আলোদূষণকে অবহেলা করা উচিত নয়
Published : Friday, 21 October, 2022 at 12:00 AM
বিধান চন্দ্র দাস ||
আমাদের
দেশে ‘বায়ুদূষণ’, ‘মাটিদূষণ’, ‘পানিদূষণ’ কিংবা ‘শব্দদূষণ’ নিয়ে আলোচনা
হলেও ‘আলোদূষণ’ নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হতে দেখা যায় না। অথচ ‘আলোদূষণ’ও যে
মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী তথা বাস্তুতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ, সে ব্যাপারে
আমাদের মধ্যে অনেকের সচেতনতা নেই বললেই চলে। আসলে বৈদ্যুতিক আলোয় আমাদের
জীবন এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, তার অপব্যবহারে যে আমাদের অনিষ্ট হতে পারে, এই
চিন্তা আমাদের অনেকের মাথায় আসে না।
আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নালগুলো আলোদূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ক্রমাগতভাবে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করছে।
পৃথিবী
বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলো থেকে আলোদূষণসংক্রান্ত অনেক গ্রন্থও প্রকাশিত
হয়েছে। বিবিসি, সিএনএন, গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস আলোদূষণের ওপর অনেক
প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক আলোর
যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষ, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে অনেকভাবে ক্ষতি করছে।
এ ছাড়া আলোর অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ ব্যবহার অর্থনীতি ও জীবাশ্ম জ্বালানির
অপচয় বলে অনেকে মনে করেন।
স্প্রিংগার থেকে ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি
গ্রন্থে মানুষের স্তন ও প্রস্টেট ক্যান্সারের জন্য আলোদূষণকেও দায়ী করা
হয়েছে। এই গ্রন্থে কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতে মানুষের দেহঘড়ি (বায়োলজিক্যাল
ক্লক) প্রভাবিত হয় এবং প্রয়োজনীয় মেলাটোনিন নামক হরমোন (মস্তিষ্কের পিনিয়াল
গ্রন্থি নিঃসৃত) নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মেলাটোনিন
মূলত মানুষের ঘুমচক্র (সার্কাডিয়ান রিদম) নিয়ন্ত্রণ করে। আলোর উপস্থিতিতে
মেলাটোনিন নিঃসরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই হরমোন কোষে সংঘটিত অস্বাভাবিক
রাসায়নিক প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয় ও মানুষের বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণ করে। গ্রন্থের
দুই লেখকের (ড. হেম ও ড. পর্টনভ) কথায়, ‘মেলাটোনিনের ক্যান্সাররোধী
বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং সেই কারণে এই হরমোন নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত হলে তা স্তন ও
প্রস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করে’। বেশ কয়েকজন গবেষক কর্তৃক কয়েক হাজার
মানুষের ওপর পরিচালিত জরিপ এবং গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর করা পরীক্ষার
ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে লেখকদ্বয় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। বুলগেরিয়া
সরকারের একটি প্রতিবেদনে (২০১৯) কৃত্রিম আলো ক্যান্সার ছাড়াও স্থূলতা,
বিষণ্নতা ও ডায়াবেটিস ঝুঁকি তৈরি করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ‘আই’
নামক একটি চিকিৎসা জার্নাল কৃত্রিম আলো চোখের রেটিনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
বলে এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে। আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক ২০১৬
সালে এক প্রতিবেদনে বৈদ্যুতিক আলোর স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
প্রভাবশালী
বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’ ২০১৮ সালে একটি লেখার শিরোনাম করে ‘আলোর অন্ধকার
দিক’। এই লেখায় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের উদ্ধৃতি এভাবে তুলে
ধরা হয়, ‘আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রভাব সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি।
কিন্তু আলোদূষণের প্রভাব কতটা ব্যাপক সে সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? আসলে
আমরা পরিবেশকে নিয়ে জুয়া খেলে চলেছি। ’ ‘নেচার’-এর লেখায়, ‘পৃথিবীর বেশির
ভাগ জীব–মানুষ, আরশোলা কিংবা পানিতে ভাসমান কোনো জীবের আচরণ আলো ও
অন্ধকারচক্র নিয়ন্ত্রণ করে। ...জীবন উৎপত্তির সময় থেকে পৃথিবীর অনেক
পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু অতীতে জীবন সব সময়ই দিনের বেলায় আলো ও রাতে অন্ধকার
নিয়ে বিবর্তিত হয়েছে। ...যখন এটার পরিবর্তন হয় তখন ধরে নিতে হবে যে এর
দ্বারা খারাপ কোনো কিছু সংঘটিত হতে চলেছে। ’
বাস্তুতন্ত্রের ওপর
আলোদূষণের অভিঘাত সম্পর্কিত একাধিক গবেষণা ফলাফল নেচার-এর উপরিউক্ত লেখায়
তুলে ধরা হয়েছে। আলোদূষণের কারণে উদ্ভিদ, বন্য প্রাণী তথা জীববৈচিত্র্য
বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার উদাহরণ আছে এই লেখায়। বলা হয়েছে যে উদ্ভিদের মুকুল, ফুল
ও ফল তৈরিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে পরাগায়ণেও। বিশেষ করে
