জুলফিকার নিউটন ||
বাংলা কবিতায় সর্বপ্রথম সজ্ঞানভাবে শব্দের ব্যবহার এবং শব্দের অর্থগত নয়, ধ্বনিগত বিশ্লেষণ করলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ - ২৯জুন-১৮৭৩)। এর আগে বাংলা কবিতা ছিল একটা প্রথাবদ্ধতার মধ্যে সীমাবদ্ধ; হয় তা অতি সরলায়িত ভাষায় নয়ত জটিল তৎসম ভাষায় রচিত হত। কিন্তু ভাষার শব্দগুচ্ছ যেমনই হোক না কেন -তৎসমই হোক বা তদ্ভবই হোক অথবা দেশজই হাকে, কাব্যে তার ব্যবহার-রীতির ক্ষেত্রে একটা বিস্ময়কর পরিবর্তন আনলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এ সম্পর্কে তাঁর কিছু কিছু মন্তব্য তাঁর গ্রন্থের মধ্যেই আছে; আবার কিছু কিছু মন্তব্য আছে তার লিখিত চিঠিপত্রের মধ্যে। চিঠিপত্র ছাড়াও তাঁর কবিতায় বিভিন্ন সূত্রে স্বগতোক্তিরূপে প্রসঙ্গটি ফিরে ফিরে এসেছে। মেঘনাদবধ কাব্যের শুরুতেই কবি বলেছেন, তিনি এমন একটি ভাষায় এই কাব্য রচনা করবেন, “গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি”। গৌড়জনের আনন্দের জন্য তিনি একটি কাব্যকর্ম নির্মাণ করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এবং এই নির্মাণকর্মে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিচয় বন্ধুদের কাছে লেখা তাঁর চিঠিপত্রে পাওয়া যায়। কখনও একটি চরণ উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, এই চরণটি যথাযথ হয় নি। পরের একটি চরণ পরীক্ষা করে বলেছেন, এ চরণের সর্বশেষ শব্দটি তার ধ্বনিগত সাম্যে পূর্ববর্তী চরণে ব্যবহৃত শব্দের ধ্বনিকে বহন করে না। সুতরাং সেই শব্দ পরিবর্তন করে অন্য একটি শব্দ তিনি ব্যবহার করতে চান। মধুসূদনের পূর্বে শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে এরূপ সচেতন চিন্তা একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। তাই একজন বিখ্যাত ভারতীয়। পণ্ডিত ও কবি বাৎসায়ন তার হিন্দি কাব্যের সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় মধুসূদন সম্পর্কে বিস্তৃত উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মধুসূদন শুধু বাংলা ভাষায় নতুনত্ব এনেছেন, তা-ই নয়, মধুসূদন কাব্য রচনা না করলে ভারতের অন্যান্য ভাষার কাব্যসাহিত্যেও পরিবর্তন ঘটত না। মধুসূদনই কবিতাকে তার প্রথাগত বন্ধন হতে মুক্ত করে তার একটি স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র নির্মাণ করেছেন।
আমরা যদি মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' থেকে আরম্ভ করে ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব যে, সেই প্রথম থেকেই সজাগ অনুভূতিতে কবি চেষ্টা করে গেছেন একটি পরিচ্ছন্ন ছন্দ প্রক্রিয়া নির্মাণের জন্য। তিনি ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' একবার লিখে দ্বিতীয়বার আবার সংশোধন করে লেখা আরম্ভ করেছিলেন। পরে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ এক বিরাট কর্মে হাত দিলেন; তারও পরে রচনা করেন বীরাঙ্গনা কাব্য’। বীরাঙ্গনা কাব্যের মধ্যে তার শব্দ ব্যবহার