সাঈদ হাসান, কুবি ||
কুমিল্লাবিশ্ববিদ্যালয়ে
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ক্লাস নেয়া, গণমাধ্যমের গাড়ি ভাংচুর, ছাত্রলীগ
নেতাদের মারধরসহ নানা অভিযোগ গত ৬ মাসে ৮টি গঠিত তদন্ত কমিটির ছয়টিই আলোর
মুখ দেখিনি। শুধুমাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায়িত্ব শেষ করেন
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃষ্টি হচ্ছে বিচারহীনতার
সংস্কৃতি, বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৭ মার্চ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০২তম জন্মবার্ষিকীতে ফিন্যান্স অ্যান্ড
ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জসিম উদ্দিন ক্লাস নেওয়ার ঘটনায় রসায়ন
বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম রায়হান উদ্দিনকে আহবায়ক এবং ইংরেজি বিভাগের
সভাপতি ড. বনানী বিশ্বাসকে সদস্য ও তৎকালীন ডেপুটি রেজিস্ট্রার আমিরুল হক
চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের ৬ মাসেও
ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। এ বিষয়ে জানতে ড. রায়হানের সাথে যোগাযোগের
চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
একই মাসের ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর ড. শাহাবুদ্দিনকে হুমকি দেয়
অর্থ ও হিসাব দপ্তরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকির হোসেন চৌধুরী। এ ঘটনায়
রেজিস্ট্রার বরাবর শাস্তির দাবিতে জানিয়ে অভিযোগ করেন শাহাবুদ্দিন।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে
আহবায়ক, ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামানকে সদস্য এবং তৎকালীন
রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে সদস্য সচিব করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন
করা হয়। এ ঘটনাও তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি। এ বিষয়ে সদস্য সচিব ড. তাহের
বলেন, সেসময় উপাচার্যের সাথে কথা বলে কর্মকর্তা পরিষদ নিজেরা সমাধান করবে
বলে দায়িত্ব নেয়। পরে আমরা আর বিষয়টি নিয়ে জানতে পারিনি।
একই মাসের ২২
মার্চ সন্ধ্যায় ‘তুমি’ সম্বোধন করায় আনিসুর রহমানের এক শিক্ষার্থীকে মারধর
করে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াকিল
আহমেদ। এ ঘটনায় ওয়াকিলকে অব্যহতি দেয় শাখা ছাত্রলীগ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ২৮ মার্চ অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুল
ইসলাম আকন্দকে আহ্বায়ক, প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী এবং
ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাকসুদুল করিমকে সদস্য করে
তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু ৬ মাসেও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত
কমিটি। এবিষয়ে সদস্য কাজী ওমর বলেন, আমরা এ ঘটনার প্রতিবেদন রেডি করছি।
দ্রুত জমা দিতে পারব বলে আশা করি।
গত ১৩ জুন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন
এলাকায় একাত্তর টেলিভিশনের গাড়ি ভাঙচুরের উঠে লোকপ্রশাসন বিভাগের
শিক্ষার্থী নূর উদ্দিনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে
বিশ্ববিদ্যালয়। পরে উচ্চতর তদন্ত করতে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. হুমায়ুন
কবিরকে আহ্বায়ক ও প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি
গঠন করা হয়। এছাড়া সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম আকন্দ, এনএম
রবিউল আউয়াল চৌধুরী, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. দুলাল চন্দ্র নন্দী,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রভোস্ট ড. মোকাদ্দেস-উল-ইসলামকে সদস্য
করা হয়। একদিকে বহিষ্কারাদেশ অন্যদিকে তদন্তের মাঝেই ওই শিক্ষার্থীকে
পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে প্রশাসন। এনিয়ে আহ্বায়ক ড. হুমায়ুন বলেন,
আমরা তদন্ত করেছি, প্রতিবেদনও জমা দিব। কিন্তু তদন্তের মাঝেই কিভাবে ওই
পরীক্ষা দিচ্ছে সেটি প্রশাসন বলতে পারবে।
একই বছরের ২২ জানুয়ারি রাতে
নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলের ২০৯ নং রুমে লকারের চাবিকে কেন্দ্রকে করে
ছাত্রলীগ নেত্রী আশা আফরিনকে মারধর করে ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক
রিফায়েত জাহান উপমা। এ ঘটনায় অভিযুক্ত নেত্রীকে শোকজ করে ছাত্রলীগ। তবে
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করে হল প্রশাসন। তৎকালীন আবাসিক শিক্ষক
হাসেনা বেগমকে আহ্বায়ক এবং আবাসিক শিক্ষক খায়রুন নাহার ও রাশেদ আহমেদকে
সদস্য করে তিন সদস্য কমিটি গঠন করা হয়। এ বিষয়ে সদস্য রাশেদ আহমেদ বলেন,
সাত কার্যদিবসের মধ্যে আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়। সেসময় অভিযুক্তদের সর্তক
করে দেওয়া হবে এমন মর্মে চিঠি দেওয়া হয়। পরে এবিষয়ে কি ধরণের সিদ্ধান্ত
হয়েছে আমার জানা নাই।
সাবেক রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে নিয়ে
কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ কর্তৃক মিথ্যাচার ও মানহানিমূলক বক্তব্যের
ঘটনায় দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষক সমিতির আবেদনের
প্রেক্ষিতে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে আহ্বায়ক এবং
প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট
তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড.
