
শাহজাহান চৌধুরী ||
লম্বা ছিপছিপে নিটোল মুখায়ব, ফর্সা, সূর্যের আলো যেন টিকরে পড়ে, যুবকটিকে দেখেছি ৬৯ এর গণ আন্দোলনে মিছিল মিটিং এর সামনের কাতারে তখন তিনি ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে পড়েন এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজ বিজ্ঞানে এম পাশ করে হয়ে যান আওয়ামীলীগের সার্বক্ষণিককর্মী।
জন্ম ভারতের জলপাইগুড়ী, বাবা ছিলেন সেখানকার বৃটিশ চা ব্যবসায়ীর টি স্টেট ম্যানাজার, ৫ ভাই তিন বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি। বাবা সিদ্দিকুর রহমান মা লতিফা খাতুনের ফুটফুটে সন্তান মফিজুর রহমান বাবলু (আমাদের বাবলু ভাই) তার পরিবার ১৯৫৮ সালে নিজ বাড়ী চৌদ্দগ্রাম থানার নোয়াপুর গ্রামে চলে আসেন। তিনি বাদুরতলা চিওড়া হাউজ নিবাসী কাজী আবু তাহের মোঃ আলীর বাসায় থেকে ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন মাঝে দুই বছর চট্টগ্রাম কাজেম আলী হাই স্কুলে পড়েন। ১৯৬৩ সালে এস.এস.সি পাশ করেন তার গ্রামের বাড়ীর পাশে কাজীদের প্রতিষ্ঠিত চিওড়া হাই স্কুল থেকে। চিওড়া হাইস্কুল তখন কুমিল্লার একটি সাড়া জাগানো স্কুল ছিল। চিওড়া কাজী বাড়ী ছিল এ অঞ্চলের শিক্ষা, সমাজ সেবায় একটি অগ্রগামী জনপদ। এ বাড়ীর সন্তান কাজী জহিরুল কাইয়ুম ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন সহচার অনুসারি ও সুহৃদ। আওয়ামীলীগের কান্ডারী, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এ বাড়ীর ছেলে কাজী জাফর আহম্মদ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সংবাদ জগতের পথিকৃৎ ডেইলী স্টার প্রথম আলো, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম ইন্টারন্যাশনালের মালিক ছিলেন চিওড়া গ্রামের সন্তান লতিফুর রহমান। এমনি আরো নাম করা লোকের জন্ম এই কাজী বাড়ীতে।
আমার পিতা মীর কাশেম চৌধুরী, চাচা ৭০ এর নির্বাচিত প্রাদের্শিক পরিষদ সদস্য মীর হোসেন চৌধুরী ও ছিলেন এ চিওড়া স্কুলের ছাত্র। বাবলু ভাইদের বাড়ী নোয়াপুর চিওড়ার পাশেই এবং এই কাজী বাড়ীর সাথে বহু আগে থেকেই আত্মীয়তা ছিল। ১৯৬৯ এর ১৪ ডিসেম্বর বাবলু ভাই বিয়ে করেন কাজী সিরাজুল হক সাহেব কন্যা রাশেদা কে যিনি পরবর্তী জীবনে কুমিল্লার ক্রীড়াঙ্গনে রাশেদা রহমান রাশু আপা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাদের তিন সন্তান হাছান আসিফ রহমান, খালেদ ফয়সল রহমান ও কন্যা মাসিহা ইসরাত।
বাবলু ১৯৬২ সালে স্কুল জীবনেই শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কলেজ জীবনে তিনি বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বাবলু ভাই ৬ দফা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন চৌদ্দগ্রামের আরেক সন্তান মীর হোসেন চৌধুরী সহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভুত্থানের সময় বাবলু ভাই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংদের সদস্য হিসাবে বায়তুল মোকারম মসজিদ গেইটের সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এবং আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিটি কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার হলে তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” খেতাব প্রদানের একজন কর্মী ছিলেন।
বাবলু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় ৭০ নির্বাচনকালীন। তিনি তখন ছাত্রলীগের একজন নেতা। সে সময় তিনি আওয়ামীলীগের প্রার্থী জহিরুল কাইয়ুম, মীর হোসেন চৌধুরী, উত্তর চৌদ্দগ্রামের হাজী আলী আকবর এর নির্বাচনে ঘুর্ণির মতো ঘুরে ঘুরে নির্বাচনের কাজ করেছেন। সে সুবাদে তিনি আমাদের বাড়ীতেও যেতেন। বাবলু ভাই আমার চাচা মীর হোসেন চৌধুরীকে ডাকতেন মীরু ভাই আর-আমি তাকে ডাকি বাবলু ভাই। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ৭৪/৭৫ সালের দিকে বাবলু ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা। আমি তখন সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন কর্মী। বাবলু ভাই ছিলেন সংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক। আমার নাটক তারা স্বামী স্ত্রী দু’জনই পছন্দ করতেন এবং টাউন হলে দেখতেও আসতেন। ৯৬ এ কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য হয়ে গেলাম ক্লাব ফেলো। ২০১১ তে ক্লাবের নৌ ভ্রমণে বাবলু ভাই ও রাশু আপা সাথে ছিলেন- সেখানে একটি অনুষ্টানে তাদের মেয়ে মাসিহা আমার সাথে অভিনয় করেন পরে আমরা আগরতলা যেয়ে একই হোটেলে উঠে শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখেছি। আমাদের সাথে ছিলেন ক্লাব সদস্য তারেক কামাল ইমতিয়াজ।
বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যে ক’জন রাজনৈতিক নেতা সোচ্ছার ছিলেন বাবলু ভাই ছিলেন অন্যতম একজন। দলের ছোট বড় সবার কাছে তিনি ছিলেন আপনজন। বাবলু ভাইয়ের যে ধরনের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার আছে তাতে তিনি বহু আগে দলের হয়ে যেকোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন কিন্তু সে মোহ তার নেই। এ প্রসঙ্গে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতে চাই আওয়ামীলীগের সভানেত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে, যিনি এবার জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমি ধন্যবাদ দিতে চাই বাবলু ভাইয়ের মনোনয়নে অন্য যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্ন দল থেকে, তারা সবাই বাবলু ভাইকে সম্মান করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং তিনি কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে যোগ দিয়েছেন।
বাবলু ভাই এবং তার স্ত্রী রাশেদা রহমান রাশু আপার সাথে আমার অনেক সুখ স্মৃতি। একদিন আমি রাজগঞ্জ বাজারে বাজার করছি বাবলু ভাইও বাজারে এসেছেন। তিনি তাঁর চিরয়াত ভঙ্গিমায় পিছনে দুই হাত রেখে হাটতে হাটতে মাছ দেখছেন। আমরা দু’জনই একটা চিতল মাছের ডালির কাছে দাড়ালাম। একটা বড় চিতল দোকানী দাম হাকছে ৫ হাজার টাকা। আমি বাবলু ভাইকে বললাম: বাবলু ভাই, বড়চিতল খাওয়ার শখ, কিন্তু এতদাম দিয়ে কিনে এত মাছ রাখবো কোথায়? বাসায় আমরা মাত্র দু’জন। তিনি তাৎক্ষনিক মাছ ওয়ালাকে বললেন মাছ দু’ভাগ করে আমাদের দু’জনকে দিতে। দু’জনে ভাগাভাগী করে টাকা দিলাম। সে হতে বহুদিন ফোনে যোগাযোগ করে আমরা বড় মাছ কিনতাম। তিনি মাছ কার্টারকে বলতেন আমার ছোট ভাইকে একটু বেশি দিবা। এই হলো বাবলু ভাই।
রাশু আপার কথা বলি। একসময় আমি ভলিবল খেলতাম জেলা দলের হয়ে। আমি বি কে এস পি তে ভলিবল প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত করে আসার পর, রাশু আপা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার মেয়েদের ভলিবল প্রশিক্ষক হিসাবে আমাকে নিয়োগ দেন। সে বছরই কুমিল্লা মহিলা ভলিবল দল জাতীয়ভাবে আনছার এর সাথে খেলে রানার্সআপ হয়। এখানে আমাকে আরেকজন সহযোগিতা করেছেন তিনি সজল হাজরা। দিনগুলোর কথা ভুলবোনা, ভোর ৬টায় স্টেডিয়াম জিমনিশিয়ামে ১৮টি মেয়েকে আমি তৈরী করেছি। রাশু আপা সজল হাজরা আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন।
