রোজার আগে আবারও বাড়লো নিত্যপণ্যের দাম
Published : Saturday, 5 March, 2022 at 12:00 AM
আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে টানা ছয় মাস ধরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছেই চলেছে। বিশেষ করে পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে কয়েকদফায় দাম বেড়েছে নিত্যপণ্যের। এর ফলে রোজা শুরু হওয়ার আগেই অধিকাংশ পণ্যের দাম সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে বলে মনে করেন ভোক্তারা।
চলতি সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি কেজিতে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১২ টাকার মতো। সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ।
রাজধানীর মানিকনগর এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘গত সপ্তাহে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ৫০ টাকায় কেনা সম্ভব হয়েছে। এ সপ্তাহে একই মানের এক কেজি পেঁয়াজ কিনতে ৬২ টাকা লাগছে।’ তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে যে পেঁয়াজ ৪৫ টাকায় পাওয়া গেছে, এ সপ্তাহের সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।আর ব্যবসায়ীরা বাছাই করা পেঁয়াজের কেজি ৬৫ টাকায় বিক্রি করছেন।’ পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা পাইকারিতে ৫৭ টাকা করে কিনছেন। গোপিবাগ রেলগেট সংলগ্ন ব্যবসায়ী কিসমত আলী বলেন, ‘দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কম। এ কারণেই পেঁয়াজের দাম বেড়েছে।’
রাজধানীর বাজারগুলোতে ৫ লিটারের বোতল জাত সয়াবিন তেলের দাম রাখা হচ্ছে ৮৩০ টাকা করে। গত সপ্তাহে একই ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৭৯০ টাকা দরে। ৭৬০ টাকা দামের বোতল বিক্রি হচ্ছে ৭৯০ টাকা দরে। আর এক লিটার ওজনের বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫ টাকার মতো।
খোলা বা লুজ পামঅয়েলের দাম রাখা হচ্ছে ১৫৫ টাকা লিটার। গত সপ্তাহে এই ভোজ্যতেল বিক্রি হয়েছে ১৪০ লিটার। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পামঅয়েলের দাম বেড়েছে লিটারে ১৫ টাকার মতো। আর যে পামওয়েল গত সপ্তাহে ১৪৭ টাকা লিটার বিক্রি হয়েছে, এ সপ্তাহে একই মানের পামওয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৫৮ লিটার।
গত সপ্তাহে ১৫০ টাকায় এক লিটার পামওয়েল সুপার পাওয়া যেত। এ সপ্তাহে একই পরিমাণ সুপার পামওয়েল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা লিটার। গত সপ্তাহে যে পামওয়েল বিক্রি হয়েছে ১৫৫ টাকা। এখন সেই একই পামওয়েল সুপার বিক্রি হচ্ছে ১৬৩ টাকা লিটার।
দুই-তিন মাস আগেও ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে খোলা ময়দা। এখন সেই খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার ওপরে। গত এক সপ্তাহে খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। গত সপ্তাহে ময়দা বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা কেজি।
চিনির দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে বেশকিছু দিন ধরে। নতুন করে এই পণ্যটির দাম কেজিতে ৩ টাকার মতো বেড়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮২ টাকা কেজি দরে। সরকারি বিপণন সংস্থাটি টিবির তথ্য বলছে, গত সপ্তাহে যে চিনি ৭৫ টাকায় কেজি পাওয়া গেছে, এখন সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৮ টাকা কেজি দরে।
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকার মতো। অর্থাৎ গত সপ্তাহে যে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা কেজি দরে, এখন সেই একই মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ টাকা কেজি দরে। আর সোনালি মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৯০ থেকে ৩২০ টাকা। গরুর মাংস গত সপ্তাহের মতো ৬৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির ডিমও গত সপ্তাহের মতো ১১৫ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, এখন সব চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বরবটি। এ সবজিটি কিনতে ক্রেতাদের কেজিপ্রতি ব্যয় করতে হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা। বাজারে নতুন আসা ঢেঁড়শের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা। আর ভালো মানের করলার কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। একটু নিম্নমানের করলা প্রতি কেজি ৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ১৫ টাকায় বিক্রি হওয়া আলুর কেজি এখন ১৮ টাকা। গত সপ্তাহে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া পাকা টমেটোর দাম বেড়ে হয়েছে এখন ৬০ টাকা। ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা প্রতি পিস। শিমের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। শালগমের (ওলকপি) কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। বেগুনের কেজি ৫০ থেকে ৭০ টাকা। গাজরের কেজি ৩০ টাকা। মুলার কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। লাউ প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। লালশাকের আঁটি ১০ থেকে ১৫ টাকা, পালং শাকের আঁটি বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। কাঁচকলার হালি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। সপ্তাহের ব্যবধানে এসব সবজির দামে পরিবর্তন আসেনি।
কাতল ও রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৪৫০ টাকা। শিং ও টাকি মাছের কেজি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। শোল মাছের কেজি ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকা। তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছের কেজি ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। নলামাছ ১৭০ থেকে ২০০ টাকা কেজি। চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি।
এককেজি ওজনের ইলিশ মাছের দাম এখন ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা। ছোট ইলিশ মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির জন্য সাতটি কারণ তুলে ধরেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। এগুলো হলো— চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি, সরবরাহে ঘাটতি, পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকা এবং দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা, আমদানি মূল্য, পরিবহন খরচ ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারের ঊর্ধ্বগতি, বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি।
সেলিম রায়হান বলেন, ‘শুধু প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নয়, নিম্ন-মধ্যবিত্তও অনেক চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্যকিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ। যারা কোভিডকালীন অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন, তারা আবারও সংকটে পড়ছেন।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির দাবি, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ। যদিও গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিবিএস যে হিসাব প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে— চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গ্রামে এই হার ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ, শহরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।