ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
জীবনবোধ ও জীবনদর্শন
Published : Wednesday, 13 April, 2022 at 12:00 AM
জীবনবোধ ও জীবনদর্শনজুলফিকার নিউটন ||
(পূর্বে প্রকাশের পর)
১৭
মহৎকে প্রতিষ্ঠা করা এবং জীবনে মহত্বের অনুসন্ধান করা মানুষের কর্মধারয় সর্বদাই বিশেষ প্রয়োজন। যেমন প্রকৃতিতে, প্রাণীজগতে বৃহৎ এবং ক্ষুদ্রের ভেদ আছে, বলিষ্ঠ এবং দুর্বলের ভেদ আছে, মানুষের মধ্যেও তাই আছে। প্রাণী জগতে বলিষ্ঠতা হচ্ছে দৈহিক শক্তি এবং কৌশলের উপর নির্ভরশীল। উদ্ভিদ জগতের বলিষ্ঠতা বৃক্ষের দীর্ঘ স্থায়িত্ব এবং বিপুলতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু মনুষ্য সমাজে বলিষ্ঠতা নির্ভরশীল জ্ঞান এবং গুণের উপর। অন্তপক্ষে আমাদের সময়ে তাই ছিল। বর্তমানে ঐশ্বর্যের প্রতিপত্তি দেখি, কৌশলের প্রতিপত্তি দেখি এবং শারীরিক বলেরও প্রতাপ দেখি। কিন্তু আমাদের শৈশব এবং কৈশোরে আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে শিখেছিলাম জ্ঞানী ব্যক্তিকে এবং বয়স্ক ব্যক্তিকে। ঐশ্বর্যের দ্বারা আমরা বিচার করিনি।
পুরনো বইয়ের একটা গন্ধ আছে। সে গন্ধটা আমাকে কেমন যেন ব্যাকুল করত। আমি ভাবতাম-শব্দের মধ্যে যেমন, তেমনি গন্ধের মধ্যেও অতীতের সমৃদ্ধি এবং সৌভাগ্যকে আবিষ্কার করা যায়। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত, বইগুলো হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখবার। কিন্তু কখনো সাহস হয়নি। সাহস না হলেও দেখার সৌভাগ্যকেই চিত্তে লালন করেছিলাম এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমিও বড় হয়ে গ্রন্থের সমুদ্রের মধ্যে বাস করব। আমার ইচ্ছা অপূর্ণ থাকেনি। আমি বিচিত্র গ্রন্থের কল্লোলের মধ্যে বাস করতে সক্ষম হয়েছি। আমি কল্লোল কথাটি ইচ্ছে করেই বললাম। বই যখন পড়ি তখন কিন্তু আমি গ্রন্থের শব্দগুলো কানেও শুনি। মনে মনে যখন আমি বই পড়তে থাকি তখন আমার কানে বইয়ের পাঠের উচ্চারণগুলো বাজতে থাকে। শৈশবে কোরআন শরীফ পড়তাম উঁচু স্বরে, বেশ একটু সুর করে! কোরআন শরীফের পাঠ থেকেই নির্বাক পাঠের সময়ও শব্দ শ্রবণের একটি প্রবণতা আমার মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। যে শব্দ শুনি আমি কানে সে শব্দ আমারই উচ্চারণ। কিন্তু তবু যেন আমার নয়। পঠিত গ্রন্থটি একটি সত্তা নিয়ে আমাকে যেন তার নিজের পরিচয় দিয়ে যায়।
আমার অনেক গ্রন্থই মুখে মুখে বলা। আমি উচ্চারিত শব্দের ধারাক্রমের সঙ্গে আমার বক্তব্যকে যেভাবে প্রস্ফুটিত করতে পারি, নির্বাক থেকে লিখিত ভঙ্গিতে সেভাবে পারি না। অবশ্য কবিতা আমি নিজেই লিখি এবং শ্রমসাধ্য গবেষণামূলক কাজগুলোও চিন্তা করে সময় নিয়ে লিখতে হয়। কিন্তু তবু মনে হয়, বলার কথা উচ্চারণের অভিনিবেশে যেভাবে প্রকাশিত হয়, সেভাবে কিন্তু লিখিত ভঙ্গিতে হয় না। বলার সময় আমি শ্রোতার সঙ্গে একটি সম্পর্ক স্থাপন করি। যার ফলে উচ্চারিত শব্দগুলো যেন শ্রোতার মনোজগতকে নাড়া দেয়।
