স্বপ্ন
এখন সত্যি। এদেশের মানুষ দীর্ঘ সাত বছর ধরে যে স্বপ্ন দেখছিল, পদ্মা নদীর
ওপরও সেতু হবে, সেই স্বপ্ন এখন আর স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। পুরো
জাতির স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে আজ। সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন। উদ্বোধন হচ্ছে আজ
শনিবার সকাল ১০টায়। শেষ হচ্ছে অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহর। যে স্বপ্ন নিয়ে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও
নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন, তাঁর হাত দিয়েই আজ উদ্বোধন হতে
যাচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। এর সকল কৃতিত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তাই তো আজ উৎসবে মাতবে সারাদেশ। পদ্মাপাড়ের
উৎসবে জেগে উঠবে সারাদেশের মানুষ। আর এ সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে
বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসে একটি মাইলফলক রচিত হবে।
বাংলাদেশের উন্নয়নের
প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে পদ্মা সেতুর মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন
করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে
হাঁটতে হাঁটতে ঠিকই তিনি গন্তব্যে পৌঁছেছেন। সেতু নির্মাণকে কেন্দ্র করে
বিস্তৃত ষড়যন্ত্রের জাল দৃঢ়তার সঙ্গে ছিন্ন করে তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা
করেছেন। তাই তো পদ্মা সেতু আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস,
দূরদর্শিতা আর নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সাহসের প্রতীক। তাঁর
দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর। শেখ হাসিনার শাসনামলে বিশ্ব আরও একবার
বাংলাদেশের সক্ষমতা জানার সুযোগ পেল।
পদ্মা সেতু আজ আর শুধু একটি
স্থাপনা নয়, এটি এখন বাঙালী জাতির গর্ব, আত্মমর্যাদা ও অহঙ্কারের প্রতীক।
এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নদীবেষ্টিত ভূখ- সরাসরি
রাজধানীর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। ফলে এই সেতু যেমন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম
অঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক সুবাতাস বয়ে আনবে, তেমনই
কমপক্ষে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধিও নিশ্চিত করবে। লাভবান হবে
গোটা দেশের মানুষ। প্রসার হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনের। ভবিষ্যতের
বাংলাদেশ নির্মাণে এই সেতু বিরাট ভূমিকা রাখবে।
পদ্মা সেতু নিয়ে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও একবার উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। এই সেতুর নাম
‘শেখ হাসিনা সেতু’ করার জন্য দলের পক্ষ থেকে প্রবল দাবি উঠেছিল। সেতু বিভাগ
থেকেও একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে, সেখানে ‘শেখ
হাসিনা পদ্মা সেতু’ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন জায়গায় এমনকি
সংসদেও দাবি উঠেছিল, পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করার। কিন্তু
দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনা তা নাকচ করে দেন। গত এক যুগ ধরে যত আলোচনা,
সমালোচনা, বিতর্ক সবই হয়েছে পদ্মা সেতু ঘিরে। ফলে বিশ্বে এই সেতুটি পদ্মা
সেতু নামেই ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব
দাবি নাকচ করে দিয়ে ‘পদ্মা সেতু’ নামেই সেতুর নামকরণের নির্দেশ দিয়েছেন। গত
২৪ মে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর
নির্দেশে পদ্মা নদীর নামেই সেতুর নামকরণ করা হবে।’ গত ২৯ মে পদ্মা সেতুর
নাম চূড়ান্ত করে সেতু বিভাগের উন্নয়ন অধিশাখা থেকে গেজেট জারি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, সেতু বিভাগের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক
বাস্তবায়নাধীন ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের’ আওতায় মুন্সীগঞ্জ
জেলার মাওয়া এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা প্রান্ত সংযোগকারী পদ্মা নদীর ওপর
নির্মিত সেতুটি সরকার ‘পদ্মা সেতু’ নামে নামকরণ করলেন। জনস্বার্থে জারিকৃত এ
আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
জমকালো উদ্বোধন ॥ বর্ণাঢ্য আয়োজনে
জাঁকজমকপূর্ণভাবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। যে কর্মযজ্ঞ
শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর, তা শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ২২ জুন। সব
