একজন মহিয়সী নারীর প্রস্থান
Published : Tuesday, 21 June, 2022 at 12:00 AM
আহমেদ শরীফ শুভ ||
গত ১৫ই জুন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নারী উন্নয়নের অগ্রদূত ও সমাজকর্মী মিসেস শরিফুন্নেছা আহমেদ ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নেয়ার পথে ইন্তেকাল করেছেন। তার আগের সপ্তাহে তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে একই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলেন।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন আমাদের ছয় ভাইবোনের মা। অসুস্থতার জন্য গত কয়েক বছর সমাজজীবনের অন্তরালে থাকলেও দীর্ঘদিন তিনি কুমিল্লায় শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজকর্মে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। যাঁরা তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত নন (বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম) কিন্তু জানতে চান তাঁদের জন্য আমার মায়ের সম্পর্কে দু’ একটি কথা লিখছি।
আজ থেকে প্রায় ৮১ বছর আগে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার প্রত্যন্ত কংগাই গ্রামে আমার মা শরিফুন্নেছা আহমেদ জন্মগ্রহন করেন। গ্রামটি কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ২৪ মাইল দূরে। চল্লিশের দশকে সেটি ছিল প্রত্যন্ত এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জনপদ (সত্তরের দশকে শহর থেকে গ্রামে যেতে বাসে, বিক্সায়, পায়ে হেঁটে কিংবা বর্ষাকালে নৌকায় আমাদের প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগতো)। আমার মাতামহ আমিন উদ্দিন সরকার ১৯১৯ সালে কলিকাতা বোর্ডের অধীনে প্রথম শ্রেণিতে এন্ট্রান্স (বর্তমান এসএসসি সমতুল্য) পরীক্ষায় পাশ করেন এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ডাক বিভাগে চাকরীর সুযোগ পান। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে বলে সে চাকরিতে যোগ না দিয়ে গ্রামেই হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস শুরু করেন।
শরিফুন্নেছা আহমেদ ছিলেন সাত ভাই বোনের মধ্যে ষষ্ঠ। তিনি তাঁর বাবার মেধা ও প্রজ্ঞার উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাবা শুধু বায়োলজিক্যাল কন্যাই ছিলেন না, মানসকন্যাও ছিলেন। তিনি তাঁর বাবার উৎসাহে তাঁর আদর্শেই লালিত হয়েছেন। তাঁরা তিন বোনই গ্রামে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে প্রথম লেখাপড়া শিখেছিলেন। আমার মা চাঁদপুর লেডি প্রতিমা গার্লস স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে মেট্রিক পাস করেন। সে বছর সমগ্র চাঁদপুর মহকুমা থেকে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে উনিই একমাত্র প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন যা তখনকার পত্রিকায় ছবি সহ ছাপা হয়েছিল। পরবর্তীকালে টাঙ্গাইলের কুমুদিনি কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট এবং বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি ময়মনসিংহ শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় থেকে বিএড পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন এবং শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা (আর পি সাহা)র প্রতিষ্ঠিত ভারতেশ্বরী হোমসে শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।
আমার বাবা জনাব আজগার আহমেদ তখন চট্টগ্রামে রেলওয়েতে কর্মরত ছিলেন। সে সময় মির্জাপুর থেকে চট্টগ্রাম অনেকটাই দূরের পথ। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন একসাথে থাকবেন। আম্মা ভারতেশ্বরী হোমসের চাকরি ছেড়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী গার্লস স্কুলে যোগ দিলেন প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। তাঁর মতো তরুণ বয়সে প্রধান শিক্ষিকা নিয়োগপ্রাপ্তি সে সময় খুব বেশি একটা ঘটেনি।
১৯৬৮ সালে আমার বাবা মা সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের শহরে ফিরে আসবেন। আব্বা রেলওয়ের আকর্ষনীয় চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন কুমিল্লা পৌরসভার নগরশুল্ক সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে আর আম্মা যোগ দিলের লুৎফুন্নেসা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। আমাদের ভাইবোনদের শৈশবের অনেকটাই কেটেছে সেই স্কুলের কম্পাউন্ডে। সেই স্কুলের ছাত্রী সংগ্রহের জন্য তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন। কুমিল্লার একটি পশ্চাদপদ জনপদে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সন্তান জন্ম দেয়ার কয়েক দিনের মাথায় রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তিনি ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন, তাদের অভিভাবকদের সম্মতি আদায় করেছেন, স্কুলের পরিধি বাড়িয়েছেন।
৬৯ এর গণ আন্দোলনের জোয়ার তখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার মা সিদ্ধান্ত নিলেন শুধু শিক্ষকতা দিয়েই জাতির প্রতি তাঁর সমুদয় দায়িত্ব পালন করা হবে না। জাতি তখন স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জিবীত। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান রাখা প্রয়োজন। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন এবং কুমিল্লা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হলেন। ৭০ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি কুমিল্লার নারী সমাজকে সংগঠিত করেন এবং তাদের এক বিরাট অংশকে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষন হন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসার আগেই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সেই সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের নির্দেশে জেলায় জেলায় বেসামরিক প্রতিরক্ষা (সিভিল ডিফেন্স) ট্রেনিং শুরু হয়। তিনি তখন কুমিল্লা শহরের ২৪টি ট্রেনিং সেন্টারের তত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি কুমিল্লা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু তখন উপলব্ধি করেন রাজনীতি ক্রমশঃই পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত হচ্ছে। তিনি যে উদ্দেশ্যে (স্বাধীনতা সংগ্রাম) রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন সে উদ্দেশ্যও তখন অর্জিত হয়ে গেছে। তাই তিনি ১৯৭৪ সালে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। অবশ্য ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের সময় দূর্ভিক্ষ প্রতিরোধ গণকমিটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং প্রবীনদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
৭০ দশকের মাঝামাঝি তিনি লুৎফুন্নেসা স্কুল ছেড়ে শৈলরাণী বহুমুখি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে ফয়জুন্নেসা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে ইংরেজীর শিক্ষিকা হিসেবে যোগদেন এবং সেখান থেকেই অবসর নেন। তিনি কুমিল্লা বোর্ডের ইংরেজির প্রধান পরীক্ষক ছিলেন। তঁর শতশত ছাত্রী আজ সমাজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, অনেকেই সাফল্যের শিখরে আরোহন করেছেন।
৮০'র দশকের মাঝামাঝি এসে উনি তাঁর বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষকতার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিসের সিদ্ধান্ত নিলেন। দৃঢ়চেতা মানুষ। যে ভাবনা সে কাজ। সেই বয়সে ১৯৮৭ সালে তিনি হোমিওপ্যাথি বোর্ডের ৪ বছরের কোর্স শেষ করে সার্টিফিকেট নিলেন এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি বেশ কয়েক বছর প্র্যাকটিস করলেন।
পেশাগত জীবন ছাড়াও সাংস্কৃতিক এবং সমাজকর্মের পরিমণ্ডলে তাঁর আলাদা একটি জীবন ছিল। তিনি বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর ভলান্টারি ষ্টেরিলাইজেশনসহ একাধারে ১৯টি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভানেত্রী কিংবা সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন। সেই সাথে তিনি কুমিল্লা পূর্বাশা ও মধুমিতা কচিকাঁচার মেলার উপদেষ্টার দায়িত্বও পালন করেন। শুধু তাই নয়, ১৯৮৫ সালে তিনি কুমিল্লায় প্রথম স্পোকেন ইংলিশ কোর্স চালু করেন এবং পরবর্তী কয়েক বছর নিজে সেই কোর্স পরিচালনা করেন।
আমার সাহিত্য চর্চা এমনকি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার হাতে খড়ি মায়ের কাছে। তিনি আমাকে কবিতা আবৃত্তির প্রথম পাঠ দিয়েছেন। সংঠন গড়ে তোলার নেশা আমি মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি খুব ছোটবেলায় আমাকে দীক্ষা দিয়েছেন যে জীবন মানুষের কল্যানে ভূমিকা রাখে না সে জীবন অর্থহীন। শিখেয়েছেন, যেখানেই থাকি না কেন পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনের পর যেন দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করি। দেশের প্রতি ঋণ যেন যথাসাধ্য শোধ করার চেষ্টা করি।
তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণতা আর আধুনিকতার সমন্বয়। সুস্থ থাকা অবস্থায় উনাকে কখনো নামাজ ছাড়তে দেখিনি। আবার ষাট/ সত্তরের দশকে আব্বার মোটর সাইকেলের পেছনে করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে দেখেছি, সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে দেখেছি, বন্ধু বান্ধবী আর দলীয় মেতা কর্মীদের নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা মারতে দেখেছি, মঞ্চ নাটক উপভোগ করতে দেখেছি। রবীন্দ্র সংগীত আর নজরুল গীতি শুনে সকাল সন্ধ্যা শুরু করতে দেখেছি। আমাদের ভাইবোনদের ডাক নাম তিনি বাংলায় রেখেছেন, পুরো নাম রেখেছেন আরবীতে। বলতেন, আমরা যতটুকু মুসলমান, ততটুকুই বাঙালি। তিনি আমাদের ভাইবোনদের সৎ, নির্লোভ ও নিরহংকার জীবন যাপনের শিক্ষা দিয়েছেন।
আমার মায়ের জাগতিক সহায় সম্পত্তি তেমন বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু ভালোবাসা অর্জনে তাঁর কিছুই অপূর্ণ ছিল না। আমার বাবাসহ তিনি আমাদের ৬ ভাইবোনের প্রত্যেককেই যার যার ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। আমার শিক্ষা, লেখালেখি, সমাজকর্ম ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে তাঁর ছিল অপরিসীম ভূমিকা। তাঁর সাথে যুক্তিভিত্তিক বিতর্ক করার সাহস তিনি আমাকে জুগিয়েছিলেন বলেই রাজনীতি এবং জীবন দর্শন নিয়ে অনেক সময়ই তাঁর সাথে আমার যুক্তিভিত্তিক বিতর্ক হতো।
২০১৮ সালে আমার বাবার মৃত্যুর পর উনার শারীরিক ও মানসিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। পর পর দুইবার ষ্ট্রোক হয়। এর মধ্যে তাঁর ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রম) এবং পার্কিনসনিজম রোগ দ্রুত তাঁকে কাবু করে ফেলে। সম্প্রতি ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করার পর উনার শারীরিক অবস্থার সাময়িক উন্নতি হয় এবং তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ১৪ই জুন রাতে এবং ১৫ইজুন সকালে আম্মার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে (আমার ধারণা উনার আবারো ম্যাসিভ ষ্ট্রোক করেছিল)। হাসপাতালে নেয়ার পথে ১৫ই জুন আনুমানিক দেড়টা/ পৌনে দুইটার সময় তাঁর জীবনাবসান হয়।
আমাদের মা মিসেস শরিফুন্নেছা আহহেমদ বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, বেঁচে থাকবেন আমাদের মধ্যে, তাঁর শত সহস্র ছাত্রীদের সাফল্যের মধ্যে, কুমিল্লার তৎকালীন পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের অগ্রগতির মধ্যে। তিনি ছিলেন তাঁদের একজন আলোকবর্তিকা। তাঁর প্রস্থানে সমাজ হারিয়েছে একজন মহিয়সী নারীকে, কুমিল্লা হারিয়েছে তার একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।
লেখকঃ মরহুমা শরিফুন্নেছা আহমেদের জ্যেষ্ঠ সন্তান, অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী চিকিৎসক, কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।