Published : Thursday, 11 August, 2022 at 12:00 AM, Update: 11.08.2022 1:29:56 AM
শাহীন আলম, দেবিদ্বার ||
কুমিল্লার
দেবিদ্বার উপজেলার বনকুট গ্রামের ১৯৮৭ সালে সিলেটে কাজের সন্ধানে গিয়ে
নিখোঁজ হন মনির হোসেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়েই
দিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর থেকে সবার কাছে ‘মৃত’ ছিলেন তিনি মনির।
সবাই ভাবছিলেন আর কখনও মনিরের দেখা পাবেন না। প্রায় ৩৬ বছর পর গতকাল বুধবার
সকালে আবদুল হালিম নামের এক ব্যক্তির সহযোগিতায় স্ত্রী ও চার সন্তানকে
নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরেছেন মনির। মনির হোসেন গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের বনকুট
গ্রামের মৃত মুক্তিযোদ্ধা মো. রবিউল্লাহ মিয়া ছেলে। বুধবার বিকালে সরেজমিনে
গেলে তাকে দেখতে ভীড় জমান প্রতিবেশীরা। তাকে পেয়ে পরিবারের সদস্যরাও খুব
খুশি। নিজের আপন ঠিকানা, ও স্বজনদের খুঁজে পেয়ে খুশি মনির হোসেনও।
আবদুল
হালিম বলেন, আমার বয়স যখন ১১বছর তখন আমি জগুল মেম্বারের সিলেটের অনুরাগ
এলাকায় আনোয়ার বেকারীতে কাজ শুরু করি। মনির হোসেন জগুলো মেম্বারের বাড়িতে
কাজ করার সুবাদে আমার সাথে পরিচয় হয়। সেখান থেকে বন্ধুত্ব হয়। সবাই তাকে
স্বাধীন নামে ডাকতেন। আমিও এ নামেই ডাকতাম। পরে কথায় কথায় তার পরিচয়
জিজ্ঞাসা করতাম সে কিছুই বলতে পারতো না। একদিন আমি চাকরি ছেড়ে দেশে চলে
আসি। দেশে এসে চান্দিনায় একটি মিষ্টি দোকানে কাজ নেই। একদিন খবর পেলাম
জাফরাবাদ গ্রামের এক লোক হারিয়ে গেছে বহু বছর আগে তাকে খুঁজতেছে তাঁর
পরিবার। আমার সন্দেহ হয়। সিলেটে মনির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করি। তখন মনির
আমায় বলে, আসলে আমি হিন্দু না মুসলমান তাও জানিনা। এ কথায় আমি কষ্ট
পেয়েছিলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নেই, তাঁর ঠিকানা খুঁজে বরে করবই।খোঁজা শুরু
করি। খুঁজতে খুঁজতে গুনাইঘরের বনকুট গ্রামে এসে তাঁর মত অবিকল চেহারা ছোট
ভাই আবু হানিফকে খুঁজে পেয়ে ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখে নিশ্চিত হয়ে সিলেটে
নিয়ে যাই। সেখানে মনির হোসেনকে দেখে তাঁর ভাই বোনেরা আবেগ আপ্লুত হয়ে
পড়েন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মনিরের ছোট ভাই আবু
হানিফ ও রোকেয়া বেগম জানান, ভাইকে খুঁজতে অনেক বার সিলেটে গিয়েছিলেন আব্বা।
কিন্তু কোথাও পায়নি। আব্বা সারাদিন খোঁজাখুঁজি খুঁজতেন করে রাতে মসজিদে
ঘুমাতেন। পত্র-পত্রিকায়ও ভাইয়ের ছবি দিয়ে নিখোঁজ সংবাদ দেওয়া হয়েছে।
মসজিদে-মসজিদে ঘোষণা করা হয়েছে। এক টুকুরো জমি ছিল পুত্রের খোঁজে তাও
বিক্রি করে দেন।আমরা ধরে নিয়েছিলাম আর হয়তো বেঁচে নেই। আশাও ছেড়ে
দিয়েছিলাম। ছেলে হারানোর শোকে প্রথমে বাবা ও পরে মা মারা যান। আজ বাবা-মা
বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন বলেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন
তাঁরা।
প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা জানান, মনির হোসেনের জন্মের পর আমার এ
বাড়িতে বিয়ে হয়। তাঁর যখন ৭ বছর তখন তাকে কাজের কথা বলে সিলেটে নিয়ে যায়
তাঁর এক মামা। সেখানে মনির হারিয়ে যায়। এরপর আমি দেখেছি মনিরের জন্য তার
বাবার কি আর্তনাদ। মনির ঘরের বড় ছেলে। তাকে তার বাবা খুব আদর করত। মনিরের
শোকেই তার বাবা মা মারা যান।
মনির হোসেন তিনি বলেন, আমার ভোটার আইডি
কার্ডের নাম স্বাধীন। সিলেট সবাই স্বাধীন নামে ডাকতেন। ৭ বছর বয়সে কাজের
সন্ধানে এসে হারিয়ে যাই, হারিয়ে যাই। পরে সিলেট শাহ পরান মাজারে কান্নাকাটি
করায় শাহীন নামে এক রিক্সা চালক আমাকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দেন। তাঁর বাড়িতে
আমি দুই বছর ছিলাম। এক সময়ে শাহপরান বাজারে আমি কাঁচা মালের ব্যবসা শুরু
করি। সেখানে কয়েক বছর ব্যবসা করার পর সিলেটের অনুরাগ এলাকায় জগুলু
মেম্বারের বাসায় কাজ শুরু করি। তাঁদের বাড়ির সকল কাজকর্ম আমি করতাম। দিনের
বেলায় যেমন তেমন সময় কেটে যেত। রাত হলে সারা মা বাবার জন্য কান্নাকাটি
করতাম। বাবা মা বাড়ির ঘরের ঠিকানা মনে করার চেষ্টা করছি। কিন্তু মনে করতে
পারতাম না। এতটুকু মনে ছিলো বাসে করে এসেছি। ৩৬ বছর পর নিজের ভিটায়
স্বজনদের খুঁজে পেয়ে আমি অনেক খুশি।
গুনাইঘর দক্ষিণ ইউনিয়নের ইউপি
সদস্য মো. কামাল হোসেন বলেন, ৩৬ বছর আগে মনির হোসেন হারিয়ে যায়। এরপর তাকে
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি। মনির হোসেন বাড়ি ফিরে আসায় এলাকার সবাই
খুঁশি।