কাজ শেষ করে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ঠিকাদার সেতুটি গত
২২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে সেতু কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে। টেকিংওভার
সার্টিফিকেট প্রদানের মাধ্যমে এদিন পদ্মা সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে সেতু
কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হয়। এরই মধ্যে সেতুটির উদ্বোধনের সব
প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ
জানানো হয়েছে সাড়ে তিন হাজার সুধীজনকে। এ তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন দেশের
রাষ্ট্রদূত, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, নির্মাণ
সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা।
এদের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, ড. ইউনূস এবং বিএনপি নেতৃবৃন্দও
রয়েছেন। তবে শেষ মুহূর্তে আইনগত কারণে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে
দাওয়াত দেয়া হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকাল ১০টায় মাওয়া
প্রান্তে সুধী সমাবেশ করে পদ্মা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করবেন।
এরপর তিনি ম্যুরাল ও নামফলক উন্মোচন করে টোল দিয়ে সফরসঙ্গীদের নিয়ে গাড়িতে
করে পদ্মা সেতু পার হবেন। ওপারে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী আরও একটি ম্যুরাল ও
নামফলক উন্মোচন করবেন। উদ্বোধন কার্যক্রম শেষ করে প্রধানমন্ত্রী দুপুরে
মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত বিশাল জনসভায় ভাষণ
দেবেন।
সেতু বিভাগ জানায়, সেতুটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য
ইতোমধ্যে ম্যুরাল ও ফলক নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মাওয়া ও জাজিরা
প্রান্তে ৪০ ফুট উচ্চতার দুটি ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে। দুটি ম্যুরালে জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি
রয়েছে।
ইতোমধ্যে শিবচরে ঐতিহাসিক জনসভা আয়োজনের প্রস্তুতিও সম্পন্ন।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের এই জনসভাকে স্মরণীয় করে রাখতে সরকারী দল আওয়ামী লীগ
ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। সারাদেশের মানুষ যাতে এই আনন্দ উৎসবে অংশ নিতে
পারে সেজন্য দেশের ৬৪ জেলায় এই অনুষ্ঠান একযোগে রেপ্লিকেশনের ব্যবস্থা করা
হয়েছে। বেলা ৩টায় শিবচরের কাঁঠালবাড়িতে আয়োজিত ঐতিহাসিক জনসভাটি শুরু হবে। এ
উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও দিনব্যাপী সেখানে থাকছে নানা আয়োজন।
এসব আয়োজনে ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছে
ক্ষমতাসীন দলটি।
পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রবল আকাক্সক্ষা তৈরি
হয়েছে। ফলে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী জনসভায়ও সারাদেশের মানুষ যুক্ত হয়ে যাবে।
সেভাবেই সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়ছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে
সারাদেশের মানুষের মধ্যে যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে বোঝা যায় শিবচরের
কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের জনসভায় সারাদেশের মানুষ এক হয়ে যাবে।
বহুল
কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনে ব্যাপক জনসমাগম ঘিরে যে কোন ধরনের
বিশৃঙ্খলা এড়াতে সেতুর উভয় পাড়ে নেয়া হয়েছে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
পদ্মার দুই পাড়েই শুধু পাঁচ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য
ইউনিফর্মে মোতায়েন করা হয়েছে। সাদা পোশাকে তৎপর রয়েছে আরও বিপুলসংখ্যক
গোয়েন্দা সদস্য। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি সেতুর দুই
পাড়েই খোলা হযছে পুলিশের বিশেষ কন্ট্রোল রুম। সেতুর মাওয়া ও জাজিরা
প্রান্তে বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল ও এর আশপাশের এলাকায় নেয়া হয়েছে কঠোর
নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করছে। সেতু সংলগ্ন পদ্মা নদী ও
পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গত ২১ জুন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর দক্ষিণ প্রান্তে শরীয়তপুরের জাজিরায়
পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা এবং মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু উত্তর
থানার উদ্বোধন করেছেন। অনুষ্ঠান স্থলে পদ্মা নদীতে নৌ পুলিশ ফায়ার
সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলেরও অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে।
উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একটি মহল
নাশকতা ও ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটিয়ে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরাতে পারে বলে
মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ কারণে পুলিশ সদর দফতর থেকে
সারাদেশের প্রতিটি থানায় নির্দেশ পাঠানো হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে
থাকার জন্য। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ যাতে গুজব ছড়াতে না পারে
সেজন্য সার্বক্ষণিক সাইবার মনিটরিং করা হচ্ছে।
সেতুর আজ উদ্বোধন হলেও
সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি চলাচল করছে না। উদ্বোধনের পর ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে পদ্মা
সেতু দিয়ে নিয়মিতভাবে গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সেভাবেই সব প্রস্তুতি নেয়া
হয়েছে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বাস চলাচলের জন্য কোম্পানিগুলো প্রস্তুতি
নিয়েছে। এই রুটে চলাচলের জন্য লাক্সারি সব বাস নামানোর জন্য বড় বিনিয়োগ করা
হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মূলত তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে
হয়েছে। এর চ্যালেঞ্জগুলো ছিল রাজনৈতিক, কারিগরি এবং পরিবেশগত। এর মধ্যে
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ খুব ঠা-া মাথায় অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করেছেন
স্বয়ং প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর কারিগরি ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা
করেছেন এদেশে বিজ্ঞানীরা। বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থায়ন থেকে সরে
গেলে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ দেখভাল ও তদারকির জন্য দায়িত্ব পড়ে এদেশের ভৌত
ও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ওপর। যারা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সঙ্গে
পরামর্শ দিয়ে চীনা ঠিকাদারকে সহায়তা করেছেন এই সেতু নির্মাণে।
রাজনৈতিক
চ্যালেঞ্জ ॥ পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনৈতিক। ২০১২ সালে
হঠাৎ করেই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গেলে এই
চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়। এই চ্যালেঞ্জের সরাসরি সম্মুখীন হন আওয়ামী লীগ সরকার
প্রধান শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে দুই ধরনের প্রতিকূলতার মুখে পড়েন তিনি। এক
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা এবং দ্বিতীয়ত দুর্নীতির অভিযোগ
সামাল দেয়া। খুব ঠা-া মাথায় তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন এবং তা সামাল
দেয়ার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রেও তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দেন।
পদ্মা সেতু
নির্মাণে ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ
সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। বিশ্বব্যাংক এগিয়ে আসায় এ সেতুর
অর্থায়নে জাপানের জাইকা, আইডিবি ও এডিবি এগিয়ে আসে। ফলে ১৮ মে জাইকার
সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত
হয়। অর্থায়ন চুক্তির পর ওই বছরেরই (২০১১ সাল) সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাংক
অভিযোগ তোলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। অথচ তখন সেতু প্রকল্পের
কাজ শুরুই হয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল কানাডার পরামর্শক সংস্থা এসএনসি
লাভালিন কাজ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মন্ত্রী, সেতু সচিব, সেতু প্রকল্পের
পিডি ও অন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছে। তারা জোর দাবি করে তাদের
কাছে দুর্নীতির যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে।
বিশ্বব্যাংক এই দুর্নীতির
অভিযোগ তুলে কথিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত
করে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিতে থাকে। তারা মন্ত্রী,
সচিব, পিডি ও অন্যদের সেতুর কাজ হতে অব্যাহতি চায়। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে
বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠায় সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে তা সরেজমিনে দেখার
