বিডিনিউজ
: মহামারীর বাস্তবতার পাশাপাশি দক্ষতার সঙ্কটের বিষয়গুলো তুলে ধরে নতুন
অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন মহল সংশয় প্রকাশ করলেও অর্থমন্ত্রী
আ হ ম মুস্তফা কামাল আশাবাদী। তিনি বলেছেন, ‘অতীতের ধারাবাহিকতায়’
অর্থনীতির শক্তিশালী সূচকগুলোতে ভর করে এবারও বাজেট ‘সফলভাবেই’ বাস্তবায়িত
হবে বলে তার বিশ্বাস।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬
লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম
মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটে দুই লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হয়েছে
যা জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে বরাদ্দের
পুরো অর্থের এক তৃতীয়াংশ সরকারকে ঋণ করতে হবে। মহামারীর ধাক্কা সামলে
অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করা না গেলেও অর্থমন্ত্রী ৭ দশমিক ২ শতাংশ
জিডিপি প্রবৃদ্ধির আশা করছেন।
প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এবারের বাজেটে দেশীয় শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য
কিছু ভালো উদ্যোগ থাকলেও মহামারী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও
সামাজিক সুরক্ষায় যে পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন ছিল, তা অনুপস্থিত।
রেওয়াজ
অনুযায়ী বাজেটের পরদিন শুক্রবার বাজেট নিয়ে খুঁটিনাটি প্রশ্নের উত্তর দিতে
সংবাদ সম্মেলনে আসেন অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল। মহামারীর মধ্যে তার
এবারের বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন হয় অনলাইনে।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর
রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক
উপদেষ্টা মসিউর রহমান, অর্থ বিভাগের সচিব আবদুর রউফ তালুকদার, বাংলাদেশ
ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম,
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলমও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থেকে বিভিন্ন
প্রশ্নের উত্তর দেন।
মহামারীর কারণে টানাটানির এই সময়ে ৭ দশমিক ২ জিডিপি
প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা কতটা বাস্তবসম্মত? রেকর্ড ঘাটতির এই বাজেট কতটা
বাস্তবায়নযোগ্য? অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের ভারসাম্য কীভাবে করতে
চান? সংবাদ সম্মেলনে এসব প্রশ্ন ছিল গণমাধ্যমকর্মীদেরও।
উত্তরে
অর্থমন্ত্রী বলেন, “অতীতে যে ধরনের লক্ষ্য ঠিক করেছি তা অর্জন করেছি।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেসব থ্রেশল্ড দরকার, বাংলাদেশের সেগুলো খুব স্ট্রং
আছে। এই খারাপ অবস্থার মাঝে সারা বিশ্ব যেখানে অর্থনীতির সূচক নি¤œমুখী,
সেখানে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির গতিধারা অগ্রসরমান। সুতরাং এই
পরিস্থিতি অতীতের রেকর্ডের ধারাবাহিকতায় এই বাজেটও খুব সহজেই বাস্তবায়ন
হবে।”
আর ঘাটতি বাজেট নিয়ে মুস্তফা কামালের উত্তর: “মহামারীতে অর্থনীতি
স্থবির হয়ে যাওয়ার পর ঘাটতি বাজেট এখন উৎসাহিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সারা
বিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়াতে আলোচনার বিষয়। আমাদের ঋণ: জিডিপি অনুপাত ৪০
শতাংশের নিচে। চীন বা ভারতের প্রায় শতভাগ। সুতরাং এটা আমরা বহন করতে পারব।“
দেশের
অর্থনীতির কয়েকটি শক্তিশালী সূচকের উদাহরণ দিতে গিয়ে রেমিটেন্স ও
রিজার্ভের কথা বলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, ২০১৯ সালের ৩০ জুন যেখানে
রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন, বাজেটের দিন তা ছিল ৪৫ দশমিক ১ বিলিয়ন
ডলার।
২০১৯ সালের ২৯ জুন সংসদে দেওয়া নিজের বক্তব্যের কথা মনে করিয়ে
দিয়ে তিনি বলেন, “সেদিন বলেছিলাম আজকে আমরা ঋণ নিচ্ছি। সময় খুব কাছে যেদিন
ঋণ দেব। সেই বিষয়টি আপনার নিশ্চিয় জানেন।”
ঘাটতি বাজেট ‘নতুন কিছু নয়’
মন্তব্য করে পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, “কারো কারো মনে পরিমাণ
নিয়ে সংশয় আছে। এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। উত্তর লেখা আছে কর্মপরিকল্পনায়।
আমরা অনুমানের জগতে আছি। সেটা নিয়ে তর্ক করে ফায়দা হবে না। গত কয়েক বছরে
সরকারের কর্মকা- যেভাবে চলেছে। গত ১০ বছরে সার্বিকভাবে ইতিবাচক ধারায় ছিল।
সেই ভাবেই এই বাজেট যোগান দেব।
“বাইরে থেকে ধারের বাজার এখন খুব ভালো।
