![করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা](https://www.comillarkagoj.com/2021/04/30/1619725662.jpg)
অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ ।।
দীর্ঘদিন
বাংলাদেশের তথা বিশ্বের মানুষ করোনার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে
বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বিদ্যমান। প্রতিদিন গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে,
কিভাবে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিউ) সংকট, অক্সিজেন সংকট এবং হাসপাতালে
বেড সংকটে মানুষ মারা যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, দণি আফ্রিকার
ভ্যারিয়েন্ট অ্যাস্ট্রোজেনেকার ভ্যাকসিনে কাজ করছে না। ফলে করোনা দ্রুত
ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা ইতোমধ্যে বায়োইনফরমেটিক্সের মাধ্যমে প্রমাণ করেছি,
করোনাভাইরাসের মিউটেশন হলে সহজে ছড়িয়ে পড়বে, কিন্তু রোগ সৃষ্টি করবে কম।
এখানে রোগ সৃষ্টি কম বলতে বোঝচ্ছে, মানব দেহে ভাইরাস থাকলেও জ্বর, কাশির
মতো লণ প্রকাশ পাবে কম। কারণ তাদের সহজে চেনা যাবে না এবং লণহীনভাবে একজন
থেকে অন্যজনের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। হচ্ছেও তাই।
অনেকেই বলছেন, হার্ড
ইমিউনিটি কোথায় গেল? করোনার ক্ষেত্রে একজন মানুষ দুই থেকে তিনজনকে আক্রান্ত
করতে পারে। সেই হিসাবে ৫০-৭০ ভাগ মানুষ করোনার বিরুদ্ধে ইমিউনিটি পেলেই
রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। তাহলে কি মাত্র ৫৬ লাখ ভ্যাকসিন এবং আরো ৭ লাখ সংক্রমণ
যদি ধরি, তাহলেও তো ৫০ ভাগ লোক ইমিউনিটি পায়নি। যদি সংক্রমণের হিসাব ভুল
ধরি, তাহলে অর্ধেক লোক এখনো প্রতিরোধ পেয়েছে। তাই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে
আরও সময় নিতে পারে।
বর্তমানে যে লকডাউন চলছে তার মধ্যেই কতজন মানুষ
মাস্ক পরছে- রাস্তার বেরুলে দেখার চেষ্টা করি। খুবই দুঃখজনক। অনেকে মাস্ক
পরলেও নাক ও মুখের নিচে রেখে দেন। প্রকৃত বিজ্ঞান এদেশের মানুষকে জানানোর
দায়িত্ব কেউ নিল না। দেখছি, বিভিন্ন ধরনের জরিমানা করা হচ্ছে। জরিমানার
টাকা দিয়ে যদি উন্নত মানের মাস্ক পরিয়ে দেওয়া যায়, তবেই করোনা প্রতিরোধ
সম্ভব। আমি দুটি দেশের উদাহরণ দেব, যারা কোনোরকম লকডাউন ছাড়াই করোনা
নিয়ন্ত্রণ করেছে। এসব দেশের ৩৮ ভাগ মানুষ ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে- তারা কিভাবে
করোনা প্রতিরোধ করেছে?
