ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথা
Published : Tuesday, 4 May, 2021 at 12:00 AM
শতবর্ষ আগে কুমিল্লায় নজরুল ইসলামের আগমন উপলক্ষে কিছুকথাশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ।।

চতুর্থ পর্ব
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২১ সালে এপ্রিল মাসে যখন প্রথম কুমিল্লায় এসেছিলেন এবং পরে আরো চারবার, তখন কাঁদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে, ঘনিষ্ঠতা হয় এবং পারস্পরিক সম্পর্কের মাত্রাটা কীরূপ ছিল, শতবর্ষ পরে এনিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করা যেতে পারে।
    আলী আকবর খানের সঙ্গে পরিচয় হয় কোলকাতায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতে। আলী আকবর খান প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রদের জন্য পাঠ্য-পুস্তক লিখতেন, এ লেখাগুলো শিশুতোষ ছিল না। নজরুল তা দেখে বলেছিলেন-“অপূর্ব চিজ’। পরে কবি ‘লিচু চোর’ কবিতা এবং আরও কিছু শিশুতোষ পাঠ্য রচনা লিখে দিয়েছিলেন। কাজেই খানসাহেব মনে করলেন যেকোনো উপায়ে নজরুলের সহায়তা তাঁর চাই-ই। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী আলী আকবর খান নজরুলকে তাঁর সঙ্গে তাঁদের গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন। মুজফফর আহমদ বাধা দিলেও কেন তিনি এলেন? নজরুলের ভাষ্য-
‘আমি এই একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে আসছি যে, কাজের মাঝে ডাক পড়লে আমি তাতে সাড়া দিতে পারি না, কিন্তু বিনা কাজের ডাকে আমার মাঝের পাগল কি উল্লাসেই না নৃত্য করে উঠে।’
তারপরের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সকলের জানা।
    নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সঙ্গে প্রথমে কুমিল্লা শহরে কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় এসে উপস্থিত হন। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত আলী আকবর খানের বন্ধু। কুমিল্লা জিলা স্কুলের সহপাঠী। তখন থেকে খানসাহেবের যাতায়াত। বীরেন সেনের মা বিরজাসুন্দরীদেবী খুবই ¯েœহপরায়ণা। তিনি পুত্রের সহপাঠীকে আপন সন্তানের মতো ¯েœহ করতেন। আলী আকবর খান তাঁকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। এই অধিকারে নজরুলও এ পরিবারে ¯েœহাধিকারে ঋদ্ধ হলেন এবং ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ও বীরেন সেনের যথাক্রমে ¯েœহ ও বন্ধুত্ব লাভ করলেন। বীরেন সেনই নজরুলকে কুমিল্লায় বিভিন্ন অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দেন। ‘জাগরণী’ গান রচনা, মিছিলে গান গাওয়া, স্বল্পসময়ের জন্য নজরুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থানায় একসঙ্গে অবস্থান ইত্যাদি সহযোগী ছিলেন, বিশেষত দৌলতপুরে নজরুলের তথাকথিত বিবাহ-নাট্যের ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষীও বীরেন সেন এবং তাঁর সঙ্গে রাতের অন্ধকারে আষাঢ় মাসের ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় সঙ্গী ছিলেন বীরেন সেন। সুতরাং নজরুলের কুমিল্লায় আগমনের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে এইসব বিষয়গুলোও স্মরণ করতে হবে।
    স্মরণ করতে হবে কীভাবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রাবাসে নজরুলের সংযোগ ঘটে। মরহুম সুলতান মাহমুদ মজুমদার তাঁর ‘ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি’ গ্রন্থে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি শুধু নিজের সম্পৃক্ততার কথাই বলেছেন, অন্যকোনো ছাত্রের নাম উল্লেখ করেননি। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় আনতে হবে। প্রসঙ্গত কলেজ অধ্যক্ষ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাসায় নজরুল আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, সেখানে গান রচনা করেছেন, গান পরিবেশিত হয়েছে, তখন কিন্তু নজরুল রবীন্দ্রসঙ্গীতই পরিবেশন করতেন। অধ্যক্ষ বসুর পরিবারের সদস্যগণ নিশ্চয়ই এ আসরে গান পরিবেশন করেছিল, ছাত্রদের উপস্থিতি ছিল কীনা, থাকলেও কতবার এরূপ আসর বসেছিল ইত্যাদি আজ গবেষণার বিষয়।
    চর্থার রাজবাড়ির কর্ণধার মহারাজ নবদ্বীপ দেববর্মন সঙ্গীতপ্রিয় ব্যক্তি। বাড়ির আবহাওয়ায় সঙ্গীতের সুরে বাঁধা। নারী-পুরুষ-চাকর-বাকররাও এ ¯্রােতে ভাসমান ছিল। মহারাজ নবদ্বীপ দেববর্মন ছিলেন যন্ত্রশিল্পী। তাঁর কনিষ্ঠপুত্র শচীন দেববর্মন তখন (১৯২১) ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। ১৯২৪-এ বি,এ পাশ করেন। নজরুলের কুমিল্লার যাতায়াত ছিল ১৯২১ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত। তবে ১৯২২ সালে দীর্ঘ চারমাস একটানা থেকেছেন, তখনই কুমিল্লার নানা অঙ্গনের গুণিজনের সঙ্গে কবির পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা বা মেলবন্ধন হয়। এ ধারাবাহিকতায় দারোগাবাড়ির মার্গসঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে। উল্লেখ করতে হয়-সমসাময়িককালে গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত প্রমুখের কথা শোনা যায়, ওস্তাদ সুরেন্দ্রনারায়ণ দাশ তখন কুমিল্লায় ছিলেন কীনা ইত্যাদি বিষয়গুলো এবং পরে কোলকাতায় কুমিল্লার শৈলদেবীর সঙ্গে পরিচয় ও সঙ্গীত-শিক্ষা প্রদান বিষয়গুলো নিয়ে সূক্ষ্মভাবে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে। অন্যদিকে কংগ্রেসনেতা বসন্তকুমার মজুমদারের সঙ্গে পরম্পরা কোনো রাজনৈতিক যোগসূত্র রচিত হয়েছিল কীনা তাও গবেষণার দাবি রাখে। একটি তথ্যে জানা যায়, নজরুলকে ফিরিয়ে নিতে কোলকাতা থেকে মুজফফর আহমদ অধ্যাপক ফকিরচাঁদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে থেকে ৩০ টাকা নিয়ে কুমিল্লায় এসেছিলেন। যাওয়ার সময় তাঁরা যখন চাঁদপুর পৌঁছলেন, তখন বন্দরের শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছিল এবং তিনদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এদিকে এই তিনদিনে তাঁদের খাওয়া-দাওয়ায় যাতায়াত ভাড়ার টাকা খরচ হয়ে যায়। এই অবস্থায় কংগ্রেসনেতা হরদয়াল নাগ ও মৌলভী আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী ধর্মঘট পরিচালনায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বসন্তকুমার মজুমদার ও হেমপ্রভা মজুমদারও ছিলেন বলে জানা যায়। তখন হরদয়াল নাগের অনুরোধে মৌলভী আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী মুজফফর আহমদ ও নজরুল ইসলামের কোলকাতায় যাওয়ার খরচের টাকা সংগ্রহ করে সহযোগিতা করেছিলেন। এসব বিষয়গুলো শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিবেচনায় আনতে হবে বলে মনে করি। এছাড়া কুমিল্লার অতীন রায়, খিলাফত মজলিসের আফতাবুল ইসলামসহ যাঁদের সান্নিধ্য নজরুল ইসলাম তখন লাভ করেছিলেন এবং বৈরি পরিস্থিতিতে তাঁকে যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, সে সকল বন্ধুসজ্জনদের কথা স্মরণ করতে হবে।
