মোস্তফা কামাল ||
করোনা
নির্দোষে নিরপেক্ষতায়-নিরবচ্ছিন্নতায় যা করার করেই যাচ্ছে। দোষের
পুরোভাগে সরকার। দোষী-দায়ী সাব্যস্ত করে বলা হচ্ছে, সরকারের ব্যর্থতার
কারণেই কোভিড-নাইনটিন নামের ঘাতকটি দাপটের সঙ্গে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে।
সরকারের দোষেই এতো মৃত্যু-সংক্রমণ বাড়ছে। দোষী বিরোধীদলও। তাদের
উল্টাপাল্টা ভূমিকায় মানুষ স্বাস্থ্যবিধিতে অনিহা দেখাচ্ছে। আবার সাধারণ
মানুষও ব্যাপক দায়ী। তাদের অসচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণেই
করোনাকে রোখা যাচ্ছে না।
নির্দোষের তো করণীয় কিছু থাকে না। তাই নিজে
বহাল তবিয়তে ভালো থাকা ছাড়া করোনার করার কিছু নেই। ভালো থাকাই তার দায়িত্ব।
সব করনীয় ও দায়িত্ব দায়ীদেরই। দায়ি পক্ষগুলোর সবাই দোষারোপে মত্ত। চরম
উত্তেজিত-মারমুখীও। এক পক্ষ বলছে ‘মার্কেট খুলে দিয়ে সাড়ে সর্বনাশ করছে
গন্ডার সরকার!’ আরেক পক্ষ বলছে, ‘মার্কেট না খুললে এতো মানুষ খাবে কী? চলবে
কিভাবে? যুক্তিতে সবপক্ষই বড় কড়া। করোনাকে মোকাবেলা কারোই
সাবজেক্ট-অবজেক্ট নয়। করোনার ফাঁকে চামেচুমে নিজে বাঁচাই সারকথা। নিজেকে
ইনট্যাক্ট বা নিরাপদ রেখে বাদবাকিদের করোনাক্রান্তের তালিকায় ভাবার
মানসিকতা একদম স্পষ্ট।
দিনপঞ্জিকা হিসাবে নিলে দেশে করোনাকাল চলছে বছর
দেড়েক প্রায়। আর অর্থবছরের হিসাব ধরলে করোনা তিন বছর ছুঁই ছুঁই। দেশে
করোনারোগী শনাক্ত হয় ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকের ২০১৯ এর ৮ মার্চে।
আর প্রথম মৃত্যু হয় এর ১০দিন পর ১৮ মার্চে। সেই থেকে মৃত্যু, আক্রান্ত,
শনাক্ত, ওয়েভ, ভেরিয়েন্ট, লকডাউন, বিধিনিষেধের নানা রকমফের ও রেকর্ড।
এবারের এপ্রিলে এসে মানুষের চলাচল, গণপরিবহন, যানবাহন ও ব্যবসা-বাণিজ্য
চালু রাখার ক্ষেত্রে নানা বিধি-নিষেধ। কড়াকড়ি, শৈথিল্যের দফায় দফায়
প্রজ্ঞাপন। নতুন অর্থবছর ২০২১-২২ শুরু হবে যথারীতি ১ জুলাই থেকে। অলৌকিক
কিছু না ঘটলে করোনা তৃতীয় অর্থবছরের দুয়ারে। তার ভঅলো থাকারই আভাস। ২০২১-২২
অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ছক-নকশা শেষ প্রায়। বাকি কেবল উপস্থাপন।
এরপর অনুমোদন। প্রথা অনুযায়ী তা হবে জুনের মধ্যেই। সেই সময় পর্যন্ত করোনার
অবস্থা খারাপ হবে বা সে চলে যাবে এমন কোনো আভাস এখন পর্যন্ত নেই। বরঞ্চ
মহামারি করোনা তার সক্ষমতা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে গোটা বিশ্বকে। রূপ আছে
বলে তা বদলাচ্ছে। তেজি হচ্ছে।
আগে বিভিন্ন শতকে আসা কলেরা, ম্যালেরিয়া,
প্লেগ ইত্যাদি মহামারি রূপ পাল্টে দুর্বল হয়েছে। আর করোনা রূপপাল্টে হচ্ছে
আরো শক্তিধর। দৈনন্দিন জীবনে মানুষ চেতনে-অবচেতনে হাত দিয়ে কতো কাজ করে,
হাত কতো জায়গায় নেয়- নিজেও জানে না। এসব কাজ করতে গিয়ে হাতে লাগে অসংখ্য
জীবাণুর সংস্পর্শ। এতে প্রত্যেকের হাত প্রত্যেকের শত্রু হয়ে ওঠে। যার ফলে
ছড়ায় নানা রোগবালাই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়মে
হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়েও বেশি কাজ করে। সেই বিবেচনায়
হাত ধোয়া একটি সাশ্রয়ী স্বাস্থ্য অভ্যাস। হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে পানি ও
