লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান ||
মরণঘাতী
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে দেশে তৃতীয় পর্যায়ে লকডাউন চলছে। এ অতিমারীর দ্বিতীয়
ঢেউ শেষ না হতেই সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখিতা, দ্রুততা,
হাসপাতালমুখিতা ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়া এবং দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট
শনাক্তের পরিপ্রেেিত সার্বিক সংক্রমণ রোধে জাতীয় কমিটির পরামর্শক্রমে এ
লকডাউন অত্যন্ত সময়োপযোগী। এতে যেমন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে সংক্রমণ ছড়ানো
রোধ হবে, তেমনি ভৌগোলিক বিচারে সারাদেশে সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখিতা ঠেকানো
সম্ভব হবে।
ইতিবৃত্ত : প্রকৃতপে দুনিয়া কাঁপানো সব মহামারী যথা- প্লেগ
অব এথেন্স (৪৩০ খ্রি.), জাস্টিনিয়ান প্লেগ (৫৪১ খ্রি.), ব্ল্যাক ডেথ (১৩৪৬
খ্রি.), কলেরা (১৮১৭), স্প্যানিশ ফু (১৯১৮-১৯২০), এশিয়ান ফু ( ১৯৫৭-১৯৫৮),
গুটিবসন্ত, ইবোলা (২০১৪-২০১৫) ইত্যাদি সব সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে
স্থান-কালভেদে বিভিন্ন মাত্রা ও পদ্ধতিতে লকডাউন প্রথা প্রয়োগ এবং কার্যকর
হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সর্বপ্রথম লকডাউন শুরু হয়
হুবেই প্রদেশের উহান শহরে। ২৩ জানুয়ারি থেকে ৮ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত ২ মাস ২
সপ্তাহ ২ দিনের স্থায়ী এ লকডাউনে উহান ও অন্যান্য ১৫টি শহরের ৭ কোটি লোককে
সর্বাত্মক লকডাউনের আওতায় আনা হয়। কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর
অস্ট্রেলিয়ায় ২৩ মার্চ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত, কানাডায় ৫টি প্রদেশে প্রায় ২
সপ্তাহ থেকে ৪ মাস, ব্রাজিলে একনাগাড়ে আড়াই মাস, ফ্রান্সে জাতীয় ও
প্রাদেশিকভাবে ২৬১ দিন, জার্মানিতে ১৪৮-২১৮ দিন, ইতালিতে জাতীয়ভাবে ১২৯ এবং
প্রাদেশিকভাবে ৮৮ থেকে ২১২ দিন, যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রদেশে ৩ সপ্তাহ
থেকে ৪ মাস এবং ভারতে জাতীয়ভাবে ১০ সপ্তাহ প্রাদেশিকভাবে ১০ সপ্তাহসহ সারা
পৃথিবীর প্রায় ৩৯০ কোটি মানুষ লকডাউনের বিধিনিষেধের আওতায় আসে। এখনো
পৃথিবীর বহু দেশে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী এ কার্যক্রম চলছে।
সংক্রমণ রোধে
লকডাউন : উহান সিটির গবেষক দলের তথ্য অনুযায়ী শহরে লকডাউনের আগে আক্রান্তের
সংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লাগত ২ দিন, লকডাউনের কয়েকদিন পরই দ্বিগুণ হওয়ার
সময় বেড়ে ৪ দিন হয়ে যায় এবং এক সময় এটি ১৯ দিনে পরিণত হয় অর্থাৎ সংক্রমণ
প্রায় ১০ গুণ হ্রাস পায়। অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশে ৬ সপ্তাহের
লকডাউনে আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী
বরিস জনসন বলেন, ভ্যাকসিন নয় বরং লকডাউনই দেশের কোভিড-১৯ সংক্রমণ কমার
প্রধান কারণ। শহরে আক্রান্ত, হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যুসংখ্যা কমেছে
লকডাউনের কারণেই। তিনি স্কাই নিউজ ও জিনহুয়াকে এক সাাৎকারে এ কথা বলেন।
ইতালিতে লকডাউন ছিল সর্বতোভাবেই সফল। গবেষকরা সংক্রমণ মডেল বিশ্লেষণ করে
প্রমাণ করেন লকডাউনের কারণে সংক্রমণ ৮ গুণ এবং মৃত্যুর হার ৩ গুণ হ্রাস
পায়। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী লকডাউন শুরুর কয়েকদিন পর গত ২৪ মে বলেন, ২৪
ঘণ্টার লকডাউনে সংক্রমণের হার কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। ভারতের ইলেকট্রনিক
মিডিয়া ‘নিউজ ১৮’ জানায়, লকডাউনের ফলে মহারাষ্ট্রে আক্রান্তের তীব্রতা
নি¤œমুখী, মুম্বাইতে একদিনে আক্রান্তের হার কমেছে শতকরা ২০ ভাগ। মেডিক্যাল
এক্সপ্রেস জার্নাল প্রকাশ করে, লকডাউনের শুধু সামাজিক দূরত্বের কারণে ১৩
শতাংশ সংক্রমণ হ্রাস পায়। সায়েন্স মাস জার্নালে ২০৬টি গবেষণা বিশ্লেষণের
তথ্য মোতাবেক শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় ৩৭ শতাংশ এবং জরুরি নয় এমন ব্যবসা
প্রতিষ্ঠান বন্ধে প্রায় ২৫ ভাগ কোভিড-১৯ সংক্রমণ হ্রাস পায় বলে প্রকাশ করে।
এলসেভিয়ার প্রকাশিত এক জার্নালে, লকডাউনের সামাজিক দূরত্বের কারণে ১৭ ডলার
অর্থনৈতিক তির বিপরীতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ, হাসপাতালে চিকিৎসা ও মৃত্যুর
কারণে তির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪১ ডলার অর্থাৎ প্রায় আড়াইগুণ বেশি। ১১টি
ইউরোপীয় দেশের গবেষণায় দেখা যায়, লকডাউন কোভিড-১৯ সংক্রমণ নির্দেশক জ সূচক