জন্য। ওই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে দুদকের সঙ্গে সভা করেন। এ সময় দেশের
গণমাধ্যমও উঠেপড়ে লাগে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য। শুরু করে নানা
অপপ্রচার।
এভাবে বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত চাপ, মিডিয়ার প্রপাগান্ডা এবং
সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও কিছু সুশীল সমাজের লোকের বক্তৃতা-বিবৃতি এবং কোন
কোন গবেষণা সংস্থার কর্মকর্তাদের কথায় এমন আবহ তৈরি হয় যে, পদ্মা সেতু
প্রকল্পে সত্যিই দুর্নীতি হয়েছে! সরকার কোন পদক্ষেপ না নিলে মনে হবে সরকার
দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে চাচ্ছে। এগুলো মূলত পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা
হয়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এবং এদেশে যাতে পদ্মা সেতু না হয় তার
জন্য।
বাধ্য হয়ে সরকার বিশ্বব্যাংক উত্থাপিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে
পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ তদন্ত করে কারও বিরুদ্ধে
দুর্নীতির কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের চাপে তৎকালীয়
যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ইস্তফা দিতে বললে তিনি মন্ত্রিত্ব থেকে
ইস্তফা দেন। সচিব মোশারফ হোসেন ভুঁইয়াকে বদলি করা হয়। প্রকল্প পরিচালক
রফিকুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান টিম গঠন করে।
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ভিত্তিতেই দুদক সাতজনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করে।
সেই মামলায় সচিব মোশারফ হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ৪০ দিন জেল খাটেন।
পরবর্তীতে দুদকের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় আদালত আসামিদের খালাস
দেয়।
বাংলাদেশ সরকার এত সকল ব্যবস্থা নিলেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি।
তারা ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ঋণচুক্তি স্থগিতের ঘোষণা করে।
তখন বিশ্বব্যাংককে অনুসরণ করে জাইকা, এডিবি ও আইডিবিও তাদের নিজ নিজ
ঋণচুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংক কানাডার এসএনসি লাভালিনকে ১০ বছরের জন্য
ব্যাংকের কাজে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কানাডার একটি আদালতে এসএনসি লাভালিনের
দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। পরবর্তীতে
২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর কানাডার আদালত অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে মামলা
খারিজ করে দেয় এবং অভিযুক্তরা খালাস পায়। কারণ বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতে
দুর্নীতির কোন তথ্য প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংক নিজেও তদন্ত
করে দুর্নীতির পক্ষে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পায়নি। কানাডার আদালতে এবং
বাংলাদেশের দুদকের তদন্ত দলের কাছে বিশ^ব্যাংক কোন সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন
করতে পারেনি। অথচ তারা বলেছিল তাদের কাছে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ আছে। আসলে
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ইমেলে বেনামে বিশ্বব্যাংকের কাছে
অভিযোগপত্র পাঠিয়েছিল। সেই ব্যক্তিরাও দুর্নীতির তথ্য প্রমাণের কোন
ডকুমেন্ট দিতে পারেনি। ফলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তে দুর্নীতির অভিযোগ শেষ
পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। ২০১৭ সালে বিশ^ ব্যাংক আন্তর্জাতিক
আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর আর্জেন্টিনার আইনজীবী লুইস গেব্রিয়েল মরেনো
ওকামপোকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা
নিচ্ছে তা দেখার জন্য। বিশ্বব্যাংক শেষ পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল কথিত
দুর্নীতির অভিযোগকে প্রমাণ করতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত
ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন। তিনি ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু অবশ্যই
হবে। তবে তা বিশ্বব্যাংকের টাকায় নয়, নিজস্ব অর্থায়নেই হবে। তিনি বলেন,
‘অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে পদ্মা সেতু করব না। আমাদের জনগণের
টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে।’
বিশ্বব্যাংক চলে গেলে চীন অবশ্য পদ্মা
সেতু নির্মাণে ঋণ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। চীন প্রস্তাব দিয়েছিল, বিওটি অর্থাৎ