    নজরুল ইসলাম যখন আলী আকবর খানের সঙ্গে দৌলতপুর গেলেন সেখানে যাঁদের সঙ্গে সখ্যতা হয়েছে, তাঁদেরও স্মরণ করা যেতে পারে। মুরাদনগরের দৌলতপুরের মুন্সী আবদুল জব্বর, আলী আকবর খানের বড়ভাই নেজামত আলী খান, জনার্দন দত্ত, সাদত আলী মাস্টার, জমির উদ্দিন (গাবুদ্দিন), মৌলবী মকতুল হোসেন ওরফে বেঙ্গু মৌলবী প্রমুখের কথা স্মরণ করতে হবে। দৌলতপুরে নজরুল-নার্গিসের তথাকথিত বিয়ে অনুষ্ঠানে বাঙ্গুরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার ও বাঙ্গুরা স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা নিশ্চয়ই খাঁ-বাড়ির নিমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। এ প্রসঙ্গে নজরুলের ¯েœহধন্য বালিকাদের কথাও উল্লেখ করতে হয়। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ির আশালতা সেনগুপ্ত (দুলী), কমলা ও অঞ্জলি, অন্যদিকে বসন্তকুমার মজুমদার ও হেমপ্রভা মজুমদারের দু’কন্যা শান্তিলতা ও অরুণা এবং দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির নার্গিস ছাড়াও ‘গ্রামের ছেলেমেয়েকেও কবি জোর করে ধরে গান শেখাতেন। দু’তিনটি মেয়েকে তিনি নাচ শিখিয়েছেন ঝুমুর পায় দিয়ে। তিনি নিজে গাইতেন হারমোনিয়ম বাজিয়ে আর মেয়েদের নাচতে দিতেন।’
তাদের পরিচয় কি ইত্যাদি জানতে হবে।
    নজরুল ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। শানবাঁধানো পুকুর ঘাটের সংলগ্ন আমতলায় বসে তিনি বাঁশি বাজাতেন আপন মনে, পাড়ার ছেলেমেয়ে-বড়রা এসে ভীড় জমাত। নার্গিসও নজরুলকে বলেছিলেন-‘গত রাত্রে আপনি কি বাঁশী বাজিয়েছিলেন? আমি শুনেছি।’ জানা যায় প্রথমে আলী আকবর খানের ভাই ওয়ারেছ আলী খানের মেয়ে হেনাকে নজরুলের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়। আলী আকবর খান ব্যর্থ হয়ে শেষপর্যন্ত বড়বোনকে বুঝিয়ে নার্গিসের জন্য পাত্র হিসেবে প্রশংসা করে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব খুঁটিখাটি বিষয়গুলোও-জানার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, দৌলতপুরের খাঁ বাড়ির পরিবেশটা ছিল-
‘(কিন্তু) বাড়ির যারা বয়োজ্যেষ্ঠ, দুনিয়াদারীতে অভিজ্ঞ, তারা উড়ে আসা জুড়েবসা, ছন্নছাড়া, হৈহুল্লোড় মেতে থাকা অদ্ভুত স্বভাবের যুবকটিকে (নজরুলকে) বিশেষ করে নার্গিস-নজরুলের প্রণয় সম্পর্কিত বিষয়কে ভাল চোখে দেখেননি। কিছুটা বরং রুষ্টও হয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্বান গ্রাজুয়েট ভাইয়ের মতের বিরুদ্ধে জোর করে কিছু বলেননি।’
[কুমিল্লায় নজরুল: মোহাম্মদ আবদুল কুদ্দুস]
এসব বিষয়ও বিবেচনায় আনতে হবে। এতসব কথা বলার অর্থ হলো এখনও ‘নজরুল ও কুমিল্লা’ প্রসঙ্গ নিয়ে প্রামাণিক গবেষণা হয়নি। একাজগুলো করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
[পঞ্চম পর্ব পরবর্তী মঙ্গলবারে ছাপানো হবে।]