সৈয়দুর রহমান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এনএম রবিউল আউয়াল চৌধুরী এবং
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহ. আমিনুল ইসলাম আকন্দ।
ড. তাহের ও
শিক্ষার্থীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে একই ঘটনায় আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে
প্রশাসন। সেখানে ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামানকে আহ্বায়ক ও প্রক্টর
(ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকীকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন,
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন রবিউল আউয়াল চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা শিক্ষা
বিভাগের অধ্যাপক ড. শেখ মকছেদুর রহমান এবং আইকিউএসির পরিচালক অধ্যাপক ড.
রশিদুল ইসলাম শেখ। এ কমিটিকে ড. তাহেরের বিরুদ্ধে এক কর্মচারীর আনীত
অভিযোগেরও তদন্ত করতে বলা হয়েছে। তবে এক ঘটনায় দুই তদন্ত কমিটি এবং উভয়
কমিটি একাধিক সদস্যে থাকায় শুরু থেকে তদন্তে বিঘ্নিত ঘটবে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট
অনেকের। তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিয়ে ড. তাহের, শিক্ষক সমিতি ও
শিক্ষার্থীদের আপত্তি থাকলেও কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে
এক কমিটির আহ্বায়ক ড. হুমায়ুন বলেন, এক ঘটনায় দুইট তদন্ত কমিটি। এখানে আমরা
কনফিউজড, কোন পার্ট তদন্ত করব। আমি সদস্য সচিবকে প্রশাসন চিঠি দিতে বলেছি,
বিষয়টি যেন ক্লিয়ার করা হয়।
গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান হল ও কাজী নজরুল ইসলাম হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে
গত দুইদিন ধরে চলা সংঘর্ষের ঘটনায় সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. শেখ মকছেদুর
রহমানকে আহ্বায়ক এবং প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকীকে সদস্যসচিব
করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন
রবিউল আউয়াল চৌধুরী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. জিএম মনিরুজ্জামান, ছাত্র
পরামর্শক ও নির্দেশনা পরিচালক ড. মোহা. হাবিবুর রহমানকে সদস্য করা হয়। এ
ঘটনায় সাতদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে গত ৬
মাসে পাচঁ ঘটনায় তদন্ত কমিটিই গঠন করেনি প্রশাসন। এর মধ্যে গত ১১ এপ্রিল
সামাজিক বিজ্ঞান এবং কলা ও মানবিক অনুষদের নিচে ময়লার স্তূপে বঙ্গবন্ধু ও
প্রধানমন্ত্রীর ছবি পড়ে থাকতে দেখা যায়। গত ২১ জুলাই উপাচার্যের কক্ষে
সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এক সাংবাদিককে হেনস্তা করে বের করে দেন সহকারী
প্রক্টর মাহাবুবুল হক ভূইঁয়া। এ ঘটনায় অভিযোগ দিতে গেলে অভিযোগপত্র গ্রহণ
করেনি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন। ১৪ মার্চ শারীরিক শিক্ষা
দপ্তরের উপ-পরিচালক মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অশোভন আচরণ করার লিখিত অভিযোগ
করেছেন শিক্ষার্থীরা। সে ঘটনায়ও কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। এছাড়া
ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে
নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তার অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেয়নি।
তদন্ত
কমিটি করেই দায়িত্ব শেষ করা ও একাধিক ঘটনায় কোন ধরণের ব্যবস্থা না নেওয়ায়
বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। একাধিক
শিক্ষার্থীরা মনে করেন অপরাধীরা যেমন আরো উদ্বুদ্ধ হবে তেমনি অনেকে নতুন
করে অপরাধ করতে সাহস পাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র শিক্ষক
বলেন, এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতিটা প্রকট। কারণ তদন্ত কমিটি করা হয়,
কিন্তু অদৃশ্য কারণে রিপোর্ট দেয়া হয়না। প্রশাসন কোন ঘটনাকে প্রশমনের জন্য
কমিটি করে। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বিচার নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।
ট্রেজারার
ড. আসাদুজ্জামান বলেন, আমি মনে করি তদন্ত কমিটি হলে সেটির সুরহা করা উচিত
এবং সেখানে সবার সহায়তা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে,
একাডেমিক পরিবেশ রক্ষা করতে যেকোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হোক না কেন সত্য
তথ্য উদাঘটন করতে এবং যারা দোষী তাদের সনাক্ত করতে তদন্ত কমিটি করা হয়।
চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে সে যদি দোষী হয় তাহলে শাস্তি, যদি নির্দোষ হয় তাহলে
যারা হয়রানী করে তাদের সর্তকবাণী দেওয়া হোক। বিচার না হলে অপরাধ বাড়ে,
অপরাধী আরও অপরাধ করার সাহস পাবে।
উপ-উপাচার্য ড. হুমায়ুন কবির বলেন,
একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে অবশ্যই সেটার প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। কিন্তু
প্রশাসনের যদি সেটি আদায় করে নিতে না পারে তাহলে প্রশাসনের ব্যর্থতা। যদি
তদন্ত আলোর মুখ না দেখে সেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হবেই। প্রশাসন
কঠোর অবস্থানে না গেলে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে।
এবিষয়ে কথা বলতে উপাচার্য
অধ্যাপক ড. আবদুল মঈনের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি সাংবাদিকদের সাথে কথা
বলতে রাজী হননি। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কোন বক্তব্য দিবনা। তোমার যা মন
চায় লিখ। পরে তাঁর মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।