সপুষ্পক উদ্ভিদে পরাগায়ণ ঘটানোর জন্য প্রধান ভূমিকা পালনকারী অসংখ্য
কীটপতঙ্গ আলোদূষণের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। ফলে কীটপতঙ্গকেন্দ্রিক
বাস্তুতান্ত্রিক সেবা হ্রাস পাচ্ছে বলে গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১৭
সালে ‘নেচার’-এ প্রকাশিত অন্য একটি প্রবন্ধে তৃণভূমির ওপর পরিচালিত এক
পরীক্ষার ফলাফলে জানা গেছে যে বৈদ্যুতিক আলোর কারণে নৈশপরাগায়ণকারী
কীটপতঙ্গ পরাগায়ণ করতে পারছে না। মেরুদণ্ডী ও অমেরদণ্ডী প্রাণীদের প্রজনন
থেকে শুরু করে তাদের শারীরবৃত্তীয় নানা কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে গবেষণায় পাওয়া
গেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আলোদূষণ বলতে কী বোঝায়? এর সংজ্ঞা কী? আসলে
কোনো একক সংজ্ঞা দিয়ে আলোদূষণকে সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের
দেওয়া অনেক সংজ্ঞার মধ্যে একটিতে বলা হয়েছে, ‘ওপরে, পাশে কিংবা বায়ুমণ্ডলে
ছড়িয়ে পড়া ভুল নির্দেশিত, অরক্ষিত অত্যধিক অপ্রয়োজনীয় রাতের আলো, যা রাতের
আকাশকে উজ্জ্বল করে আকাশের প্রকৃত ছবিকে ঢেকে দেয়। ’ জীববিজ্ঞানের
দৃষ্টিতে আলোদূষণ হচ্ছে, ‘দিনরাত চক্রের অন্ধকার পর্যায়ে কৃত্রিম উৎস থেকে
আলোক নির্গমন, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য অথবা তীব্রতা পিনিয়াল মেলাটোনিন উৎপাদন ও
তার প্রতিদিনের ছন্দকে ব্যাহত করে জীবদেহে প্রতিক্রিয়া শুরু করে। ’
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় খুবই অল্প কথায় আলোদূষণের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে
এভাবে—‘অবাঞ্ছিত অত্যধিক আলোই হচ্ছে আলোদূষণ’।
সাধারণত রাস্তা, পার্ক ও
অন্যান্য জায়গায় স্থাপিত চোখ-ধাঁধানো অতি উজ্জ্বল আলো, একই স্থানে বিভিন্ন
দিক থেকে তীব্রভাবে পড়া আলো কিংবা বাইরে থেকে গৃহাভ্যন্তরে আসা আলোসহ
অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনকৃত কৃত্রিম আলোর যেকোনো উৎস থেকেই আলোদূষণ ঘটতে
পারে। আলোদূষণের অন্যতম একটি উৎস হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত বিলবোর্ড।
আলোদূষণকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো : ১. অনুপ্রবেশকারী
আলো (লাইট ট্রেসপাস : যখন অন্য কোনো জায়গা থেকে আলো এসে দূষণ ঘটায়।
যেমন—রাস্তা কিংবা অন্য কোনো জায়গা থেকে আলো কারো ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। এ
ধরনের আলোয় ঘুমের ব্যাঘাত হয়)। ২. অতি আলোর প্রাবল্য (ওভার ইলুমিনেশন :
কোনো জায়গায় অতি উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ। এ ধরনের আলোয় বেশিক্ষণ থাকলে
স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়)। ৩. বিশৃঙ্খল আলো (লাইট ক্লাটার : নানা ধরনের আলো
মিশে কোনো জায়গায় যখন আলোর বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এ ধরনের আলোদূষণ দর্শন
বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ও দুর্ঘটনা ঘটায়)। ৪. ঝলসানো আলো (গ্লেয়ার : এ ধরনের
আলোয় চোখ ঝলসে যায়। যেমন—গাড়ির অতি উজ্জ্বল আলোয় কারো চোখ ঝলসে যেতে
পারে)।
ভূপৃষ্ঠে প্রতিবছর ৬ শতাংশ হারে কৃত্রিম আলো বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এগুলো নিয়ম-কানুন মেনে স্থাপিত না হওয়ায় তা দিন দিন
আলোদূষণকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। বর্তমানে
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে আলোদূষণ নিয়ন্ত্রণে
আইন করা হয়েছে। বাংলাদেশে আলোদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো আইন কিংবা বিধি
নেই। বাংলাদেশের দুজন গবেষক কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে,
দেশে আলোদূষণ দিন দিন বৃদ্ধি (১০ বছরে চার গুণ) পাচ্ছে। বাংলাদেশে আলোদূষণ
বিষয়ে জরুরিভাবে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশে সাধারণত
দোকানগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করা হয়। বিশেষ
করে কিছু কিছু কাপড় বা পোশাকের দোকানে কোনো খরিদ্দার ঢুকলেই একসঙ্গে অনেক
অতি উজ্জ্বল লাইট জ্বেলে দেওয়া হয়। কোনো কোনো ব্যাংক, বীমা অফিস কিংবা কিছু
কিছু করপোরেট বা বেসরকারি অফিসগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি উজ্জ্বল
বৈদ্যুতিক আলো ব্যবহার করা হয়। এসব আলো সেখানকার কর্মচারী-কর্মকর্তা থেকে
শুরু করে সেখানে আগত ক্রেতা বা দর্শনার্থীদের জন্য যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা
তৈরি করতে পারে, তা আমরা হিসাবের মধ্যে রাখি না। এখন সময় এসেছে আমাদের
স্বাস্থ্য, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ তথা বাস্তুতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে
আলোদূষণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া। আলোর যথেচ্ছ ব্যবহার, অপচয় বন্ধ করে
পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা গেলে তা আমাদের অর্থনীতির জন্যও মঙ্গলজনক হবে।
আলোদূষণকে অবহেলা করা উচিত নয়।
লেখক : অধ্যাপক (পিআরএল), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়