বিল্ড ওন ট্রান্সফার পদ্ধতিতে দুইশ’ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে পদ্মা
সেতু নির্মাণের। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই প্রস্তাবও গ্রহণ
করেননি। তিনি পণ করেন, দেশের জনগণের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে
বিশ্বব্যাংককে দেখিয়ে দেয়ার। বিশ্বব্যাংক থাকাকালীই বাংলাদেশ সেতু
কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে প্রি-কোয়ালিফিকেশন টেন্ডার আহ্বান
করেছিল। তার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক টেন্ডারে কাজ পেয়েছিল চায়না মেজর ব্রিজ
ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিক করেছিলেন,
বিশ্বব্যাংক থাকাকালীন যে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং যাদের মাধ্যমে পদ্মা
সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া এবং সেই ঠিকাদার দিয়েই
তিনি পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন। তিনি সেটাই করেছিলেন। আর যে পরামর্শক
সংস্থা নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তিনি তাদের বাদ দিয়ে পদ্মা
সেতুর নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য দেশীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শক প্যানেল
অব এক্সপার্ট গঠন করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ জুলাই ২০১২ জাতীয়
সংসদের অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন নিজস্ব অর্থায়নে
পদ্মা সেতু নির্মিত হবে। তখন নির্মাণ ব্যয়ের প্রাক্কলন ছিল ২৩ হাজার কোটি
টাকা। ওই টাকা কিভাবে আসবে তার রূপরেখাও তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।
তিনি বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার ঋণচুক্তি বাতিলের কঠোর সমালোচনা
করেন। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের উন্নয়নে তাদের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করার জন্য
হুঁশিয়ারি করে দেন।
সে লক্ষ্যে ১৭ জুন ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশ সেতু
কর্তৃপক্ষ চায়না ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানিকে সেতু নির্মাণের জন্য ঠিকাদার
হিসেবে নিয়োগ দেয়। ঠিকাদার কোম্পানি ২০১৪ সালের ২৬ নবেম্বর থেকে কাজ শুরু
করে। সকল কিছু গোছগাছ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার পদ্মা সেতুর
নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। তিনি ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর নদীর উভয় পাড়ে
প্রকল্পের মূল সেতুর নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের উদ্বোধন করেন। ফলে দ্রুত
গতিতে শুরু হয়ে যায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর
সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান। আর সর্বশেষ স্প্যান
অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।
অথচ মূল পরিকল্পনা ছিল
২০১১ সালের প্রথম দিকে সেতুর কাজ শুরু হবে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে মূল সেতুর
কাজ শেষ হবে। কিন্তু বিশ^ব্যাংকের অভিযোগে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তা না
হলে অনেক আগেই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যেত। পরে অনুসন্ধানে
বেরিয়ে আসে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ তদারকির জন্য বিশ্বব্যাংক একটি
প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার জন্য চাপাচাপি করছিল। কিন্তু সরকার তাতে রাজি
হয়নি। এরপর থেকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে
থাকে। তারই এক পর্যায়ে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির কাল্পনিক
অভিযোগ উত্থাপন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও
সাহসিকার সঙ্গে পদ্মা সেতুর কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ ও অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ
মোকাবেলা করেন।
এখানেই শেষ নয়, ষড়যন্ত্রকারীরা পদ্মা সেতু নির্মাণ বন্ধ
করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সেতু সম্বন্ধে নানা রকম মিথ্যা,
ভিত্তিহীন তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও
করেছে। পদ্ম সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে এ গুজব ছড়িয়ে দেশের বিভিন্ন
জায়গায় অনেককে ছেলে ধরার অভিযোগ দিয়ে আহত নিহত করা হয়েছে। ঢাকায় বাড্ডায়
তাসলিমা বেগম রেণু নামে এক মহিলাকে ছেলে ধরার অভিযোগ দিয়ে নির্মমভাবে
পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই গুজবে সারাদেশে গণপিটুনিতে মোট ২১ জন আহত হয়। নিহত
হয় ৫ জন। আসলে ষড়যন্ত্রকারীদের যে মানবতা বলতে কিছু নেই এতেই তা প্রমাণিত
হয়।
কারিগরি চ্যালেঞ্জ ॥ সারা বিশ্বের খরস্রোতা নদীগুলোর মধ্যে
বাংলাদেশের পদ্মা নদী একটি। এই নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও
প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরনÑ এসব কিছুর কারণে এর ওপর সেতু নির্মাণ করা
ছিল অসম্ভব রকমের কঠিন এক কাজ। সেই অসম্ভব কাজটি শেষ পর্যন্ত সম্ভব করেছেন
এদেশের বিজ্ঞানীরা। যে কারণে এই সেতু নির্মাণ করতে প্রায় আট বছর সময় লেগে
গেছে।
সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণ
করতে গিয়ে ধাপে ধাপে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে এবং সেসব সামাল দিতে পরিবর্তন
করতে হয়েছে সেতুর নক্সাও। কিন্তু মানের ব্যাপারে কোন আপোস করা হয়নি। ফলে
প্রায় নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে বিশ্বের অত্যাধুনিক সব
প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদ্মা নদীর তলদেশে
মাটির গভীরে পাইল বসানো ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। পৃথিবীর আর কোন নদীর ওপর সেতু
বানাতে গিয়ে এত গভীরে পাইল বসাতে হয়নি। এই সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহার করা
হয়েছে যমুনা সেতু ও গঙ্গা নদীর ওপর তৈরি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে অর্জিত
জ্ঞান।
পদ্মা নদী একটি এ্যালুভিয়াল নদী অর্থাৎ পলল-শিলার মধ্য দিয়ে এই
নদী এঁকে বেঁকে সাপের মতো প্রবাহিত হচ্ছে। এটি খামখেয়ালি নদীও বটে কারণ এর
চরিত্র বিচিত্র রকমের। এর পাড়ও ভাঙ্গে খুব বেশি। ফলে এরকম বিশাল ও প্রমত্ত
একটি নদীর ওপর এত বড় সেতু নির্মাণের কাজ প্রকৌশলগত দিক থেকে ছিল বিরাট
চ্যালেঞ্জ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটি নরম হওয়ার কারণে নদীর তল অনেক গভীরে
চলে যেতে পারে অথবা দুই পাশ ভাঙতে পারে। শীতের সময় পদ্মা নদীতে গভীরতা থাকে
১০০ ফুটের কাছাকাছি। বর্ষার সময় এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ কারণে
চ্যালেঞ্জ ছিল নদীর ওই গভীরতায় সেতুর যেসব পাইল বসানো হবে সেগুলোর
ফাউন্ডেশন তৈরি করা।
বাংলাদেশের কোন নদীতে পাথর নেই। ফলে সেতুর পুরো ভার
রাখতে হয় মাটিতে। এ কারণে নদীতে অনেক ভারি পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ এবং
জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব পাথর ব্যবহার করা হয়েছে তার এক একটির ওজন
৮০০ কেজি থেকে এক টন। এসব পাথর একসঙ্গে মিক্স করা হয়েছে যাতে ইন্টারলকিং
হয়। সেগুলোকে নদীর তলদেশে নামিয়ে দেয়া হয়েছে যতটুকু যাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ
ড্রেজিংয়ের ক্ষমতা যতটুকু ছিল ততটা গভীরে যাওয়া হয়েছে। এজন্য পৃথিবীর বড় বড়
তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। এভাবে নদীর তলায় ৮০০ কেজির জিওব্যাগে
তুলনামূলকভাবে মোটা বালি ভরে বটম লেয়ার বা স্তর তৈরি করা হয়েছে।
পদ্মা
সেতুর নির্মাণ কাজের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ড. আইনুন নিশাত, পদ্মা সেতুর
সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় মাটির গুণাবলী সম্পর্কে যেসব খবর নেয়া হয়েছিল তাতে
দেখা গিয়েছিল তলায় হমোজেনিয়াস সয়েল বা সব মাটি একই ধরনের। কিন্তু সেতু
নির্মাণ করতে গিয়ে দেখা গেল বেশ কিছু পাইলের নিচে কাদামাটির স্তর। তখন
কাদামাটির ওই স্তর ভেদ করে আরও গভীরে পাইলের ফাউন্ডেশন নির্মাণ করতে হয়েছে।
যে কাজটা ছিল বেশ কঠিন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেতুর ভার বহন করার জন্য এর
যতটা গভীরে পাইল বসানোর দরকার ছিল সেটা ছিল অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ। এত গভীরে
যেতে হয়েছে কারণ ওপরের ৬০ থেকে ৭০ মিটার শুধু পানি, যেখানে পাইলের কোন
শক্তি নেই। অনেক গবেষণা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত ওই গভীরতায়
পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তখন সেতুর নক্সা পরিবর্তন করা হয়েছে।
বিশ্বে
খরস্রোতা যত নদী আছে তার একটি এই পদ্মা। এর চাইতে বেশি পানির প্রবাহ আছে
পৃথিবীর একটি মাত্র নদীতে, সেটি আমাজন এবং ওই নদীর ওপর কোন সেতু নেই।
পৃথিবীর ১০ থেকে ১৫টা বড় নদীর মধ্যে দুটো হচ্ছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র।
কিন্তু পদ্মা নদী হচ্ছে এই দুটো নদীর যোগফল। সিরাজগঞ্জের উজানে ব্রহ্মপুত্র
১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার চওড়া। রাজশাহীতে পদ্মা চার থেকে ছয় কিলোমিটার
