে। তারা যদি এই ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার করেন, তা হলে যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে বাধ্য। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ব্যক্তিগত দৃঢ়তার বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারতের টিএন সেশনের মতো দাপুটে নির্বাচন কমিশনার কি আর কেউ হতে পেরেছেন? আমাদের দেশেও এটিএম শামসুল হুদা আর কেএম হুদার ব্যক্তিত্ব কি এক? এত আয়োজনের শেষে এবার কাদের নিয়ে, কেমন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় দেখা যাক। তার পর আসবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রসঙ্গ।
আন্দোলন করে কিছু আদায়ের অভিজ্ঞতা বিএনপির নেই। ২০০৬ সাল থেকে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও এর মিত্ররা ক্ষমতার বাইরে আছে। ক্ষমতায় থেকে যে দলটি গঠিত হয়েছিল, ওই দলটির এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা অস্বাভাবিক সত্য। অন্যদিকে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপসহীন নেত্রীর ইমেজ এখন একেবারে ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে ম্লান হয়েছে। তিনি দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত। বর্তমানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় করোনার কারণে মুক্ত হয়ে পরিবারের সঙ্গে আছেন। তিনি নানা রোগে আক্রান্ত। পছন্দসই হাসপাতালে নিজের বাছাই করা চিকিৎসকদের অধীন চিকিৎসাও নিচ্ছেন। অন্যদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে সপরিবারে পলাতক জীবনযাপন করছেন। এই অবস্থায় শুধু কিছু অন্ধ সমর্থকÑ যারা আবার কোনো ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী, তাদের ওপর ভর করে সরকার পতনের আন্দোলনে কামিয়াব হতে পারবে কি বিএনপি?
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। এই সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হয়েছে। একই সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘হাসি ম্যাজিক’। আওয়ামী লীগ দল থেকে বিতর্কিত ও নিন্দিত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সৎ, জনসম্পৃক্ত ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হলে নারায়ণগঞ্জের অবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। দেশের মানুষ সাধারণত সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে না।
২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই বিএনপি ও এর দোসররা আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অপতৎপরতা কিছু কম করেনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া, পদ্মা সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে অনেক কিছুই শেখ হাসিনা করেছেন তার মনোবল ও জনসমর্থনের জোরে।
এখন র‌্যাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রযোগের কৌশল নিয়েছে। কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাও তৎপর। চাপ দিয়ে শেখ হাসিনাকে টলানো সহজ নয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে আমেরিকা ও এর শিষ্য-সাগরেদদের খুব সুবিধা হবে কি? আমেরিকার ত্রাস জঙ্গি ও সন্ত্রাসীরা কোন শাসনে নিরাপদ বোধ করে, সেটি কি তাদের জানা নেই? বিএনপি-জামায়াতের আমলনামা একবার সামনে নিয়ে দেখতে পারেন তারা। শান্তি, স্থিতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শেখ হাসিনা যতটা নিশ্চিত করতে পারবেন, বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে তা সম্ভব কিনা- সেটি ভাবতে হবে নির্মোহভাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক