তানভীর দিপু:
সংক্রমণ
হার লাফিয়ে বাড়ছে, বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও। হাসপাতাল গুলোতে এখনি করোনা
আক্রান্তদের উপচে পড়া ভিড়। কুমিল্লা মেডিকেলে করোনা ইউনিটে ধারণক্ষমতার
বেশি রোগীর চিকিৎসা চলছে। খালি নেই আইসিইউ বেড। সদর হাসপাতালের করোনা
ইউনিটেও রোগী ভরপুর, নতুন করোনা আক্রান্তদের ভর্তি নিতে এই হাসপাতালের
মেডিসিন ওয়ার্ডে নতুন রোগী ভর্তি নেয়া বন্ধ করেছেন সিভিল সার্জন। এদিকে
চলমান কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসারের যৌথ
বাহিনী নিয়ে শহরে গ্রামে-গঞ্জে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অসচেতনদের বিরুদ্ধে
অভিযান চালাচ্ছেন জেলা প্রশাসন। গতকাল শনিবারও জেলায় ৩১৩ টি মামলায় জরিমানা
আদায় করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না সাধারণ
মানুষের অসচেতন কার্যক্রম। শুধু বাড়ির বাইরে যাওয়াই নয়- শহরতলী ও গঞ্জের
বাজারগুলোতে দেখা যায় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা। মোবাইল কোর্ট ও
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সাথে চলে লুকোচুরি খেলা। করোনা প্রতিরোধ সংশ্লিষ্টরা মনে
করেন, অসচেতনদের এমন আচরণ নিজেদেরকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
সিভিল
সার্জন মীর মোবারক হোসাইন জানান, হাসপাতালগুলোতে ক্রমেই রোগীর সংখ্যা
বাড়ছে। অতিরিক্ত কারোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার চাপ সামাল দিতে প্রস্তুত আছে
স্বাস্থ্য বিভাগ। লকডাউনের কারনে সংক্রমণ কিছুটা কমে আসবে, তারপরও আমাদের
প্রস্তুত থাকতে হবে।
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা
গেছে, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩৬ শয্যার ডেডিকেটেড করোনা ইউনিটে ভর্তি আছে
১৪৭ জন। এছাড়া ২০টি আইসিইউ ও ১০টি এইচডিইউ এর খালি নেই একটিও। এছাড়া
কুমিল্লা সদর হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ৩০ শয্যার মধ্যে অন্তত ২৩টিতে ভর্তি
আছে করোনা রোগী। অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হাসপাতালটির মেডিসিন ওয়ার্ডকেও করা
হচ্ছে করোনার আইসোলেশন ওয়ার্ড।
কঠোর লকডাউনের তৃতীয় দিনে গতকাল শনিবার
কুমিল্লা নগরীর বাজার এলাকাগুলোতে সারাদিনই ছিলো মানুষের আনাগোনা। নিত্য
প্রয়োজনীয় বাজার সদাই কেনাকাটার জন্য এসব মানুষ এসেছেন বাজারে। রাজগঞ্জ
বাজারে রাস্তার উপর কাঁচাবাজারে একাই দোকানের সামনে দেখা গেছে গা ঘেষাঘেষি
করে ক্রেতারা কেনাকাটা করছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের ভিড় দেখা যায় টমছম ব্রীজ
কাচাবাজার এলাকায়। ইজিবাইব স্ট্যান্ড আর কাচাবাজারের মানুষে জনারণ্য ছিলো
ওই এলাকাটি। অনেককেই দেখা যায় মাস্ক ছাড়াই অবাধে চলাফেরা করছে। মোবাইল
কোর্টের গাড়ির উপস্থিতি টের পেলেই মাস্ক মুখে দিচ্ছেন তারা। বিকাল ৫টার পর
মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের কড়াকাড়িতে বাজার বন্ধ করে
দোকানিরা।
স্বাস্থ্যবিধি না মেনে জনসমাগমের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ন চিত্র
দেখা গেছে নগরীর বাগিচাগাওয়ে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সামনে।
করোনা টীকার রেজিষ্ট্রেশনের জন্য ভোর বেলা থেকেই অফিসটির সামনে ভিড় জমায়
কয়েক শ’ বিদেশগামী। নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব ছাড়াই ঠেলাঠেলি করেই চলে টীকার
রেজিষ্ট্রেশনের কার্যক্রম। অনেকেই মাস্ক ছাড়া এসেছেন টীকা নিবন্ধনের জন্য।
যারা নিবন্ধন ফি দিতে পেরেছেন তারাও গাদাগাদি করে বসেছিলেন অফিস কক্ষের
ভেতরে।
এদিকে নগরীতে প্রবেশের ৮টি পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হলেও
অন্যান্য প্রবেশপথগুলো দিয়ে পাশর্^বর্তী উপজেলা থেকে সহজেই আসা যাওয়া করছেন
সাধারন মানুষ। অথচ মোট সংক্রমণের প্রায় ৭০ শতাংশ কুমিল্লা নগরী থেকে
উপজেলাগুলোতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার আশংকা করেছেন করোনা প্রতিরোধ সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া শহরতলী চানপুর, শুভপুর, কাপ্তানবাজার, আড়াইওড়া, শাসনগাছাসহ
বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন মানা নিয়ে ব্যাপক উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। এসব
এলাকায় দেখা গেছে চা দোকানে আড্ডা, মুদি দোকানে অবাধে কেনাকাটা এবং মানুষের
স্বাভাবিক চলা ফেরা।
জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা.নিসর্গ মেরাজ
চৌধুরী জানান, লকডাউনের ফলে সংক্রমণ কমে আসবে। কিন্তু এখন যেভাবে চলছে তা
ধরে রাখা গেলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে থাকবে। কিন্তু এই সময়ের ফলাফল বোঝা
যাবে আরো অন্তত ৭ দিন পর। যে কারনে এই মুহুর্তে লকডাউন মেনে স্বাস্থ্যবিধি
মানার কোন বিকল্প নেই। অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োজনে লকডাউন
বাস্তবায়নে প্রশাসন আরো কঠোর হতে হবে।
এদিকে সবশেষ তথ্য
অনুসারে,কুুমিল্লায় করোনাভাইরাসের শনাক্তের হার বেড়ে ৩৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
চলতি বছর কুমিল্লায় করোনা শনাক্তের হার এটাই সর্বোচ্চ। গত দুই সপ্তাহ থেকে
দৈনিক করোনা শনাক্তের এই হার ক্রমন্বয়ে বেড়েই চলছে। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাস
শনাক্তের সংখ্যাও বাড়ছে। শনিবার গত ২৪ ঘন্টায় কুমিল্লায় নতুন করে আরও ১৪১
জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
এলাকায় ৬৪জন। এনিয়ে জেলায় এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার ৮০৩ করোনাভাইরাস শনাক্ত
হয়েছে। এদিকে গত ২৪ ঘন্টায় কুমিল্লায় আক্রান্ত হয়ে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন
এলাকায় ৪৫ বছরের এক নারীসহ দুইজন মারা গেছেন। মারা যাওয়া এক পুরুষ (৬৪)
এবং এক নারী (৪৫) এর মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল
কলেজ হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এনিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত ৪৮৬ জনের
মারা গেছেন।
শনিবার কুমিল্লা সিভিল সার্জন অফিস এই তথ্য নিশ্চিত করে
জানান, গত ২৪ ঘন্টায় প্রাপ্ত ৩৭১ জনের নমুনার মধ্যে ১৪১ জনের শরীরে করোনা
শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৬৪
জন। এছাড়া কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা এবং চৌদ্দগ্রামে ১১ জন করে, সদর
দক্ষিণ ও দাউদকান্দিতে একজন করে, বুড়িচং ১০জন, ব্রাহ্মণপাড়া তিনজন,
চান্দিনা ও লাকসাম আটজন করে, দেবিদ্বার ও বরুড়ায় সাত জন, লালমাই চারজন এবং
মনোহরগঞ্জ দুইজন।
এছাড়া গত ২৪ ঘন্টায় কুমিল্লায় করোনা আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৪০জন। এনিয়ে জেলায় সুস্থ হয়েছেন ১১ হাজার ৮৮৫জন।