প্রশস্ত। ফলে যে পরিমাণ পানি প্রায় ২০ কিলোমিটার জায়গা দিয়ে পার হচ্ছে, সেই
একই পরিমাণ পানি মাওয়ায় পদ্মা সেতুর নির্মাণ এলাকায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত
পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার চেষ্টা করে। বর্ষাকালে পানির এই স্রোত থাকে
প্রতি সেকেন্ডে প্রায় পাঁচ মিটার। অর্থাৎ এই নদী দিয়ে সেকেন্ডে ১৫ লাখ
ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। শীতকালে স্রোত কমে যায়, তখন স্রোত থাকে সেকেন্ডে
দেড় মিটারের মতো। ফলে পদ্মা সেতুতে পানির স্রোত যখন দুই মিটারের কম ছিল
তখনই সেতুর নির্মাণ কাজ চালানো হয়েছে। ঠিকাদার বলা হয়েছে, বর্ষাকালে কাজ
করতে পারবে না। কারণ সেখানে কোন বার্জ রাখা সম্ভব হবে না। দেখা গেছে,
স্টিলের তার দিয়ে বার্জ বেঁধে রাখার পরেও সেই তার ছিঁড়ে বার্জ ভেসে গেছে
পানির স্রোতে।
প্রকৌশলীরা বলছেন, বর্ষাকালে নির্মাণ কাজের সময় পদ্মা
নদীতে বার্জ, ড্রেজার ও ক্রেনকে থর থর করে কাঁপতে দেখা গেছে। তাই সেতুটি
এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে এর শক্তিশালী পিলার নদীর প্রবল স্রোতের
তোড়েও টিকে থাকতে পারে।
পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ॥ পদ্মা সেতুর তৃতীয়
চ্যালেঞ্জটি ছিল পরিবেশগত। পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে নদীর পরিবেশ যাতে
ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করারও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য নদীর
স্বাভাবিক গতিপথে কোন বাধা দেয়া হয়নি। নদীকে কোথাও সঙ্কুচিতও করা হয়নি।
সেতুর কারণে পদ্মা নদী ও তার আশপাশের পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে
পারে সে বিষয়ে সমীক্ষা চালানো হয়। তাতে ইলিশ মাছের বিষয়টিকে গুরুত্বের
সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। সবমিলিয়ে, পদ্মা সেতু নির্মাণে পরিবেশের বিষয়টিকে
সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হযেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে
বাস্তবায়ন করা দেশে এটিই প্রথম বড় প্রকল্প। আগামী ১০০ বছরে পদ্মা নদীর ওই
অংশের বৃষ্টি, তাপমাত্রাসহ আবহাওয়ার অন্যান্য বিষয় হিসাব করা হয়েছে। তাতে
দেখা গেছে, আগামী ১০০ বছরে সেখানে ২৬ শতাংশ বৃষ্টি বাড়বে। এতে সেখানে পানির
প্রবাহ ১৬ শতাংশ বাড়বে। বাড়তি পানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেতুর নক্সা
হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পদ্মার পানির উচ্চতা দশমিক ৪
মিটার বাড়তে পারে। এ কারণে সেতুর উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়ানো হয়েছে।
পদ্মা
সেতু নির্মাণের পরিবেশগত জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোন ছাড় দেয়া হয়নি। শুরু
থেকেই ইলিশের যাতে কোন ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়। নদীর
যেসব স্থানে সাত মিটারের বেশি গভীরতা, সেখানে কোন পিলার বসানো হবে না বলে
সিদ্ধান্ত হয়, যাতে সেখানে ইলিশ ডিম পাড়তে ও বিচরণ করতে পারে। নির্মাণকাজ
চলাকালে পুরোটা সময় আমরা এসব তদারকি করা হয়েছে। পরবর্তীতে জরিপ করে দেখা
গেছে, নির্মাণকাজের সময় ইলিশের উৎপাদন কমেনি। সেতুর কারণে কোন বন্য
প্রাণীরা ক্ষতি হয়নি। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ভবিষ্যতেও কোন ক্ষতি হবে না।
জীববৈচিত্র্য
সংরক্ষণে পদ্মা সেতু এলাকায় এক বড় আকারের জাদুঘর করা হয়েছে। সেখানে প্রায়
৫০০ বন্য প্রাণী থাকবে। এই জাদুঘর মূলত শিক্ষার কাজে ব্যবহার হবে। এছাড়া
সেতু এলাকা ঘিরে বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম নির্মাণের কাজও চলছে। মূলত ইলিশসহ
অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিচরণ ও প্রজননের জন্য এই অভয়াশ্রম করা হচ্ছে।
পদ্মা
সেতু বহুমুখী প্রকল্পের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত থাকা পরিবেশ ও জলবায়ু
বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, পদ্মার বুকে সেতু নির্মাণের মহাকর্মযজ্ঞের
সময় যাতে ইলিশ মাছ বিরক্ত না হয় সে দিকটিও খেয়াল রাখা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল পরিবেশের বিষয়ে যাতে কোন ছাড় দেয়া না হয়। সেই
সঙ্গে সার্বিক গুণগতমানের ক্ষেত্রেও কোন ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না।
তিনি
বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের একেবারে শুরু থেকে পরিবেশসহ পারিপাশির্^ক সব
বিষয়কে খুবই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একেবারে শুরু থেকেই খেয়াল রেখেছি, যাতে