এক-এর নিচে নামাতে সহায়তা করে (যদি জ < ১ থাকে সংক্রমণের হার নি¤œমুখী
থাকে)। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘ফলপ্রসূ লকডাউনের মাধ্যমে সংক্রমণ
নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলোর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম হয়েছে।’
বাংলাদেশ
প্রেতি : বাংলাদেশে ৮ মার্চ সর্বপ্রথম ইতালি ফেরত ৩ জনের দেহে করোনা ভাইরাস
শনাক্ত নিশ্চিত হয় এবং ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মার্চের শেষে
আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ এবং মৃত্যু ঘটে ৫ জনের। এ পর্যায়ে ২৬ মার্চ
থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড-১৯ বিস্তার প্রতিরোধে সাধারণ লকডাউন ঘোষণা করা
হয়। পরে জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার স্বার্থে
ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু রেখে কোভিড-১৯ বিস্তার
রোধে ৩০ মে ২০২০ পর্যন্ত মোট ৫২ দিন সীমিত আকারে লকডাউন নির্দেশনা চালু
রাখা হয়।
বৈশ্বিক অতিমারীর ঘটনাক্রমে করোনা ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন
ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য ও দণি আফ্রিকা স্ট্রেইন শনাক্ত, ডেল্টা ভাইরাসের
ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের পরিপ্রেেিত কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের আবির্ভাব ঘটলে
৫ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের ঘোষণা প্রদান করা হয়। সর্বশেষ
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর আক্রান্তে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধিতে পহেলা জুলাই
থেকে তৃতীয় পর্যায়ের সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হয়।
সম্প্রতি একটি
তুলনামূলক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্চ ২০২০ থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত রাশিয়ায়
আক্রান্তের হার বাংলাদেশের চেয়ে দেড়গুণ বেশি এবং মৃত্যুর হারও ছিল অনুরূপ।
বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের হার মিলিয়নপ্রতি গড়ে ৪-৬ গুণ
এবং মৃত্যুর হারও একই হারে বেশি প্রতীয়মান হয়। নিউইয়র্ক এবং ইতালিতে
পরিচালিত হাইপোথেটিক্যাল মডেল বিশ্লেষণে লকডাউনের পূর্ববর্তী অবস্থা
বিবেচনায় দেখা যায় যে, লকডাউন নির্দেশনা কার্যকর না হলে ২০ দিন পর
আক্রান্তের হার প্রায় ৮ গুণ ও মৃত্যুর হার ৫ গুণ বৃদ্ধি পেত। বাংলাদেশে
দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাক্কালে ৫ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭,০৭৫। ২০ দিন
পর অর্থাৎ ২৪ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২,৬৯৭; সে অর্থে উপরোক্ত মডেল
বিশ্লেষণের তুলনামূলক বিচারে আক্রান্ত কমেছে ৩৮ শতাংশ। লকডাউনসহ অন্যান্য
প্রতিরোধমূলক নির্দেশনাই যে এ হ্রাসের কারণ তা উপরোক্ত মডেল বিশ্লেষণের
তথ্যই প্রমাণ করে। এছাড়া লকডাউনকালে জনসমাগম বন্ধ করায় ২০-২৫ শতাংশ, শিা
প্রতিষ্ঠান বন্ধে ২৫-৩০ শতাংশ সংক্রমণ হ্রাসে ভূমিকা রাখছে বলে গবেষণায়
প্রকাশ।
জাতিসংঘের মতে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে বৃহৎ পরিসরে সামাজিক
দূরত্ব বজায় রাখা এবং চলাচল নিয়ন্ত্রণে লকডাউন একটি যথোপযুক্ত পদপে। তবে
জীবন-জীবিকা, অনিবার্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা-, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর
চাহিদাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে দেশগুলো নিজ নিজ পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে।
কোয়ারেন্টিন, আক্রান্ত শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা এবং
স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ অনুসরণ ও উদ্বুদ্ধকরণই কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের
মূল হাতিয়ার বলে মতামত পোষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
দেশে ইতোমধ্যে
৫৮ লাখ ৮৯ হাজার ১৫ জন প্রথম ডোজ এবং ৪২ লাখ ৮৯ হাজার ৯১৩ জন পূর্ণ ডোজ
সম্পন্ন করেছে। ক্রমান্বয়ে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে টিকা প্রধান
করা হবে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে চলতি লকডাউনসহ সব নির্দেশনা মেনে চলা এবং
স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ মেনে চলেই প্রাণসংহারী কোভিড-১৯ প্রতিরোধ যুদ্ধে আমরা
বিজয়ী হব, এটাই হোক সবার অঙ্গীকার।
লেখক: সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা, ঢাকা