স্বাস্থ্য খাতের রোগ ও উপসর্গ
Published : Thursday, 8 July, 2021 at 12:00 AM
মো. তানজিল হোসেন ||
বলা
চলে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামোগত ও
স্বাস্থ্যসেবার দুর্বলতা সবার সামনে উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশে বিনিয়োগ উন্নয়ন
কর্তৃপরে (বিডা) তথ্যমতে, ২০১২ সালে চিকিৎসা বাবদ দেশের বাইরে অর্থ
গিয়েছিল ২০৪ কোটি ডলার। ভারত, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে এক লাখ ২৮ হাজার
বাংলাদেশি রোগীর চিকিৎসায় এ অর্থ ব্যয় হয়েছিল। অর্থ ও বিদেশগামী রোগীর
সংখ্যা এখন আরও বেড়েছে। চিকিৎসা ভিসায় বাংলাদেশ থেকে শুধু ভারতেই পাড়ি
দিচ্ছেন বছরে দুই লাখ ৩৫ হাজার রোগী। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া,
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও যাচ্ছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি। সব
মিলিয়ে বছরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একটি
দৈনিকে প্রকাশিত খবরের তথ্যমতে, এ বাবদ প্রতি বছর ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক ৩
হাজার দু'শ কোটি টাকা।
বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি জনগণের আস্থার
সংকট, ভুল চিকিৎসা, ভুল ডায়াগনসিস ও সেবার চেয়ে বাণিজ্যিক মনোভাবের কারণে
দেশের জনগণ ছোটখাটো রোগের চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাড়ি
জমাচ্ছেন। বিদেশ যেতে রোগীদের পরিবারের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা বাবদ
খরচ বেড়ে যায় ও জনগণ হয়রানির শিকার হন। তা ছাড়াও বাংলাদেশের বৈদেশিক
মুদ্রা চিকিৎসা বাবদ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে
বেসরকারি হাসপাতাল আইন তৈরি করে প্রতিটি জেলায় বেসরকারি হাসপাতাল তৈরি করতে
হবে। সরকার এ েেত্র বেসরকারি উদ্যোক্তাদের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করতে
তাদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করবে; কর মওকুফ ও নীতি সহায়তা দেবে। এই
বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি মনিটরিং সংস্থা থাকবে। এরই
মধ্যে চীন ও সৌদি আরব বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে
আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সরকার চীন, সৌদি আরবসহ ভারত, সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য
খাতে বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে এসব দেশকে বাংলাদেশে মানসম্মত
হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় পদপে নিতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি
দেশে প্রতি হাজার লোকের জন্য হাসপাতালে শয্যা থাকা উচিত ৩৫টি। সেখানে
বাংলাদেশে প্রতি হাজার লোকের জন্য শয্যাসংখ্যা ১টিরও কম (শূন্য দশমিক ৯৬)।
বাংলাদেশে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের অনেক দ শ্রমিক কাজ করছে।
বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে ভারতের দ ডাক্তার ও সেবিকারা সেখানে কাজ
করতে পারে। এ ছাড়া দেশের মানুষেরও কর্মসংস্থান হবে। এভাবে মানসম্পন্ন
বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে পারলে বাংলাদেশের লাখ লাখ লোকের কষ্ট,
দুর্দশা লাঘব হবে, খরচ কমবে ও বাংলাদেশের কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার
সাশ্রয় হবে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ থেকে অনেক ছাত্র উচ্চশিার জন্য ভারতে
পাড়ি জমাত। ফলে বাংলাদেশের কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা উচ্চশিা বাবদ
ভারতে চলে যেত। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর
উচ্চশিার জন্য ভারতে যাওয়ার পরিবর্তে দেশেই মানসম্মত বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিা গ্রহণ করছে। ফলে একদিকে বিপুল সংখ্যক শিার্থী
উচ্চশিার সুযোগ গ্রহণ করছে ও আমাদের দেশের কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রার
সাশ্রয় হচ্ছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে নিবন্ধিত
ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি দেশে
প্রতি হাজার মানুষের জন্য ১ জন ডাক্তার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে
প্রতি দুই হাজার ৫০০ মানুষের জন্য ডাক্তার রয়েছেন মাত্র ১ জন। বর্তমানে
বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার ডাক্তার প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায়
এ সংখ্যা অপ্রতুল।
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, লোকবলের
অভাব, অনিয়ম, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, সেবার নি¤œমান, কোনো কোনো
চিকিৎসকের বাণিজ্যিক মনোভাব যেন স্বাভাবিক বিষয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি
রাজশাহী, বগুড়া ও খুলনার অনেক হাসপাতালে শয্যা ও অক্সিজেন সংকট। এ অবস্থা
থেকে মুক্তি পেতে অবশ্যই সরকারকে জেলায় জেলায় বেসরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার
উদ্যোগসহ সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি, অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয়
চিকিৎসা উপকরণ, ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। জনবল সংকট নিরসন করে সংশ্নিষ্ট সবার
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের উপসর্গ দূর করতে
না পারলে ভুক্তভোগীদের বিড়ম্বনা বাড়তেই থাকবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়