আমাদের রেকর্ডও খুব ভালো। অপচয় করি না। সময় মত পরিশোধ করি। পজিটিভভাবে করি
বলেই গ্রোথ ধরে রাখতে পেরেছি। কোনোভাবেই এটা নিয়ে ভয় পাচ্ছি না। দু’চার
মাসের মধ্যেই আপনি টের পাবেন।“
অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন,
এবারের বাজেটে যে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হয়েছে, তাতে পঞ্চবার্ষিক
পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি রাখা হয়েছে। এটা
করা হয়েছে যাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
“কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে।
মেইড ইন বাংলাদেশ পণ্যে ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে-
মানুষ বেসরকারি সেক্টরে বিনিয়োগ করবে। এর ফলে চাকরির সৃষ্টি হবে। দুই সাইড
থেকে কর্মসংস্থানের চেষ্টা করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে
পাঁচ মাসের মধ্যে সবাই চাকরি পাবে বলে আমরা মনে করি।”
উন্নয়ন পরিকল্পনায়
জিডিপির ৩২ শতাংশ ব্যয় করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তর অর্থমন্ত্রী
বলেন, “উন্নয়নের জন্য টাকা কোথা থেকে আসবে সেটা বাজেটে লেখা আছে। রাজস্ব
আহরণে প্রবৃদ্ধি ৩০ শতাংশ। রপ্তানি বাণিজ্য বেড়েছে। মে মাস গ্রোথ ১৩ শতাংশ।
রেমিটেন্স প্রবৃদ্ধি ৩৯ শতাংশ। রেমিটেন্স থেকেই ৭ বিলিয়ন ডলার বেশি
পেয়েছি। আমি উন্নয়ন পরিকল্পনায় রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে কোনো সমস্যা দেখছি না।”
কৃষিমন্ত্রী বলেন, সরকারের লক্ষ্য হল শস্য উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আনা এবং খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
“আমরা
প্রথম বাজেট থেকেই ১০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা বা বিনিয়োগ দিয়েছি সারের
দাম কমাতে। ফলে আমাদের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষি উন্নয়ন অব্যাহত রাখা ও উৎপাদন
যেটা বেড়েছে, সেটা ধরে রাখার চেষ্টা আমরা করছি। কৃষির বাজেট এবারও কমেনি।
কৃষিঋণের সুদের হার কমেছে। ১৫ হাজার টাকা থেকে ২২ হাজার টাকা হয়েছে কৃষিঋণ।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণে যাচ্ছি। সেজন্য ৬৮০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।”
কর্মসংস্থানের
জন্য কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে জোর দেওয়ার কথা জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, “যখনই
দরকার হবে, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে অন্য জায়গা থেকে এনে দেওয়া হবে। এসব
খাতে কোনো ঘাটতি নেই।”
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম বাজেটে
বিনিয়োগ ও জিডিপির হার প্রসঙ্গে বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষে
বিনিয়োগ জিডিপির ৩৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা আছে। এখনই তা ৩১ শতাংশে
আছে।
“তাই আমার কাছে বেশি মনে হচ্ছে না। কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। ব্যবসা
যাতে সক্রিয় হয় সেজন্য সরকার কর কমিয়ে ঝুঁকি নিয়েছে। প্রাইভেট সেক্টরকে
উন্নয়নের ড্রাইভিং সিটে রাখতে চাচ্ছে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, “ফিজিক্যাল
বিনিয়োগের সাথে সাথে নন ফিজিক্যাল বিনিয়োগ দেখতে হবে। আগে টেকনলজি,
টেকনিক্যাল শিক্ষার গুরুত্ব কম ছিল। এখন এই দিকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। চার
টাকা বিনিয়োগ করলে এক টাকা আউটপুট পাব বলে যে ফর্মুলা আছে, সেটাও পরিবর্তন
সম্ভব। এর চেয়ে বেশিও আর্ন করা সম্ভব।”
বাজেটে কর্মসংস্থান নিয়ে ‘স্পষ্ট
বক্তব্য নেই’ বলে যে সমালোচনা হচ্ছে, তার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এবারের
বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য, বিনিয়োগের জন্য ‘প্রচুর সুযোগ’ সৃষ্টি করা হয়েছে।
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে নতুন নতুন ব্যবসার সম্প্রসারণ হবে, তাতে
কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
ভবিষ্যতে ভ্যাট, ট্যাক্স কমিয়ে দেশীয় শিল্পকে আরও বেশি সুরক্ষা দেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত দেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি
বলেন, “আমরা কিছুটা ফ্লেক্সিবল থাকব। ভ্যাট ট্যাক্স কখনও বাড়াব না। এটা
পরিবর্তন হতে থাকবে। পরিবর্তন হওয়া মানে কমে যাওয়া। এর উদ্দেশ্য থাকবে
রেভিনিউ বাড়ানো।”