নিজস্ব
প্রতিবেদক: ভাষাসৈনিক আলী তাহের মজুমদার আর নেই। শনিবার (২৩ জানুয়ারি)
সকালে কুমিল্লার সদর দণি উপজেলার চানপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে বার্ধ্যক্যজনিত
কারণে মৃত্যুবরন করেছেন ৫২’র ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া এই
বিপ্লবী। ১০৬ বছর বয়সী আলী তাহের মজুমদার তার সংগ্রামী জীবনে বৃটিশ বিরোধী
আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
আলী
তাহের মজুমদার ১৯১৭ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহন করেন। বাবার নাম চারু
মজুমদার ও মা সাবানী বিবি। মত্যুকালে তিনি ২ ছেলে ২ মেয়েসহ অসংখ্য
শুভানুধ্যাযী রেখে গেছেন।
আলী তাহের মজুমদারের সংগ্রামী দিন: চাঁদপুর
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর কুমিল্লা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা
করেছেন আলী তাহের মজুমদার। ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৫ সালে কংগ্রেসের রাজনীতির
সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেন। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় অষ্টম পাঞ্জাব আর্মিতে যোগ দিলেও সাত-আট মাসের প্রশিণ
শেষে ছুটিতে এসে আর ফিরে যাননি। তখন তাঁর বিরুদ্ধে জারি হয় গ্রেপ্তারি
পরোয়ানা। তাঁকে বাঁচাতে কুমিল্লার তখনকার জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদ ও পুলিশ
সুপার কার্যালয়ের মোজাফ্ফর হোসেন ভূইয়া ফেনীতে জাপানি বাহিনীর বোমায় আলী
তাহের মজুমদার নিহত হয়েছেন বলে প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেন। ওই সময়ে নেতাজি সুভাষ
বসুর গুপ্তচর হিসেবে কাজ শুরু করেন আলী তাহের মজুমদার। কুমিল্লা ও ফেনীতে
বিলি করেন সুভাষ বসুর লিফলেট।
দেশ ভাগের আগে আগে ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীতে
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী কমিটি গঠন
করেন। ১৯৪৬ সালের এক দিন কলকাতার এক চা দোকানে আড্ডা দেওয়ার সময় জাতির জনক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হয় আলী তাহের মজুমদারের। তাঁর
মুখেই আলী তাহের জানতে পারেন বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ করার কথা।
হোসেন
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোসের পরিকল্পিত বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে
স্বাধীন সরকার গঠনের জন্য কাজও করেছেন আলী তাহের। দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালের
২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে
অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলেন কুমিল্লার গণপরিষদ সদস্য
ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। তখন ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
আলী তাহের মজুমদার তখন
আরএসপি (রেভল্যুশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টি) করতেন। ওই অফিসে বসে ভাষা
আন্দোলনের লিফলেট-পোস্টার লিখে বিলি করতেন। কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক
চেয়ারম্যান ও বিপ্লবী অতিন্দ্র মোহন রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চালাতেন
আন্দোলন। বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলি হলে তা অতীন রায়ের
মাধ্যমে জানতে পারেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে বিােভে ফেটে পড়ে কুমিল্লার মানুষ।
আলী তাহের মজুমদার মিছিল করার সময় কুমিল্লা শহরের রাজগঞ্জে গ্রেপ্তার হন।
পরদিন তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর আগেও দুই দফা গ্রেপ্তার হয়েছেন আলী তাহের
মজুমদার।
এদিকে ভাষা সৈনিক আলী তাহের মজুমদারের মৃত্যুর সংবাদে এলাকায়
শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে ছুটে যান
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর, কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার ফারুক
আহমেদ পিপিএম (বার), কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম
সারওয়ারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
গতকাল বিকেল ৫টায় তাঁর নিজ বাড়ি
সংলগ্ন উত্তর রামপুর-চাঁদপুর ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে রাষ্টীয় মর্যাদায়
তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজা পূর্বে মরহুমের প্রতি
শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী অফিসার
শুভাশিস ঘোষ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হাজী আব্দুল হাই বাবলু। এসময় উপজেলা নির্বাহী
অফিসার শুভাশিস ঘোষ ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
দেভাশীষ চৌধুরী জাতীয় পতাকা দিয়ে তাঁর কফিন ঢেকে দেন। জানাজায় নামাজে
ইমামতি করেন মরহুমের নাতী হাফেজ রাব্বী। জানাজায় লালমাই উপজেলা চেয়ারম্যান
আব্দুল মালেক বি.কম, জেলা পিপি এডভোকেট জহিরুল ইসলাম সেলিম, জেলা আইনজীবী
সমিতির সভাপতি এডভোকেট আব্দুল মমিন ফেরদৌস, কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের
সাবেক অধ্যক্ষ ডা. মোসলেহ উদ্দিন, বিশিষ্ট সমাজ সেবক এস এ বারী সেলিম,
কুমিল্লা অজিতগুহ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক, কুমিল্লা
সরকারী কলেজের সাবেক জিএস জাকির হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ
কল্যাণ সম্পাদক নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তফা
হোসেন মজুমদার বাচ্চু, বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির মৈশান, ২২নং ওয়ার্ডের সাবেক
কাউন্সিলর আব্দুল মালেক ভূঁইয়া, ২২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
আলহাজ¦ গাজী মো. ছাদেকুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আজাদ হোসেন, মহানগর
যুবলীগের সদস্য দুলাল হোসেন অপু, সমাজ সেবক আব্দুল হালিম মজুমদার,
মুন্সিরহাট অহিদুল হক ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক ফাহাদুল ইসলামসহ বিপুল সংখ্যক
জনতা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশ গ্রহণ করেছেন।
মুজিবুল হকের শোক:
এদিকে
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও কুমিল্লা
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক মুজিব এমপি।
জেলা বিএনপির শোক:
১৯৫২’র
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া, প্রখ্যাত বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ও কৃষক
নেতা আলী তাহের মজুমদারের মৃত্যুতে কুমিল্লা দনি জেলা বিএনপি গভীর শোক
প্রকাশ প্রকাশ করেছেন।
কুমিল্লা দণি জেলা বিএনপি র সভাপতি, বিএনপির
কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইসচেয়ারম্যান বেগম রাবেয়া চৌধুরী ও জেলা
বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপির ত্রান ও পুনর্বাসন সম্পাদক হাজী
আমিন উর রশিদ ইয়াছিন, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় বিএনপির
সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগীয়) মোস্তাক মিয়া, এক বিবৃতিতে বলেন,
বিপ্লবী নেতা আলী তাহের মজুমদার তার সংগ্রামী জীবনে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন,
ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনসহ মানুষের অধিকার
আদায়ে আজীবন কাজ করে গেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিককে হারালো। তারা তার পরিবারের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।