নির্মাণকাজ চলাকালে ইলিশ মাছ বিরক্ত না হয়। যেখানে নদীর গভীরতা ২০ ফুটের
বেশি সেখানে ইলিশ মাছ চলাচল করার সময় ওই গভীরতায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে যাতে
ইলিশ মাছ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।
এই পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আরও
বলেন, পদ্মা সেতুর একেবারে নিচ দিয়ে ইলিশ মাছ যাতায়াত করে। আবার শব্দের
তীব্রতা ২০০ ডেসিবেলের ওপরে হলে মাছ সেদিকে এগোয় না। বিশেষ করে এ মাত্রার
শব্দে ইলিশ মাছ উল্টোদিকে চলে যায়। তাই পদ্মা সেতু এলাকায় এসে ইলিশ মাছ
যাতে রাগ না করে, সেজন্য পাইলকে মাফলার দিয়ে মোড়ানো হয়েছিল, যাতে হ্যামার
দিয়ে পেটানোর সময় উচ্চ শব্দ না হয়।
এছাড়াও নদীর পশ্চিম পাশে চর
জানাজাতের কাছে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা এবং এক থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া
একটি চরে প্রচুর কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এই কচ্ছপগুলোর যাতে ক্ষতি না হয়
সেজন্যও তাদের জন্য আলাদা স্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর দক্ষিণে বিশাল
আকারের একটি চরকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
মাছসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী কোন জায়গা দিয়ে চলাচল করছে তার ওপর নজর রাখা
হচ্ছে। সেখানে বিশাল এলাকাজুড়ে দেশী প্রজাতির কয়েক লাখ গাছ দিয়ে বনায়ন করা
হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে যত রেকর্ড ॥ খরস্রোতা পদ্মা নদীতে নির্মিত হয়েছে
পদ্মা সেতু। পানিপ্রবাহের বিবেচনায় বিশ্বে আমাজন নদীর পরই এর অবস্থান।
মাটির ১২০ থেকে ১২৭ মিটার গভীরে গিয়ে পাইল বসানো হয়েছে এই সেতুতে। পৃথিবীর
অন্য কোন সেতু তৈরিতে এত গভীরে গিয়ে পাইল প্রবেশ করাতে হয়নি, যা পৃথিবীতে
রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। দ্বিতীয় রেকর্ড হলো ভূমিকম্পের বিয়ারিং সংক্রান্ত। এই
সেতুতে ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’র সক্ষমতা ১০ হাজার টন। এখন পর্যন্ত
কোন সেতুতে এমন সক্ষমতার বিয়ারিং লাগানো হয়নি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার
ভূমিকম্পে টিকে থাকার মতো করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এর পরের
বিশ্বরেকর্ড হলো পিলার এবং স্প্যানের মধ্যে যে বিয়ারিং থাকে সেটি। এখানে ১০
হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীতে
এর আগে কোন সেতুতে এমন বড় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি। অন্য রেকর্ডটি হলো
নদীশাসন সংক্রান্ত। ১৪ কিলোমিটার (১ দশমিক ৬ কিলোমিটার মাওয়া প্রান্তে ও ১২
দশমিক ৪ কিলোমিটার জাজিরা প্রান্তে) এলাকা নদীশাসনের আওতায় আনা হয়েছে।
এটাও রেকর্ড।
সেতুর বীমাও দেশীয় প্রতিষ্ঠানে ॥ নিজস্ব অর্থে নির্মিত
পদ্মা সেতুর বীমাও করা হয়েছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠানে। ক্ষয়-ক্ষতি ও ঝুঁকি কমাতে
সরকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে (এসবিসি) পদ্মা সেতুর বীমা করা
হয়। এর আগে কখনও কোন বড় প্রকল্পের কোন বীমা দেশীয় কোন প্রতিষ্ঠান পায়নি।
আগে
দেশের বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে বীমা করার জন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে
ধর্ণা দিতে হতো। ব্যতিক্রম হয়েছে পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে। এসবিসির তথ্য
অনুযায়ী, সেতুর ‘রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস’ প্রকল্পের জন্য এর ক্ষয়-ক্ষতি আর
ঝুঁকির কমাতে ১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বীমা পলিসির ইস্যু
করা হয়। ইতোমধ্যে সেতু কর্তৃপক্ষ এই পলিসির বিপরীতে ১৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকার
প্রিমিয়াম দিয়েছে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে।
একইভাবে সেতু নির্মাণ করতে
গিয়ে পদ্মার নদীর স্রোতরক্ষা এবং আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাট তৈরিতে
ক্ষয়-ক্ষতি কমাতে ‘রিভার ট্রেনিং সিস্টেম অব বাথ ব্যাংকস’ প্রকল্পের জন্য
৫৫ কোটি চার লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থের বীমা পলিসিও ইস্যু করা হয় সাধারণ
বীমা কর্পোরেশনের সঙ্গে। এজন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সাধারণ বীমা
কর্পোরেশনকে দিয়েছে ২৫ কোটি ৮৭ লাখ ১৭ হাজার ২৬৯ টাকার প্রিমিয়াম। অর্থাৎ
দুটি প্রকল্পের জন্য প্রিমিয়াম দেয়া হয়েছে ৪২ কোটি ৪১ লাখ ৫১ হাজার ৫০১
টাকা। ফলে দেশীয় কোম্পানিতে বীমা