বছরের প্রায় ছয় মাস লবণাক্ত থাকলেও সেই লবণাক্ত জমিতেই লবণসহিষ্ণু ফসল
চাষাবাদ করছেন তারা। ধান, তরমুজ, ভুট্টা, তেলবীজসহ (সূর্যমূখী) অনেক ফসল
ফলছে লবণাক্ত এসব জমিতে। ফলে আগের মতো এখন আর অলস সময় পার করেন না এ দুই
উপজেলার অর্ধলক্ষাধিক কৃষক।
লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদের জন্য উৎসাহিত করতে নিরলস পরিশ্রম করছেন দুই উপজেলার কৃষি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এসব এলাকায় কৃষকরা পাচ্ছেন সরকার প্রদত্ত সব ধরনের সুযোগ সুবিধা। এর
মাধ্যমে আবার কৃষির ভরসা হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চল।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই দুই উপজেলায় বাস্তবায়ন হচ্ছে ৫০ বছরের মেগা
প্রকল্প।
সূত্র মতে, বর্তমানে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। এ অঞ্চলে
গত চার বছরে ধানের উৎপাদন ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে
ভুট্টা, ডাল, তেলবীজ ও আলুর উৎপাদন।
খুলনার ডুমুরিয়া ও দাকোপ উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, লবণাক্ততার
কারণে আগে দক্ষিণের জেলাগুলোয় বছরে একবার বোরো ধান চাষ হতো। বাকি সময় জমি
অনাবাদি পড়ে থাকত। এর মধ্যে খুলনা অঞ্চলে ঘের করে শুরু হয় চিংড়ি চাষ।
কিন্তু চিংড়ি চাষে লোকসান, ধান উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকরা
বিকল্প হিসেবে ভুট্টা, ডাল, তেলজাতীয় শস্য ও আলুর মতো পুষ্টিকর খাদ্য
উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
উপকূলীয় অঞ্চল সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা ছিল এখানে ভালো শাকসবজি হয় না।
কিন্তু বর্তমানে এ ধারণা অনেকটাই বদলে গেছে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সবজি
এখন ট্রাকে করে দেশের অন্যত্র যাচ্ছে।
খুলনার এই দুই উপজেলায় চিংড়ি ও মাছ চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ফসলের
চাষ বাড়তে দেখা গেছে। বিশেষ করে সরিষা, সয়াবিন, সূর্যমুখী এবং মাছের ঘের ও
পুকুর পাড়ে সবজির আবাদ সহজেই নজর কাড়ছে।
খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার কৃষক মো. বোরহান উদ্দিন বলেন, এক যুগ আগেও
তিনি তার পতিত জমিতে মাছ উৎপাদন করেছেন। কিন্তু এখন কৃষি অফিসের সহায়তায়
নানা রকম সার ও কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে বছরের লবণাক্ত সময়েও চাষাবাদ
করছি।
তিনি বলেন, মোট ৫ একর জমিতে ছয়জন কৃষক ধান, গম ও ভুট্টা উৎপাদন করছি। এ
ফসল যথাযথভাবে উৎপাদনের জন্য কৃষি অফিস থেকে সহযোগিতা দেয়া হয়েছে।
বোরহান উদ্দিন আরও বলেন, আমাদের এখানে যখন প্রথম লবণসহিষ্ণু ফসল উৎপাদন
শুরু করি তখন উৎপাদন কম হলেও এখন আমরা ভালো ফসল উৎপাদন করতে পারছি।
দাকোপ উপজেলার নলিয়ান এলাকার কৃষক আব্দুল লতিফ, হায়দার মোড়ল, রাশেদ মোড়ল
ও পারুল বেগম বলেন, এ উপজেলায় লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি। একটা সময় ছিল
বছরে একবারের বেশি এ এলাকার অনেক জমিতে কোনো ফসল ফলানো সম্ভব হতো না।
কিন্তু এখন লবণাক্ততাকে পাশ কাটিয়ে অনেক ধরনের ফসল এখানে উৎপাদন করা হচ্ছে।
তারা জানান, এসব জমিতে তরমুজ, গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী,
গ্রীষ্মকালীন মুগ ডাল, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, সয়াবিন, চিনাবাদাম, বার্লি,
হলুদ, আদা, বিটি বেগুন উৎপাদন হচ্ছে।
এ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মেহেদী হাসান খান বলেন, দাকোপ উপজেলায় লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি। এখানে ধানের পরই বেশি উৎপাদন হয় তরমুজ।
তিনি বলেন, গত বছর দাকোপে এক হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ উৎপাদন
হয়েছে। এ বছর এই জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার হেক্টরের বেশি।
এছাড়া আমন ধান উৎপাদন হয়েছে ১৯ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে। ভুট্টা হয়েছে ৩৫
হেক্টর জমিতে।
এই কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, তরমুজে লাভের পরিমাণ বেশি হওয়ায় প্রতি বছর জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য সরকারিভাবে কৃষকদের অর্থসহায়তা
প্রদানসহ এক হাজার ১১০ জন কৃষককে এক হাজার কেজি বোরো ধান বীজ (দেয়া হবে),
৩৯৫ কেজি গম, ৭০২ কেজি ভুট্টা, ১৪৯ কেজি সরিষা, ১১৩ কেজি সূর্যমুখী,
গ্রীষ্মকালীন মুগ ৮০ কেজি (দেয়া হবে), রসুন ২৮০ কেজি, মরিচ ১ কেজি, তিল ১০
কেজি (দেয়া হবে), চীনাবাদাম ৮০ কেজি, বার্লি ২৪ কেজিসহ নানা ধরনের বীজ
প্রদান করা হয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মোছাদ্দেক হোসেন বলেন,
কৃষির উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা ৫০ বছরের মেগা
প্রকল্প গ্রহণ করেছি। ৬৪ হাজার কৃষক পরিবারের মধ্যে ৮ হাজার কৃষককে
ইতোমধ্যে হাইব্রিড বীজ, সার দেয়া হয়েছে। মুগ ও তিল চাষ সম্প্রসারণের জন্য
বীজ প্রদান করা হবে।
এছাড়া তরমুজ, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়স, মিষ্টি আলুর বীজ দেয়া হয়েছে। ফসল
উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি দফতর থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও
জানান তিনি।