আমার বড় ভাই প্রফেসর ড. কাজি মজিবুর রহমান তাপসমালা’ বইটি পড়ে আমাকে শোনাতেন। তাপসমালায় মুসলমান সূফীদের কাহিনী আছে। মূল গ্রন্থটি ফারসীতে কয়েক ঋণ্ডে রচিত। তার একটি সংক্ষিপ্তসার করেছিলেন ভাই গিরীশচন্দ্র সেন। এই গ্রন্থটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। অত্যন্ত সহজ ভাষায় ত্যাগী সিদ্ধ পুরুষদের কাহিনী এই গ্রন্থে বর্ণিত ছিল। বড় ভাই একদিন আমাকে হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর কাহিনী পড়ে শোনাচ্ছিলেন। বায়েজিদবোস্তামীর জীবন কথায় এক জায়গায় আছে যে তিনি যখন ধ্যানে রয়েছেন তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ এল, বায়েজিদ আমার যা নেই তাই নিয়ে তুমি আমার কাছে এসো। বায়েজিদ উত্তর করলেন প্রভু তোমার তো সবই আছে। এমন কি নেই যা নিয়ে আমি তোমার কাছে আসবো? আল্লাহর পক্ষ থেকে উত্তর এল, দীনতা। বড় ভাই তখন বই বন্ধ করে বুঝাতে লাগলেন যে অহমিকা গর্ব এবং ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার নিয়ে কেউ আল্লাহর কাছে উপস্থিত হতে পারে না। সর্বত্যাগী না হলে আল্লাহকে পাওয়া যায় না। তাছাড়া গর্ব তো মানুষের জন্য সমূহ ক্ষতিকর। জ্ঞানের গর্বও মানুষকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়-এই কথা বলে তিনি মওলানা জালালুদ্দীন রুমীর কাহিনী বলেছেন।
রুমী বিশ্ববিখ্যাত কবি ছিলেন অসাধারণ জ্ঞানী ছিলেন। পাণ্ডিত্যে তার সমতুল্য ব্যক্তি তার সমকালে কেউ ছিলেন না। এক কথায় বলতে গেলে তিনি জ্ঞানের সমুদ্রে বাস করতেন। সে সময় শামস তাবরেজ নামক একজন বিখ্যাত তাপস ছিলেন। তিনি জালালুদ্দিন রুমীর কাছে এলেন তাকে দীক্ষিত করার জন্য। জালালুদ্দীন রুমী বললেন আমি আমার বিবেচনা এবং জ্ঞানের সাহায্যে আল্লাহকে পাবার চেষ্টা করি। আমার দীক্ষার কি প্রয়োজন? শামস তাবব্রেজ বললেন, জ্ঞানের অহমিকা তোমাকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। জ্ঞানের সাহায্যে তুমি দূরত্ব নির্মাণ করেছে, নৈকট্যকে আসন্ন করছে না। তোমার অজস্র পুস্তুক তোমার এবং আল্লাহর মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর তুলে ধরছে। একদিন রুমী বাড়িতে ফিরে দেখেন তার গৃহে একটিও পুস্তক নেই পুস্তকাধারগুলো শূন্য। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শামস তাবরেজের দিকে তাকাতেই তাবরেজ বললেন, তোমার সমস্ত পুস্তক পুকুরের তলায়। সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসো।' রুমী হায় হায় করে উঠলেন! শামস তাবরেজ তখন বললেন, ‘জ্ঞান পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না জ্ঞান থাকে তোমার উপলব্ধিতে। পুস্তক তোমার মধ্যে জ্ঞানের অহমিকা নির্মাণ করেছে কিন্তু তোমাকে জ্ঞানী করেনি। রুমীর চৈতন্য হল। এবং তারপর তিনি শামস তাবারেজের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
আলাউদ্দিন আল আজাদের কাছেই আমি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কাব্যের স্বাদ প্রথম পেয়েছিলাম। তার বাড়ীর দোতলায় দক্ষিণদিকে একটি খোলা বারান্দা ছিল। সে ঘরে রই থাকতো বারান্দাটি তারই সংলগ্ন। বারান্দায় একটি ইজিচেয়ার পেতে আলাউদ্দিন আল আজাদ কান্তিচন্দ্র ঘোষের ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত পড়তেন। একদিন হঠাৎ তিনি আমাকে বললেন আমি তোমাকে মেঘনাদবধ কাব্য শোনাবো। তিনি বই নিয়ে আবৃত্তি আরম্ভ করলেন?
সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি বীরবাহু ঢলি যবে গেলা যমপুরে অকালে, কহ হে দেবি অমৃত ভাষিণী। ইত্যাদি তার আবৃত্তির কণ্ঠ সুন্দর ছিল, আমি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। কিন্তু আমার কাছে অপূর্ব লেগেছিল তার ব্যাখ্যা। মনে আছে তিনি বলেছিলেন, সম্মুখ যুদ্ধ মানে সামনা-সামনি যুদ্ধ, বীরের সঙ্গে বীরের যুদ্ধ, অতীব সাহসী না হলে এ যুদ্ধে কেউ এগিয়ে আসে না। কোনো রকম ভয় না করে শুধুমাত্র অসীম সাহসিকতার ওপর নির্ভর করে যুদ্ধে নামা সহজ কথা নয়। এ ধরনের সম্মুখ যুদ্ধে জয় পরাজয় কোনো বড় কথা নয়। যে জয়লাভ করে সেও যেমন বীর, যে পরাজিত হয় সেও তেমনি বীর। এখনকার দিনে যুদ্ধে কোনো বীরত্ব নেই। আড়াল থেকে কৌশলে গুলি ছুঁড়ে মানুষকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে মনুষ্যত্বইবা কোথায় বীরত্বইবা কোথায়? যে হত্যা করে সেও কৌশলে হত্যা করে এবং যে নিহত হয় সেও বীরত্ব প্রদর্শন করার সুযোগ পায় না। সুতরাং মধুসূদনের বীরবাহু সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয়ে মধুসূদনের কাছে বীর চূড়ামণি উপাধি লাভ করেছে। মধুসূদন শুধু একটিমাত্র কথায় সম্মুখ সমরে মাহাত্ম কীর্তন করেছেন। তিনি শুধু বলেছেন বীর চূড়ামণি বীরবাহু সম্মুখ সমরে পতিত হয়েছে। আমি আলাউদ্দিন আল আজাদেরএই ব্যাখ্যা শুনে অভিভূত হয়েছিলাম। এবং এই কাব্যপাঠে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। এই ব্যাখ্যার পর একটি নতুন আগ্রহ নিয়ে আমি মেঘনাদবধ কাব্য পাঠ করেছিলাম।

মধুসুদনের সাহায্যেই আমি বাংলা কবিতার শব্দের তাৎপর্য আবিষ্কার করতে কৌতূহলী হই। কবিতায় যে শব্দের একটি অন্তর্গঢ় চৈতন্য থাকে মধুসূদনের কবিতা পাঠ না করলে তা অনুভব করা আমার পক্ষে সহজ হতো না। রাজসভায় রাবণ বসে আছেন এর বিবরণিটি শব্দের ধ্বনি মাহাত্মে কল্লোলিত হয়ে আমাদের সামনে রাজসভাকে চাক্ষুস করেছে। আমি স্পষ্টই কল্পনা করতাম, আমি রাবণের রাজসভায় বসে আছি এবং বিপুল ঐশ্বর্যের দৃশ্যপট উন্মোচিত হতে দেখছি। আলাউদ্দিন আল আজাদ বলতেন। মধুসূদন মহাকবি কেননা তিনি মহাকাব্য লিখেছিলেন। আমার কাছে সে বয়সেই মাইকেলকে মহৎ কবি মনে হয়েছিল কেননা তিনি শব্দের ভূবনে অনায়াসে বিচরণ করেছিলেন। কোনো তত্ত্ব কথা নয়, কোনো জীবনবেদ নয় শুধু সংকটাপন্ন কয়েকজন মানুষ নিজেদের অবস্থা পর্যালোচনা করছে। এর মধ্যেই জীবনের সমস্ত কলরোল, সমস্ত বিপর্যয় উদ্বেলিত হয়েছে। এ কাব্যের তুলনা নেই যেমন আমার কৈশোরকালে ছিল না তেমনি এখনও নয়।
বায়েজিদ বোস্তামীর আরো অনেক উক্তি বাবার কাছে শুনেছি। বায়েজিদ তার শিষ্যদেরকে উপদেশ দিতেন ‘যখন কোনো অসৎ চরিত্র লোকের সহবাসে থাকবে এবং মন্দ স্বভাবকে আপন সৎ স্বভাবে আনবার চেষ্টা করবে এবং তখন তোমার মনে সন্তোষ জাগবে। যখন কেউ তোমাকে কিছু দান করবে তখন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে। পরে আল্লাহ তোমার প্রতি যার হৃদয়কে প্রসন্ন করেছেন সেই দাতাকে ধন্যবাদ দেবে। অন্য এক ব্যক্তি বায়েজিদের কাছে উপদেশ চেয়েছিল। তিনি তাকে বলেছিলেন। নভোমণ্ডলের প্রতি দৃষ্টিপাত করো। সে যখন দৃষ্টিপাত করলো তিনি তখন তাকে প্রশ্ন। করলেন, তুমি কি জানো ওই নভোমণ্ডলকে কে সৃষ্টি করেছেন? লোকটি উত্তর করলো, জানি। বায়েজিদ বললেন, “যিনি নভোমণ্ডলের সৃষ্টিকর্তা তুমি যেখানেই থাকো না কেন তার দৃষ্টি সর্বদাই তোমার উপর আছে। সুতরাং তুমি সতত সতর্ক থাকবে।
(চলবে...)