কৌশলের পূর্ণ স্ফুর্তি ঘটল। একজন কবি যথার্থ শিল্পী হয়ে শব্দ চেতনাকে কিভাবে প্রকাশিত করলেন, কিভাবে ব্যাখ্যা করলেন তার আশ্চর্য নিদর্শন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য থেকে আরম্ভ করে চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ পর্যন্ত এসে সম্পূর্ণ হয়েছে, দেখতে পাই। মধুসূদনের কাব্য সাধনার এই ধারাক্রমটির বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন আছে। মধুসূদনের প্রবর্তিত দুটি পরিবর্তন আলোচিত হয়েছে। প্রথমটি হল শব্দ সম্পর্কে সচেতনতা এবং দ্বিতীয়টি হল, শব্দের ধ্বনিকে ঠিক পার্শ্ববর্তী শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত করা নয়, পরবর্তী চরণ এবং আরও পরের অন্য চরণের মধ্যে প্রবহমান করা। তৃতীয় যে পরিবর্তন মধুসূদন এনেছিলেন, আমরা সকলেই জানি, সেটা ছন্দের ক্ষেত্রে। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ-ও এক বিস্ময়কর ঘটনা। কেননা তার পূর্বে পয়েরের যে ভঙ্গিটা ছিল সেখানে ৮ আর ৬ মাত্রায় একটা নিয়মিত বন্ধন ছিল। দুই চরণের মধ্যে সমস্ত বন্ধনটা চিরকাল আবদ্ধ হয়েছিল। সেখানে অর্থের ব্যাপ্তিটা প্রথম চরণে অংশত এবং দুটো চরণ মিলে সম্পূর্ণ হতো। দুটো চরণের চরণ-দ্বৈতের মধ্যেই অর্থের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ঘটত। দুটো চরণের এ রীতিটি ছিল বাংলা কাব্যের স্বাভাবিক প্রথা। বাংলা কবিতার ছন্দে এ প্রথাটিই চিরকাল চলে এসেছিল, যেখানে দুটি চরণে একটি পূর্ণ বক্তব্য প্রকাশিত হত:
মহাভারতের কথা অমৃত সমান। “কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান”। এখানেই বক্তব্য শেষ হয়ে গেল এর পরবর্তী কথাগুলো আগের কথাগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কোন অসুবিধা নেই, আবার না থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। এ দুটি বাক্যের অর্থ নির্ণয়ে পূর্বাপর বাক্যের কোন ভূমিকা নেই। সুতরাং যাকে প্রবহমান বলা যায় তা মধুসূদনের পূর্বে বাংলা কবিতার ছন্দে ছিল না। কি করে তিনি বাংলা কবিতার ছন্দকে প্রবহমান করলেন? এ জিজ্ঞাসার জবাব দিতে হলে সংস্কৃত ছন্দের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হয়, সংস্কৃত কবিতায় চরণের অন্তে মিল নেই, অন্ত্যমিল নেই ধ্বনিগত সাম্যে। তবে চরণে মাত্রা গণনায় চরণে চরণে সাযুজ্য আছে। কিন্তু সেখানে দুটি চরণ মিলেই একটি বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয়ে যায় না। অন্ত্যমিল না থাকার ফলে একটা প্রবহমানতা চরণান্তরে সঞ্চারিত হয়। সংস্কৃত 'রঘুবংশ' কাব্য পাঠ করলে তার বিভিন্ন উপমা দেখে বিস্মিত হতে হয়। সেখানে একটি উপমা দুটি চরণে শেষ হয় না। মাঝে মাঝে উপমাগুলো তিনটি চারটি চরণে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে সম্পূর্ণ হয়েছে। উদাহরস্বরূপ সেখানে ইন্দুমতী স্বয়ংবর সভায় এসে উপস্থিত হয়েছে। সেই অংশটি কথা বলা যেতে পারে। স্বয়ংবর সভায় রাজা ও রাজপুত্ররা বসে রয়েছেন ইন্দুমতী এসে মাল্যদান