শেষ করবো বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবলু ভাইয়ের কথা বলে। ১৯৭০ নির্বাচন পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ডাকে তিনি বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন এবং জোরালো ভ’মিকা রেখেছেন। ২৫ মার্চ ‘৭১ হানাদার পাকিস্তানিবাহিনী পুলিশ লাইন আক্রমণ করলে শহরে প্রতিরোধ কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি ২৮ মার্চ ত্রিপুরা রাজ্যের সোনা মুড়ায় চলে যান সেখানে তার সাথে দেখা হয় জননেতা আফজাল খান, আব্দুল আউয়াল, এমপি আবদুল মালেক, অধ্যক্ষ আবদুর রউফ প্রমুখের সাথে। তাঁরা রবিনগর বন বিভাগের বাংলোতে থাকতেন।
মফিজুর রহমান বাবলু ভারতের কাঁঠালিয়ার প্রথম ব্যাচের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ নেন। পরে তিনি ক্যাপ্টেন আমিনের ট্রুপে যোদ্ধা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেকারণে ২৬ জুলাই তার ৪ চাচাকে বাড়ীতে পাক সেনারা হত্যা করে। তিনি ত্রিপুরার বিলুনিয়া মহকুমার রাধা নগর যুব শিবিরের চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে ট্রেনিং এর জন্য প্রেরণ করতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবলু বাইদের ট্রুপের কাছে যুদ্ধ টিকতে না পেরে ২৮ নভেম্বর পাক বাহিনী জগন্নাত দিঘি এলাকা ছেড়ে চলে যায় এবং ২৮ নভেম্বর জগন্নাত দিঘী মুক্ত হয়। এই ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন চৌদ্দগ্রাম দক্ষিণ হতে নির্বাচিত এম,পি,এ, মীর হোসেন চৌধুরী।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলে সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং আওয়ামীলীগের জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন পদ মর্যাদায় অদিষ্ঠ থেকে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কুমিল্লার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। চেয়ারম্যান বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, লায়ন্স ক্লাব, কুমিল্লা কালচারাল কমপ্লেক্স, সংলাপ কুমিল্লা, চিওড়া কলেজের গর্ভনিং বডির সদস্য ইত্যাদি।
মফিজুর রহমান বাবুল মুক্তিযুদ্ধের ২নং সেক্টরে একজন যোদ্ধা। এবার তাঁকে কুমিল্লা জেলার উন্নয়নের যোদ্ধা হিসাবে জননেত্রী শেখ হাসিনা মনোয়ন দিয়েছে। তাই আমরা গর্বিত। একজন ত্যাগী ছাত্র, যুব, বর্ষিয়ান নেতা মফিজুর রহমান বাবলু নিশ্চয়ই কুমিল্লাবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবেন বলে আমরা আশা করি।
লেখক
অভিনেতা, নাট্য সংগঠক, লেখক ও আলোকচিত্রী
মোবাইল: ০১৭১১-১৪১০২৭
পরিবারের গুরুত্ব
জুবাইদা নূর খান
আপনাদের কি কালো কাপড়ের কাঠের হাতলওয়ালা ছাতার কথা মনে পড়ে? কেমন ঢাউস আকারের ছাতা! লোহার শিকওয়ালা কালো কাপড়ের ছাতা। দুইজন অনায়াসে ঐরকম একটি ছাতা দিয়ে যাতায়াত করতে পারতো। ৩০/৩৫ বছর পূর্বে ঐরকম ছাতাই কেবল পাওয়া যেতো। ওগুলো আবার বেশ মজবুত ছিলো। কখনো কখনো ছাতার ভেতরের লোহার একটা- দুটো শিক ভেঙে যেতো অথবা কালো কাপড়ের কোথাও কোথাও ফুটো হয়ে বৃষ্টির পানি ছাতা ভেদ করে শরীর ভিজিয়ে দিতো। মা - চাচীরা কাপড়ের ছোট টুকরো সুন্দর করে কেটে ঐ ফুটোতে সেলাই করে বসিয়ে ফুটো বন্ধ করতেন; আবার, শিক ভেঙে গেলে তা সারানোর ব্যবস্হাও ছিলো। যত্নের সাথে ব্যবহার করলে একটা ছাতায় বেশ কয়েক বছর চলে যেতো।
রোদ- বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাবার বাইরেও ছাতার অন্য একটি ব্যবহার ছিলো এবং তা অবশ্যই উল্লেখ করার মতো। যেমন পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ না হলে অথবা কোনো বেয়াদবি বা খারাপ আচরণ অভিভাবকদের দৃষ্টিগোচর হলে ঐ ছাতাকে বাবা- মা মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। ছাতার প্রতিটা আঘাত সুনিপুণভাবে আমাদের পিঠে পতিত হতো আর চোখের পানি- নাকের পানি এক করে ভবিষ্যতে আর কখনো পড়ায় ফাঁকি দেয়া কিংবা বেয়াদবি না করার প্রতিজ্ঞাবাক্য বেশ জোরেশোরেই আমাদের দিয়ে পাঠ করানো হতো।
আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা ছোটবেলা থেকেই একটা জিনিস ভালো ভাবে রপ্ত করতে শিখি ; আর তা হলো খুব যত্ন সহকারে যে কোনো জিনিস ব্যবহার করতে শেখা আর মায়া করা - সেটা হতে পারে ছাতার মতো প্রাণহীন কোনো বস্তু অথবা রক্ত কিংবা রক্তের বাইরের নানা রকম সম্পর্ককে গুরুত্ব এবং যত্নের সাথে লালন করা।। তাইতো, রোদে-পুড়ে ছাতার কৃষ্ণ বর্ণ মলিন হলেও আমরা ফেলে দিতে পারতামনা। কেমন মায়া বোধ হতো। ঘরের এক কোনে রেখে দিতাম। দাদা- দাদী, চাচা- ফুপু, চাচাতো ভাই-বোন; তারা তো আমাদের রক্তের সম্পর্কের ; স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আপনজন; তাদের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য বা ভালোবাসা থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, এই মায়ার চর্চার কারণেই পাড়া অথবা স্কুল - কলেজের বড় ভাইয়া কিংবা আপুরাও আমাদের অতি নিকটজন হয়ে যেতেন। আমাদের ভালো- মন্দ, বিপদ- আপদে তারা এগিয়ে আসতেন, বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন।
সময়ের পরিক্রমায় সেই গতানুগতিক বিরাট আকৃতির কালো ছাতার স্হান দখল করেছে দেশি-বিদেশি কোম্পানির হরেক ডিজাইনের বিভিন্ন রংয়ের সুদৃশ্য কতরকম ছাতা! তাতে আবার কত রকম নকশার ছাপ! ছাতাগুলো হালকা এবং ছোট বিধায় অনায়াসে কাঁধে বহনকারী ব্যাগে রাখা যায়। ফ্যাশন সচেতনেরা আবার পোশাকের রংয়ের সাথে মিলিয়ে ছাতা বহন করেন। সময়টাই এখন বাহ্যিক চাকচিক্যের। এ ধরণের ছাতাগুলো কতটা টেকসই অথবা মজবুত - সে বিষয়টাতে আর নাইবা গেলাম। তবে, এ ধরনের আধুনিক, সুদৃশ্য ছাতা দিয়ে বাবা- মায়ের শাসন যে চলবেনা তা মোটামুটি নিশ্চিত। আর সন্তানরা বাবা-মা, শিক্ষাগুরুদেরকে কতটা মান্য বা সমীহ করে তার প্রমাণ সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতেইতো আমরা দেখতে পাচ্ছি!
অতি আধুনিকতার এই যুগে আমরা সুপারসনিক গতিতে ছুটে চলছি। আর পেছনে ফেলে যাচ্ছি, কত রকম স্মৃতি, আমাদের শতবর্ষের পারিবারিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আমাদের মায়া- মমতা, একটু যত্ন প্রত্যাশী রক্ত কিংবা রক্তের বাইরের বিভিন্ন নামের সম্পর্কগুলো। বৃদ্ধ বাবা- মা পড়ে থাকেন গ্রামের ছোট্ট কুটিরে। দিনমান ব্যস্ততার এই যুগে বছরে একবার তাঁদেরকে দেখতে যেতে হলেও আমাদেরকে হিসেবের খাতা নিয়ে বসতে হয় এবং সেখানে লাভের চেয়ে লোকসানটা বেশি প্রতীয়মান হয় বলে তাঁদেরকে দেখতে যাওয়ার বিষয়টা আপাততঃ অনির্দ্দিষ্ট ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ের জন্য আমরা তুলে রাখি। একটা ফোন কল অথবা কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদিত হয়েছে ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।
আমরা আর কতটা আত্মকেন্দ্রিক অথবা মায়া বিবর্জিত হয়ে থাকবো? আধুনিক যুগে বসবাস করে আধুনিকতার স্তুতি অবশ্যই আমাদের করতে হবে। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে। সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তবে সময়ে সময়ে পেছনের দিকে একটু দৃষ্টি প্রসারিত করলে নিজেদের অবস্থান অথবা করনীয় সম্পর্কে কিন্তু একটা সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। সেই কালো, ঢাউস আকারের ছাতাও আমাদের জন্যে একধরনের শিক্ষা বটে। চলার গতি বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবনবোধের গতিটার দিকেও একটু লক্ষ্য রাখা উচিত। বোধের গতিটা ধীর হতে হতে আবার যেনো শুন্যের ঘরে আটকে না যায়। তাইতো, লালন সাঁই বলে গেছেন--
" সময় গেলে সাধন হবেনা,
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলেনা?
তুমি কেন জানলেনা?
সময় গেলে সাধন হবেনা।"
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