মলবাহিত রোগগুলো বেশি দূর এগুতে পারে না।
করোনা মহামারি আপাতত আমাদের
হাতমুখ ধোয়ার অভ্যাস গড়ে দিতে পেরেছে। আরো কিছু বদবৈশিষ্ট্যেও বাধ সাধতে
পেরেছে। কোনো রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অবিরাম বেত মেরে তাদের সভ্য বানাতে
পারে না। নাগরিকদেরও সভ্য হওয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। সুস্থ থাকা ও রাখার চর্চাও
করতে হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলতে হয় হাত-মুখ ধুয়ে
পয়পরিস্কার থাকতে। কোন তলানিতে জণসচেতনতা? জনগণের বোধ-বুদ্ধি? করোনাকালে
প্রমান হয়েছে এতোদিন শিক্ষা মানুষকে দায়িত্ব সচেতন করেনি। সভ্য করেনি। আমরা
মরতে চাই না, কিন্তু স্বর্গে যেতে চাই। বিষ গিলতে চাই। নিয়ম মানতে চাই না।
কিন্তু করোনা থেকে সুরক্ষা চাই। হাঁচিকাশি দিতে দিতে, দাঁত
খোঁচাতে-খোঁচাতে সরকারের ভুলত্রুটি ধরে ফেলছি।
ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে
সাফসতুর রাখার দায়িত্ব সরকারের নয়। সরকারের পক্ষে সেটা সম্ভবও নয়। নিজেরা
ভাইরাস ছড়ালে, জন্ম দিলে সরকার কী করবে? যত্রতত্র থুতু ফেলা, পানের পিক
ফেলা এবং নাক ঝাড়া বন্ধ করতে সরকারের আদেশ- অনুরোধ লাগছে। নিজেদের চারদিকসহ
গোটা পরিবেশকে ভাইরাসের হ্যাচারি করে ফেলছেন কেউ কেউ। চিপসের প্যাকেট,
প্লাস্টিকের বোতলসহ আবর্জনা ফেলে ভাইরাসের ভাগাড় তৈরি করলে সরকার বা
রাষ্ট্র এখানে কী করবে? কব্জি ডুবিয়ে খাবো আমি, আর খাওয়ার পর সাবান দিয়ে
কব্জি ডুবিয়ে হাত ধুয়ে দেবে আরেকজন? বা সরকার?
করোনাসহ নানা ভাইরাসের
বিস্তার ঘটাতে আমরাই যথেষ্ট। আলামত এবং পারিপার্শ্বিকতায় জানাই ছিল করোনা
থেকে বাংলাদেশ রেহাই পাবে না। কার সাথে কথা বলছি, ঘুরছি- একটুও ভ্রুক্ষেপ
নেই। সেল্ফ কোয়ারেন্টাইন বুমেরাং হয়ে গেছে কবেই। স্বাভাবিক স্বাস্থ্যবিধিও
মানতে নারাজ আমরা। করোনা মোকাবিলার নামে মাস্ক পরে ঘুরছি। আবার এক বিড়ি
ফুঁকছি চারজনে। মাস্ক আর স্যানিটাইজার নিয়ে যে কা- ঘটছে তা আমাদের অভ্যাস
বদলানোর বার্তা দেয় না। অমানবিক- পৈশাচিক বর্বরতাও বাদ দিচ্ছি না। এমন
নিদানকালেও পরিবেশের বারোটা বাজাতে আমরা কমতি করেছি? হাট বাজারে, মাঠ
ময়দানে যেভাবে বঙ্গসন্তানরা বীর বিক্রমে বাজার সওদা আর আহাম্মকের মতো
নিশ্চিন্তে হেঁটে হেঁটে খোশগল্প করছি, তাতে পঙ্গপাল কেন, গোটা প্রকৃতিরই ভয়
পেয়ে আইসোলেশনে চলে যাওয়ার দশা। হাত স্যানিটাইজের মতো মনটাকে স্যানিটাইজ
করার গরজ আছে ক’জনের?
করোনায় গোটা বিশ্ব শেষ হয়ে যাবে, আমরা সবাই মরে
যাবো- এমন কোনো বাজে আভাসও নই। বেঁচে যাওয়াদের কী হবে?-সেই নির্দেশনাও নেই।
করোনা ঠেকাতে বাংলাদেশে লকডাউন তেমন ফলপ্রসূ কিছু নয়, সেটাও প্রমাণের বাকি
নেই। গণপরিবহনে এখন আর স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বাধ্যতামূলক মাস্ক
পরা হচ্ছে না। শপিংমল, বাজারগুলোতে ভিড় আছে। কম-বেশি সভাসমাবেশও হচ্ছে।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে। বিয়ে শাদী হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন
তোয়াক্কা নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। করোনা নির্দিধায় স্বস্তিতে ধেয়ে
চলছে উল্লাসনৃত্যে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।