করবেন বলে। এখানে কালিদাস তার বর্ণনায় বলেছেন অন্ধকার রাত্রে একটি সঞ্চরমান প্রদীপ শিখা অট্টালিকা সমূহের সম্মুখ দিয়ে যখন যায় তখন যে অট্টালিকার সম্মুখে প্রদীপটি থামে সেই অট্টালিকা আলোকিত হয়; কিন্তু অগ্রসরমান প্রদীপের পশ্চাতে ফেলে যাওয়া অট্টালিকাটি অন্ধকারাচ্ছন হয়ে যায়। তেমনি রাজকুমারী ইন্দুমতী যখন কোন রাজপুত্রের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তখন সেই রাজপুত্রের মুখ আলোক-উদ্ভাসিত হচ্ছে; কিন্তু তাঁকে অস্বীকার করে রাজকুমারী যখন এগিয়ে যাচ্ছেন তখন সেই রাজপুত্রের মুখ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। এভাবে একটি উপমাকে দীর্ঘ কয়েকটি চরণের মধ্যে প্রবহমান করে দিয়ে কবি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কালিদাসের ‘মেঘদূত’ বা ‘পুষ্পবাণ'- এর বিভিন্ন উপমা বহুল প্রশংসিত, কিন্তু রঘুবংশ কাব্যে কালিদাসের কথকতার যে বিস্তার, ধ্বনির যে বিস্তার বা উপমার যে বিস্তার তা অসাধারণ। বাংলা কোন কাব্যেই এরকম কুশলতা লক্ষ করা যায় না। বাংলায় রামায়ণের যে অনুবাদ হয়েছে, তাতে বাল্মীকির মহাকাব্য রামায়নের স্বাদ পাওয়া যায় না। তেমনি বাংলায় মহাভারতের যে অনুবাদ হয়েছে তাতেও মূল মহাভারতের ছাপ নেই। মহাকাব্যের অনুবাদে বাঙালি কবিরা বাংলার প্রথাগত ছন্দ প্রকরণই গতানুগতিকভাবে অনুসরণে করে গেছেন। মধুসূদন সেই ছন্দ প্রকরণকে ছাড়িয়ে নতুন এক ছন্দ নিয়ে এলেন বাংলা সাহিত্যে। একারে্য তিনি একই সঙ্গে সংস্কৃত কাব্য এবং প্রাচীন গ্রিক ও ফরাসি এপিক কাব্য থেকে সমর্থন পেয়েছেন। ইংরেজ কবি মিলটনের কাব্যে ইংরেজি এপিকের যে প্রবহমানতা দেখা যায় তাও মধুসূদনকে উদ্দীপ্ত করেছিল। কাব্য জগতে তাঁর সাধিত এই নিঃসংশয় বিপ্লব একমাত্র বঙ্কিমচন্দ্রের নিকট প্রতিভাত হয়েছিল। মধুসূদনের মৃত্যুর পরপরই বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, বাঙালির কিছু নেই, এ কথা বলা যাবে না। কারণ বাঙালির শ্রীমধুসূদন আছে। শ্রীমধুসূদনই বাঙালিকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বুঝেছিলেন যে মধুসূদন বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন, বিশ্বের কাব্যমঞ্চের পরিপ্রেক্ষিতেও সে পরিবর্তন সামান্য নয়, অতি সহজও নয়।
বাংলা কাব্যের ভুবনে মধুসূদনের পরে যদি রবীন্দ্রনাথ না আসতেন তাহলে আধুনিক কবিতা আমাদের দেশে যথার্থভাবে মর্মরিত হতে পারত না। মধুসূদনের কাব্যধারা এবং রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবকে একত্রে বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথ মধুসূদনের বিরোধী ছিলেন বলে মনে হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের কিশোর বয়সের অনেক উক্তিতে মধুসূদনের বিরোধিতা আছে। পরবর্তীকালেও ছন্দ নিয়ে আলোচনাকালে রবীন্দ্রনাথ মধুসুদনের মেঘনাদবধ কাব্যের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু মধুসূদনের বহুবিধ উপমা, ব্যবহৃত শব্দ, ব্যবহৃত রং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় লক্ষ করা যায়। রবীন্দ্রনাথ যেখানে অন্ত্যমিল রক্ষা করেই ছন্দকে প্রবহমান রেখেছেন সেখানেও রবীন্দ্রকাব্যে মধুসূদনের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। সুতরাং বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে শব্দ ব্যবহার এবং ছন্দ প্রকরণ উভয় দিক থেকেই আধুনিকতার প্রবর্তন করেছেন মধুসূদন। তাই মধুসূদনের মূল্যায়ন না করে আধুনিক বাংলা কবিতার আলোচনা অগ্রসর হতে পারে না।
পূর্বকালের সাহিত্যে, আমাদের দেশে, উপমাগুলো ছিল অনেকটা স্কুল এবং মূলতঃ বস্তুগত। সে উপমা ছিল একটি বস্তুর সঙ্গে আর একটি বস্তুর । যে বস্তুর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় আছে সেই বস্তুর সঙ্গে অন্য একটি দৃশ্যমান বস্তুর দৃশ্যমানতার সাজুয্যে একটি নতুন বস্তুর পরিচিতি পাঠকের করা হত। যদি ধরা যায় একটা ট্রেনের গতির সঙ্গে একজন মানুষ দৌড়ে যাচ্ছে তবে দুটোর মধ্যে একটা দৃশ্যমানতার সাজুয্য আছে বলা যায়। প্রাচীন ও মধ্য যুগে এ ধরনের উপমা ব্যবহারের রীতি ছিল। মধ্যযুগে বস্তুকে মহার্ঘ করার চেষ্টা কর হত মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে। একটা অট্টালিকার বর্ণনা দিতে হলে তার সোনার স্তম্ভ, হীরকের ছাদের কথা উল্লেখ করা হত। দৃশ্যমান বস্তুর সঙ্গে দৃশ্যমান বস্তুর তুলনা করে উপমা নির্মাণের মধ্যযুগীয় রীতি মধুসূদন অনুসরণ করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু উপমা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি বস্তুর প্রাণ-চৈতন্যের উপমা দিয়েছেন। যে বস্তু দৃশ্যমান নয়, যে বস্তু অনুভবের, যে বস্তুকে স্পর্শ করা যায়, এমনকি দেখাও যায় না, উপমার সাহায্যে মধুসূদন সেই বস্তুরও প্রতীতি পাঠকের মনে জাগিয়েছেন।
আধুনিককালে টি.এস.এলিয়ট তার ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ বলেছেন, কে আমার পশ্চাতে হাঁটছে? কেউতো আমার পশ্চাতে হাটছে না। কিন্তু আমি পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি।" এই যে পদশব্দ’ -এর সাহায্যে কবি ভয়সূলভ অনুভবকে বোঝাতে চেয়েছেন। শীতপ্রধান দেশে শুভ্র বরফে সবকিছু ঢাকা পড়ে গেছে, যেন বরফের একটা মরুভূমি। একটিও লোক নেই সেই শুভ্র মরুভূমিতে। তার মধ্যে একটি লোক দাড়িয়ে আছে একা । তার ভয় হচ্ছে আর সেই ভয়টাকে প্রকাশ করার জন্য তার পেছনের অদৃশ্য পদশব্দের কথা বলা হচ্ছে। পদশব্দের সঙ্গে দৃশ্যমান হচ্ছে একটি পা, দুটি পা। মানুষের পা দুটি দৃশ্যমান হলেও পদশব্দ কিন্তু দৃশ্যমান নয়। একটি মানুষ হেঁটে যাচ্ছে-এই কল্পনা থেকে হেঁটে যাওয়ার শব্দ বা পদশব্দ অনুভব করা যায় । সুতরাং একটি অনুভূতি যে অনুভূতি ভয় জাগায় সেই অনুভূতিকে প্রাণময় করার জন্য কবিকে পদশব্দের উপমা দিতে হচ্ছে। নইলে ভয়ের অনুভূতি প্রাণময় হয়। বাংলা কাব্যে এ ধরনের প্রাণময় উপমা মধুসূদনই প্রথম দিয়েছেন। ‘মেঘনাদবধ কাব্যের শুরুতে এক জায়গায় আছে রাবণের পুত্র নিহত হয়েছে। এ সংবাদ রাবণের কাছে এলে হাহাকার করে ক্রন্দন করছেন। তখন তার মন্ত্রীরা তাঁকে প্রবোধ দিচ্ছেন এই বলে, 'আমরাইত তোমার পুত্র। শত পুত্র তোমার রয়েছে, তুমি দুঃখ পাচ্ছ কেন? উত্তরে রাবণ বললেন,
