জুলফিকার নিউটন ||
আমি ভাবতাম
সময়কে কখনো সংক্ষিপ্ত করা যায় না অথবা শাসন করা যায় না। সময় কতগুলি
পদক্ষেপমাত্র। এ সমস্ত পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমরা একটি প্রভূত সময়ের
বৈকুণ্ঠের মধ্যে প্রবেশ করবো। আমার সত্যি সত্যি ধারণা ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়
হচ্ছে অফুরন্ত সময়ের ভাণ্ডার। সোপান শ্রেণী অতিক্রম করে একবার এই
ভাণ্ডারের মধ্যে প্রবেশ করতে পারলেই সময়ের মধ্যে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত
দেখতে পাবো।
বাবার কাছে সময়ের ব্যাখ্যা শুনতাম। তিনি বলতেন, সময়ের
সদ্ব্যবহার করা প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য। একজন সুফীকে তার শিষ্যরা জিজ্ঞেস
করেছিল জ্ঞান কি? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, জ্ঞান হচ্ছে সময়। শিষ্যরা অর্থ
বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করেছিল, প্রভু, এর অর্থ তা বুঝলাম না। সুফী
উত্তর করেছিলেন, ‘নিরন্তর আমরা সময়ের মধ্যে যাত্রা করছি, সময় অতিক্রান্ত
হচ্ছে এবং অবশেষে পৃথিবীতে আমাদের সময়কাল শেষ হচ্ছে। সত্যিকার জ্ঞান
হচ্ছে-সদিচ্ছায় ব্যবহার করা এবং আল্লাহর চিন্তায় ব্যয় করা । সময় সম্পর্কে
জ্ঞান অর্থাৎ ইলম-ই ওয়াকত মানুষের জন্য অপরিহার্য। এর একটি বহিঃপ্রকাশ আছে
যা আমাদের কর্মের ব্যস্ততায় ধরা পড়ে, আবার একটি অন্তর্নিহিত স্বরূপ আছে যা
চিত্তশুদ্ধি এবং উপলব্ধির অভিজ্ঞানে ধরা পড়ে। কিন্তু বাইরের কর্মব্যস্ততা
অন্তরের ধ্যাননিমগ্নতার সঙ্গে যদি যুক্ত না হয় তাহলে নিছক কর্মব্যস্ততায়
সময়ের অপলাপ এবং অপহরণ ঘটে। তিনিই যথার্থ জ্ঞানী যিনি সময়কে শুভ তাৎপর্যে
বিকশিত করেন।
সময়কে অনুভব করবার অনেকগুলো ব্যাখ্যাসূত্র সুফীরা দিয়ে
থাকেন। একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে সময়ের ব্যবহারের দুটি প্রকৃতি আছে, একটি হচ্ছে
প্রাথমিক এবং অন্য একটি হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়ের। প্রাথমিক প্রকৃতির
বহিঃপ্রকাশে বিশ্বাসের দৃশ্যগত আচরণ রূপ লাভ করে, এবং অভ্যন্তরীণ রূপসজ্জায়
আত্মবোধ অভিজ্ঞাত হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের বহিঃপ্রকাশে বিনয়ের আচরণ রূপলাভ
করে, এবং অভ্যন্তরীণ রূপসজ্জায় ইচ্ছার সততা সম্পর্কে বোধ জাগে।
কিন্তু
কখনই বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গ অভিব্যক্তি একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয় বরঞ্চ
একে অন্যের সম্পূরক। আমার অন্তরের বিশ্বাস বাইরের আচরণে প্রকাশ পাবে, তেমনি
বাইরের আচরণ অন্তরের অভিপ্রায়কে লালন করবে।
অনন্ত জীবনের আকাঙক্ষা
থাকলেও মানুষ একটি সময়ের বৃত্তের মধ্যে বাস করে যা অতিক্রম করা তার পক্ষে
সম্ভব হয় না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনবৃত্তের যে ঘূর্ণায়মান। পরিধি
আমরা তার মধ্যেই আবদ্ধ থাকি। একমাত্র জ্ঞানের সাহায্যেই এই পরিধি অতিক্রম
করা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রবেশ করি তখনই
বিশ্বজ্ঞানের এ পরিচয় উন্মোচিত হয়। আমার সংকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের
সেই অনন্ত মুক্ততার ইঙ্গিত বহন করতো। মনীষী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান চাকসুর
সাহিত্য উৎসব ৯০’তে একটি বক্তৃতা করেছিলেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল সম্ভবত
বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ^জ্ঞ্যান। তাঁর বক্তৃতার মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে আমি মুগ্ধ
হয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয় মানুষকে শিক্ষা দেয় যে
পৃথিবীকে সমগ্রভাবে দেখতে হবে আংশিকভাবে নয়। পৃথিবী শুধু মানুষের নয়,
পৃথিবী খনিজ দ্রব্যের, গাছপালার, জন্তু জানোয়ার এবং মানুষের। এই চারটি
ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবের রাজ্য হলেও এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।
বিশ্বজ্ঞানের সাহায্যে আমরা এই সম্পর্কের ভূমিকার মধ্যে প্রবেশ করি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নানাবিধ গল্প বলে প্রাণকণার বৈশিষ্ট্য এবং মানুষে
মানুষে সম্পর্ক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি জীবন, চেতনা এবং আত্মবোধের
কথা বলেছিলেন মনে পড়ে। গৌতম বুদ্ধের জীবনী পাঠ করে আমি তৃষ্ণা শব্দটির একটি
বিশেষ অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম আরো পরে। তখন জেনেছিলাম যে মানুষের জীবন আছে,
জীবনের অতিরিক্ত চেতনা আছে এবং সর্বোপরি আত্মবোধ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে
প্রবেশ করেই আমরা একটি চৈতন্যলোকে প্রবেশ করবার অধিকার পাই।
যেদিন আমি
প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি সেদিনটির কথা আমার খুব মনে আছে। সকালের
দিকে বৃষ্টি নামলেও দশটার দিকে আকাশ পরিষ্কার ছিল। গাছপালা বৃষ্টিতে
পরিচ্ছন্ন হয়েছিল এবং সকালের স্নিগ্ধ রৌদ্রে ঝিকমিক করছিল। বিশ্ববিদ্যালয়
কলা ভবনের উত্তর দিক দিয়ে যে প্রবেশের পথটি ছিল সে পথ দিয়ে আমি প্রবেশ
করেছিলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপর তলায় উঠবার সময় মনে হয়েছিল আমি একটি নতুন
সম্ভাবনার মধ্যে প্রবেশ করছি। উপরে উঠবার সিড়িটি ছিল খুবই প্রশস্ত, একসঙ্গে
অনেকে উঠতে পারতো। কিন্তু আমি তখন ভেবেছিলাম আমিই বোধহয় একা উপরে উঠছি।
অনেকের মধ্যে এই একাকীত্বের অনুভূতিটা আমার চিরকালই আছে। কিন্তু এর উদ্ভব
বোধহয় খুবই সুস্পষ্টভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের প্রথম দিনে ঘটেছিল। এর
কারণ বোধহয় যারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল সেদিন তাদের কাউকেই আমি চিনতাম না।
আমি আমার নিজের চিন্তায় নিমগ্ন ছিলাম। একটি নতুন প্রত্যয়ে উপনীত হবার জন্য
আমি সে দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটি নতুন সময় ও আনন্দকে
প্রত্যক্ষ করছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে যে দাক্ষিণ্য একজন
যুবককে আনন্দিত করে তা হচ্ছে রমণীর সান্নিধ্য। স্কুল এবং কলেজে ছেলে এবং
মেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন থাকে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেণীকক্ষে ছেলে এবং মেয়ের
সম্মিলন একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থাপনা। নবযুবকের দৃষ্টিতে সংকোচ, শঙ্কা এবং
কৌতুহল থাকে। অপর পক্ষকে আপন কণ্ঠস্বর শোনাবার আকাঙ্ক্ষা জাগে এবং
ক্লাসকক্ষের বাইরে হঠাৎ দু একটি বাক্যালাপের সুযোগ সময়কে যেন উৎফুল্ল করে।
সাহিত্যকর্মে
বিশ্বাস সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থাৎ কোনো একটি আদর্শে বিশ্বাস অথবা ধর্মে
বিশ্বাস অথবা দেশের স্বার্থে বিশ্বাস। সাহিত্য যদি ব্যক্তিগত স্বার্থের
কর্মকেন্দ্র হয় তাহলে সাহিত্য সফল হয় না। সাময়িক স্বস্তি বা প্রতিষ্ঠা আসতে
পারে বটে কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের মাধ্যমে সাহিত্যের বিস্ময় বা অভিবাদন
নির্মিত হয় না। আমরা যখন সাহিত্য পরিষদ গঠন করি তখন আমরা আমাদের সমাজের
কথা চিন্তা করেছিলাম এবং ভবিষ্যতের শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করার কথা চিন্তা
করেছিলাম। তার মধ্যে কোনোরূপ ভেজাল ছিল না।
যে কবি মহৎ কবি বলে স্বীকৃত
এবং সর্বত্র শ্রদ্ধার সঙ্গে অর্চিত সে কবির কাব্য পরীক্ষা করা দুরূহ কর্ম।
কাব্য পরীক্ষা একটি বিচার, একটি মীমাংসা এবং শব্দ প্রয়োগ-বিধির মধ্যে
জীবনের অবস্থিতি আবিষ্কার। যাকে আমরা শ্রদ্ধা করি তাকে মূলত শ্রদ্ধার সঙ্গে
দূরেই সরিয়ে রাখি। একই কারণে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় যে সমস্ত
আলোচনা হয়েছে তার অধিকাংশই দেব-বন্দনার স্তোত্রের মত মনে রাখতে হবে যে কবি
মহাপুরুষ নন, দেবতা নন অথবা ভগবানও নন। সুতরাং বিশ্লেষণ-পরানুখ হয়ে কবিকে
আবিষ্কার করা যায় না। কবিকে আবিষ্কার করতে হবে তাঁর শব্দ প্রয়োগের মধ্যে যে
শব্দ প্রয়োগ দ্বারা তিনি একটি রসাবেশ সৃষ্টি করেছেন। বিদেশে কবিকে একই
সঙ্গে শিল্পী এবং স্রষ্টা হিসাবে বর্ণনা করা হয়। তাই শিল্পীর দক্ষতা
পরীক্ষা করতে তাদের কখনও দ্বিধা হয় না। রবীন্দ্র-আলোচনায় অগ্রসর হবার
পূর্বে আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের বাংলা
ভাষার একজন কুশলী কবি। সুতরাং বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার কাব্যে শ্রেষ্ঠত্ব
প্রতিপাদন করতে হবে। বক্তব্যের দ্বারা কবির রহস্য নির্ণয় করা যায় না। অথবা
কবিতার তাৎপর্য আবিষ্কার করা যায় না, বক্তব্যের যা অবলম্বন অর্থাৎ যাকে
অবলম্বন করে বক্তব্য অভিষিক্ত হয়েছে সেই শব্দকে পরীক্ষা করেই কবিতার
তাৎপর্য নির্ণয় করতে হয়। যেমন দেহকে অগ্রাহ্য করে চিন্তার স্থিতি নেই,
তেমনি শব্দকে অগ্রাহ্য করে বাণীর প্রকাশ নেই। গৌতম বুদ্ধ দেহ এবং চিত্ত
পরস্পর সাপেক্ষ বলেছেন। তিনি বলেছেন যে দেহ হচ্ছে চিত্তের অবলম্বন এবং
চিত্ত হচ্ছে দেহের অবলম্বন।
বস্তুত এই অবলম্বন গ্রহণ এবং তার প্রতি
চিত্তের ধারণার উপরই চিত্তের কুশলা কুশল নির্ভর করে। বুদ্ধের বিবেচনায়
চিত্ত রূপ, শব্দ এবং গন্ধের অবলম্বনে উৎপন্ন হয় । সংক্ষেপে বলা যায়,
চিত্তের অনুভূতি দেহের উপর নির্ভরশীল আবার দেহের বিবিধ প্রকার বিবেচনাও
চিত্তের অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল। মানুষের ক্ষেত্রে যেমন দেহ এবং চিত্ত,
কবিতার ক্ষেত্রে তেমনি শব্দ এবং ভাব অর্থাৎ শব্দকে অবলম্বন করেই ভাবের
উৎপত্তি এবং শব্দকে সর্বতোভাবে গ্রাহ্য করেই ভাবের প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ
তদগত কবি ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং সজাগ কুশলী শিল্পী ছিলেন। তাই
রবীন্দ্রনাথের কাব্য পরীক্ষা করতে গিয়ে আমাদের রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক কবিতায়
শব্দ ব্যবহারের কৌশল এবং দক্ষতা বিশেষভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এই
পরীক্ষা দ্বারাই আমরা প্রমাণ করতে পারব যে রবীন্দ্রনাথ কবিতার ক্ষেত্রে
যথার্থ অসাধারণ ছিলেন।
একটি ভাষার কাব্যধারার কোনও কবিই একাকী নন
অর্থাৎ উক্ত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনও কবিকেই বিশ্লেষণ করা চলে না।
তাঁর বিশিষ্টতা, তাৎপর্য এবং শ্রোত্রবোধ যে ভাষার তিনি কবি সে ভাষার অতীতের
সকল কবির কাব্যকীর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। ইতিহাসের দিক থেকেই এ সম্পর্ক নয়,
কবিতার সৌন্দর্যবোধের দিক থেকেও এ সম্পর্ক নিগূঢ়। যখনই একটি ভাষার একজন
মহৎ কবির আবির্ভাব ঘটে তখনই সঙ্গে সঙ্গে নতুন নিরিখে অতীতের প্রধান প্রধান
কবির মূল্যায়ন আরম্ভ হয়।
বাংলা কবিতায় একবার বিরাট চাঞ্চল্য এসেছিল।
মাইকেল মধুসূদনের আবির্ভাবের সময়। মধুসূদনের কাব্য পাঠ করে আমরা নতুন
তাৎপর্যে কৃত্তিবাসকে আবিষ্কার করেছিলাম আরও আবিষ্কার করেছিলাম নতুন
লালিত্যে বৈষ্ণব পদকর্তাদের। মধুসূদনের শব্দ-ব্যবহার, উপমা রূপক প্রেেয়াগ
বাংলা কবিতার জন্য বহুলাংশে নতুন ছিল। এই নতুনত্বের স্বাদ পেয়ে আমরা
পশ্চাতের দিকে দৃষ্টিপাত করেছি। এই তুলনায় অতীতের কবিরা নতুন বিচারের
সম্মুখীন হয়েছেন, যার ফলে সমগ্র বাংলা কাব্যসাহিত্য সম্পর্কে আমাদের নতুন
বিবেচনা আরম্ভ হয়েছিল। বিশেষ করে কৃত্তিবাসের রামায়ণ যা এতদিন পর্যন্ত
বটতলার পুঁথি হিসাবে গ্রাহ্য ছিল। মধুসূদনের আবির্ভাবের পর তা নতুন
তাৎপর্যে উন্মোচিত হল। এভাবে 'ব্রজাঙ্গনা সৃষ্টির ফলে বৈষ্ণব পদাবলী নতুন
আলোকে উদ্ভাসিত হল। আমরা শ্রী রাধিকাকে আরো অন্তরঙ্গভাবে পেলাম অথবা বলা
যায় একটি নতুন পরিমণ্ডলের মধ্যে পেলাম। ঠিক এইভাবে রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা
কাব্য ক্ষেত্রে নতুন শক্তি নিয়ে প্রকাশিত, তখন রবীন্দ্রনাথের কারণে সমগ্র
বাংলায় একটি নতুন বিবেচনা আরম্ভ হল। আমরা বৈষ্ণব গীতি কবিতাকে নতুনভাবে
আবিষ্কার করলাম। সংস্কৃত কাব্য নতুনভাবে রূপময় হল। রবীন্দ্রনাথের
আবির্ভাবের ফলে বাংলা কাব্যে এই বিপুল প্রসারী পরিবর্তন ঘটেছিল।
রবীন্দ্রনাথের কারণে আমরা অতীতকে নতুন করে প্রত্যক্ষ করলাম এবং কবিতার যে
স্রোতধারার সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটেছিল সেই স্রোতধারায় আবার নতুন করে
প্রবাহিত হলাম। এই কারণে রবীন্দ্রনাথের কাব্য বিচারের সময় সমগ্র বাংলা
কাব্যের অতীতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নির্ণয় করতে হবে। এই সম্পর্ক
নির্ণয় না করে রবীন্দ্রনাথকে যথার্থভাবে জানা সম্ভবপর হবে না।
রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবের পূর্বে বাংলা কবিতার অতীত সম্পর্কে আমরা
যথার্থরূপে সজ্ঞান ছিলাম না!
এই অতীত এক একটি রূপমণ্ডলে আমাদের সামনে
আবির্ভূত হত, আমরা সমগ্রভাবে আমাদের কাব্যের অতীতকে প্রত্যক্ষ করতে পারি
নি। রবীন্দ্রনাথের কাব্য পাঠের ফলে আমাদের মানসলোকের পরিবর্তন ঘটল এবং আমরা
সমগ্র বাংলা কাব্যকে একটি ক্রমধারার মধ্যে আবিষ্কার করতে শিখলাম। এটা সত্য
যে যুগে যুগে ভাষার পরিবর্তন ঘটে, এটা অধিকতর সত্য যে যুগে যুগে মানুষের
চিন্তাধারারও পরিবর্তন ঘটে, এক যুগে যা গ্রহণযোগ্য এবং রুচিসম্মত অন্য যুগে
তা হয়ত নীতিবিরোধী কিন্তু তৎসত্ত্বেও একটি ভাষার কাব্যধারার অতীত থেকে
বর্তমান পর্যন্ত একটি নিগূঢ় রহস্যময় সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্ক কবিতার
ধ্বনির সাহায্যে নির্মিত কাব্যের মানস প্রতিমা। রবীন্দ্রনাথের কাব্য পাঠের
ফলে আমাদের কাব্য-বোধের প্রসার ঘটেছে। আমরা পূর্বে যে সমস্ত চিন্তা এবং
আবেগের দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলাম, রবীন্দ্রনাথের কাব্য পাঠের ফলে সেই আচ্ছন্নতা
থেকে মুক্ত হলাম। এই যে নতুন করে আমাদের মধ্যে একটি বোধের প্রসারতা ঘটল,
এটা ঘটল রবীন্দ্রনাথের কারণে। এর ফলে রবীন্দ্রনাথের কাব্যকে গ্রহণ করার
সঙ্গে সঙ্গে বাংলার অতীতের কাব্যধারার সম্পর্কে আমাদের বিবেচনার আমূল
পরিবর্তন হল। রবীন্দ্রনাথ সমগ্র বাংলা কাব্যের ওপর এইভাবে তাঁর স্বাক্ষর
রেখেছেন।