নিজস্ব প্রতিবেদক: ফেরারি জীবনে এক সময় তাড়া করে ফিরত আতঙ্ক আর মৃত্যুভয়। সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে দস্যু দলের সঙ্গে দুর্র্ধষ জীবনের ইতি ঘটিয়ে এবার প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে হয়েছে তার শান্তির নীড়। বুধবার দুপুরে বাগেরহাটের গৌরম্ভা এলাকার একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে হঠাৎ দেখা হয় অভাবের সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে জলদস্যু বনে যাওয়া আবদুল হান্নান সরদারের সঙ্গে।
মুজিববর্ষে ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় মানুষকে নতুন ঘর উপহার দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন, তার আওতায় সারাদেশে নতুন ঘর পাবে আরও ২৬ হাজার পরিবার। তেমনই এক পরিবারের সদস্য হান্নান। তিনি জানান, ৫/৬ বছর আগে বাবা-মা আর পরিবারের নয় ভাই-বোনের সংসারের খরচ যোগাতে সুন্দরবনের জলদস্যু দলের সদস্য হয়েছিলেন।
পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শতাধিক সঙ্গী নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে আত্নসমর্পণ করেন। এর কয়েক বছরের মধ্যেই তার নিজের নামে পেয়েছেন ঘর।
হান্নান বলেন, “আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে কোনোদিন যেই চিন্তা করেননি, আজকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই চিন্তা করেছেন। তার কারণেই আমিসহ আমার মতো অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছে।”
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও ২৬ হাজার ২২৯টি ভূমি ও গৃহহীন পরিবারকে নতুন ঘর হস্তান্তর করবেন। এর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাটের ৯টি উপজেলার ৫০০ অতিদরিদ্র পরিবার।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, “তাদের মধ্যে ১৩ জন রয়েছেন যারা এক সময় সুন্দরবনের জলদস্যু দলের সদস্য ছিলেন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার সব ধরনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে।”
আবদুল হান্নানের সঙ্গে বাগেরহাটের শ্রীফলতলা আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় নতুন ঘর পেতে যাচ্ছেন সুন্দরবনের অপর একটি দস্যু দলের সদস্য জিয়াউর রহমান।
তিনি জানান, কয়েক বছর আগে সুন্দরবনে মাছ ধরতে গেলে জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে। এরপর ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে যুক্ত হয়ে যান জলদস্যুদের দলে। তাদের সঙ্গে প্রায় দেড় বছর ছিলেন।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে আত্নসমর্পণ করার কথা জানিয়ে জিয়া বলেন, “এখন আমি এলাকায় নসিমন চালিয়ে স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে সুস্থ, স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করছি।
“সরকার আমাকে যে নতুন ঘর করে দিচ্ছে তাতে আমার জীবন আরও সুন্দরভাবে চলবে। আমাকে আর কোনো অন্যায় করে পরিবারের খরচ চালাতে বাধ্য হতে হবে না।”
নতুন ঘর তার উদ্বাস্তু জীবনের অবসান ঘটাবে জানিয়ে সরকার প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “তার ঋণ আমি কোনোদিন কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারব না।”
গৌরম্ভা এলাকায় নতুন ঘর পেতে যাওয়া নারী চম্পা হালদার (২৫) জানান, তার স্বামী উজ্জ্বল ডাকুয়া (৩৫) স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে রামপাল বাজারে কাঁচামালের ব্যবসা করেন।
প্রায় দুই মাস আগে তাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের নতুন ঘরে থাকার অনুমতি মিললেও বৃহস্পতিবার সব ধরনের অনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তাদের কাছে নতুন ঘর হস্তান্তর করা হবে।
নিজের ঘরের কথা কল্পনাও করতে পারেননি জানিয়ে চম্পা বলেন, “আসলেই নতুন ঘর পাব কি না সেটা দেখতে আমার দাদি আমাদের কাছে বেড়াতে এসেছেন। বৃদ্ধ বয়সে দাদিও দেখতে পারবেন আমারও একটা নিজের ঘর আছে।”
প্রায় ছয় মাস আগে নতুন ঘর পাওয়া খান জাহান শেখ (৬০) ও তার স্ত্রী ফেরদৌসি খাতুনকে দেখা গেল নিজেদের বাড়ির উঠানে হরেক রকমের ফলজ গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত। নতুন ঘর তাদের জীবনকেও সাজিয়েছে নতুন করে।
ফেরদৌসি খাতুন বলেন, “আমার স্বামী আগে এই এলাকায় অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করত। নিজের জায়গা-জমি আর সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না। এখন নতুন ঘর আমাদের জীবনে নতুন আনন্দ নিয়ে এসেছে।”
বুধবার সকালেও ঘরের উঠানে লাগানো গাছ থেকে পেঁপে বিক্রি করেছেন বলে হাসিমুখে জানান এই দম্পত্তি।
তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা নতুন যে ঘর করে দিয়েছেন সেটা না হলে আমরা চলতেই পারতাম না। আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে তার জন্য দোয়া করি, যেন তিনি আরো বহু বছর সুস্থভাবে বেঁচে থেকে অসহায় মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন।”
এক সময় স্বামী ছেড়ে যাওয়া নাহার বেগমের দুই মেয়ের এক মেয়ে লাভলী বেগমকেও দেখা যায় মায়ের ঘরের কোণে ছোট জায়গা করে মুদি মালামালের পসরা সাজিয়ে বসতে।
লাভলী বলেন, “এই ঘর এখন আর শুধু ঘর না। এই ঘর আমাদের এনে দিয়েছে নতুন পরিচয়, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। দেখিয়েছে কিভাবে সমাজে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়।”
আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সরকার সারাদেশের দরিদ্রদের মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে নতুন ঘর করে দিচ্ছে। এর আগে তিন দফায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৯টি ঘর পেয়েছেন গৃহহীনরা।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পে এ পর্যন্ত বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ২৮ কোটি টাকা।
প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত মোট একক ঘরের সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার ৩২৯। বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৬৭ হাজার ৮০০টি ঘর। এর মধ্যে গত ২৬ এপ্রিল ৩২ হাজার ৯০৪টি ঘর হস্তান্তর করা হয়।
তৃতীয় পর্যায়ে চরাঞ্চলে বরাদ্দ করা বিশেষ নকশার ঘরের সংখ্যা ১ হাজার ২৪২টি বলে জানান তিনি।