আমাদের দেশের যারা বিদেশে যেমন: জাপানে
উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েছেন তারা সাক্ষী কিভাবে একজন জাপানি সামান্য
ঠান্ডা কাশি হলেই মাস্ক পরেন। এই অভ্যাস এখন জাপানিজদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে
গিয়েছে। এটি শুরু হয়েছিল ১৯১৯ সালের ফু থেকে। এরপর থেকে কারো সামান্য
ঠান্ডা লাগা অবস্থায় মাস্ক না পরাকে অভদ্রতা বলে মনে করে। ১৯৫০ সালে তারা
যা রোগের কারণে ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং সিস্টেম চালু করে, যাতে নতুন কেস
শনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং তাকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই দুই
সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে জাপানে করোনা অনেক কম এবং সেখানে মাত্র তিনটি
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জনগণকে। ভিড় এড়িয়ে চলা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং হাত
ধোয়ার অভ্যাস করা। অথচ আমাদের দেশে অনেক ধরনের নির্দেশনা আছে। ফলে জনগণ
বিভ্রান্ত কোন নির্দেশনা তারা অনুসরণ করবে।
লকডাউনের মধ্যে জরুরি
প্রয়োজনে অনেকবার ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। অলিগলিতে ৮০ শতাংশ
মানুষ মাস্ক পরে না। অথচ প্রধান সড়কে পুলিশ থাকায় ৮০ ভাগ মানুষই মাস্ক
পরছে। এরপর বলব দণি কোরিয়ার তিনটি পদ্ধতির কথা। প্রথমটি হলো টেস্ট। প্রায়
৬০০ ল্যাবে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ ১০ হাজার টেস্ট করা হয়। পজিটিভ কেসদের
ট্রেস করে আলাদা করা হয় এবং তাদের কোয়ারেন্টাইনে রেখে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ
করা হয়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বাংলাদেশে বর্তমানে পজিটিভ রোগীদের কোনো
ট্রেসিং হচ্ছে না। নিজ দায়িত্বে তাদের বাসায় থাকতে হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার
তৃতীয়টি হচ্ছে চিকিৎসা পদ্ধতি। কেউ করোনা পজিটিভ হলে সাথে সাথে হাসপাতালে
চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশের এত মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা
করা অসম্ভব। আমরা যদি জাপানিজ পদ্ধতি অনুসরণ করি, তাহলেও বাংলাদেশের
রাস্তা, বাজার, হাসপাতালে কোথাও দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাকি
থাকে হাত ধোয়া ও মাস্ক পরা।
গণমাধ্যমে যেভাবে দেখায় অতি উন্নতমানের
স্যানিটাইজার ও হ্যান্ডওয়াশ ছাড়া হাত জীবাণু মুক্ত হয় না। এটি ভুল। যে কোনো
ারীয় পদার্থ দ্বারাই এটি সম্ভব। এ ছাড়া পৃথিবীখ্যাত ‘নেচার’ সাময়িকীতে বলা
হয়েছে, একজন ব্যক্তি থেকে ছড়ানোর তুলনায় ১০০০ থেকে মাত্র ৫ ভাগ ছড়ানোর
আশঙ্কা দূষিত বস্তু থেকে। সুতরাং বাংলাদেশে প্রধানত ছড়াচ্ছে ব্যক্তি থেকে
ব্যক্তিতে। কিভাবে এত ছড়াচ্ছে? কোন জ্ঞানের অভাব? প্রথমত আমরা জানি না যে,
৫০ ভাগ উপসর্গহীন মানুষও করোনা ছড়াতে পারে। আমরা যাকে সাধারণ চোখে রোগহীন
ভাবছি তারা কিন্তু নীরোগ নয়। নীরবে করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়
হচ্ছে, সিডিসির তথ্যমতে, কমপে ১৫ মিনিট একজন করোনা রোগীর সংস্পর্শে থাকলে
করোনা হতে পারে।
কোন জায়গা বেশি খারাপ? বদ্ধ জায়গা। যেখানে বেশি বেশি
চিৎকার, গান ও অন্যান্য শারিরীক কার্যক্রম বেশি হয়, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের
ব্যবস্থা নেই। করোনাভাইরাস বাতাসে বাঁচে মাত্র ৩ ঘণ্টা। অনেকে মাস্ক পরে
নাকটা বাইরে রাখছেন। শতকরা ৯৮ ভাগ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে নামে ও মুখে। তাই
যখনই ভিড়ে যাবেন, তখন অন্তত এই জায়গা দুটো ঢেকে রাখুন।
এখন আসি কোন
মাস্ক ভালো? বলার অপো রাখে না এন-৯৫ মাস্ক সবচেয়ে ভালো। এটি শতকরা ৯৫ ভাগ
ফিল্টার করে অ্যারোসল। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য এর ব্যবহার কষ্টসাধ্য ও
ব্যয়বহুল। তারপর সার্জিক্যাল, এটা ৯০ ভাগ কার্যকরি। স্কার্ফ বা হিজাব দিয়ে
নাক ঢাকলে ৫৪ ভাগ কার্যকরী। দুই লেয়ার সুতি কাপড়ের মাস্ক ৮২ ভাগ কার্যকরি।
সরকার হতে এই শ্রেণির মাস্ক তৈরি করে জনগণকে বিতরণ করা যেতে পারে। আমাদের
রাজনৈতিক নেতারা এই ধরনের মাস্ক বিতরণ করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, করোনার
মধ্যেই বসবাস করতে হবে। জাপানিজরা যা ১০০ বছর আগে শুরু করেছে, আমরা না হয়
এই করোনা থেকে শুরু করি।
লেখক: চেয়ারম্যান, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ ও সহযোগী পরিচালক, জিনোম সেন্টার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়