--হৃদয়-বৃন্তে ফুটে যে কুসুম/ তাহারে ছিড়িলে কাল, বিকল হৃদয়/ ডোবে শোক-সাগরে, মৃণাল যথা জলে/ যবে কুবলয় ধন লয় কেহ হরি।”
কুবলয় হচ্ছে পদ্ম, মৃণাল পদ্মের ঊর্টা। পদ্মটি যদি ছিড়ে নেয়া হয়, মৃণালটা জলে ডুবে যায়। তেমনি হৃদয়বৃন্তের পুষ্প হচ্ছে পুত্র, সেই পুত্র যদি নিহত হয় তাহলে হৃদয়বৃন্ত শোক সাগরে ডুবেই যাবে। পুত্র হত্যার পর বেদনা ও আর্তি বিমিশ্রিত রাবণের ভয়ঙ্কর একটি আর্তনাদ প্রাণময় হয়েছে এই অনন্য উপমার সাহায্যে। আমি মনে করি, শুধু বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্ব সাহিত্যে অনুরূপ চরণ খুব কমই আছে।
আধুনিককালে আর একটি বড় কথা কবিতা সম্পর্কে বলা হয়; কবিতা মানুষের চৈতন্যকে প্রকাশ করে। আমাদের কতকগুলো অনুভূতি আছে ; যেমন স্পর্শের অনুভূতি, স্বাদের অনুভূতি) শ্রবণের অনুভূতি, দর্শনের অনুভূতি। এ সকল অনুভূতির প্রকাশের জন্য আধুনিক কবিরা ব্যাকুল। আমাদের দৃষ্টির অনুভূতির সঙ্গে বিভিন্ন রংও সম্পৃক্ত। আগেকার দিনে কবিরা লাল রংটাই প্রচুর ব্যবহার করেছেন। লাল রংটা তাদের চোখে বেশি ধরা পড়েছিল। মধুসূদন, পরে রবীন্দ্রনাথও কাব্যে লাল রংটা বার বার নিয়ে এসেছেন। কিন্তু মধুসূদনের কাব্যে লাল রং -এর প্রয়োগটা মবহবৎধষ বা সাধারণ নয়, বরং ঝঢ়বপরভরপ বা বিশেষ। অন্ধকার রাত্রে একটি গৃহে যখন আগুন জ্বলল তখন সেটা অত্যন্ত ঝঢ়বপরভরপ বা বিশেষ । রাত্রে চতুর্দিকে যখন অন্ধকার তখন লাল রংটা বেশি দেখা যায়। রংকে বিশেষভাবে সনাক্তকরণ (ঝঢ়বপরভরপ রফবহঃরভরপধঃরড়হ ড়ভ পড়ষড়ঁৎ) আধুনিক কালের নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অতঃপর অনেক রং এসেছে হলুদ এসেছে, নীল এসেছে এমনকি অন্ধকারের কালো রংটাও এসেছে। তোমার খড়গ আঁধার -মহিষে দুখানি করিল কাটিয়া।” কবি অন্ধকারকে কালো মহিষের সঙ্গে উপমিত করেছেন, অন্ধকারের রংকে বিশিষ্টভাবে অনুভব করিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ যে অন্ধকার প্রবল সেই প্রবল অন্ধকার ‘মেঘনাদবধ কাব্যে' ও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়। মেঘনাদবধ কাব্যের প্রতিটি সর্গে ঘটনাগুলো রাত্রিকালের। রাত্রিকালের অন্ধকারের মাঝে আলোকোজ্জ্বল অট্টালিকাগুলো সহজেই চোখে পড়ে। রাত্রির অন্ধকারের মাঝে যেমন অন্যায় কর্ম সাধিত হয়, তেমনি অন্ধকার রাত্রের বিদ্যুৎ আলোকে অন্যায়কে দেখা যায় প্রত্যক্ষভবে। এভাবে রং-এর ব্যবহারের রয়েছে বিচিত্র দিক। মাইকেল মধুসূদন তা অনুভব করে রং-এর বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শের অনুভূতি, স্বাদের অনুভূতি তাঁর কাব্যে আনলেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাব্যে, তারও পরে জীবনানন্দ দাশের কাব্যে আমরা এ সকল অনুভূতি বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করেছি, অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে।