ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
করোনায় মৃত্যু কমানোর প্রচেষ্টায় অপ্রতুলতা
Published : Wednesday, 28 July, 2021 at 12:00 AM
করোনায় মৃত্যু কমানোর প্রচেষ্টায় অপ্রতুলতাঅধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ||
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় গত ২৩ জুলাই ২০২১ সকাল ৮.০০টা থেকে ২৪শে জুলাই ২০২১ইং ৮.০০ টা পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্তদের মাঝে ১৯৫জন মৃত্যুবরণ করেন। এই ২৪ ঘন্টায় ২০,৮২৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং এর মধ্যে ৬,৭৮০ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। শনাক্তের হার ছিল ৩২.৫৫ শতাংশ। ২৪জুলাই’২১ পর্যন্ত দেশে মোট ১১,৫৩,৩৪৪ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। মোট শনাক্তের সংখ্যা বিবেচনায় দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১.৬৫ শতাংশ বলে জানানো হয়। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়ে। ২৪ জুলাই’২১ এর পূর্বে ১৫ দিনে নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এ সময়ে প্রায় দিনই মৃত্যু হয়েছে ২০০ বা তার বেশী। কয়েকজন জনস্বাস্থ্যবিদ নিজেদের উদ্যোগে করোনা মৃত্যুর কারণ ও ধরন নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ঐ উদ্যোগের একজন আবু জামিল ফয়সল বলেছেন, ‘সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক উদ্যোগ করোনায় মৃত্যু কমানোতে প্রভাব ফেলে। টিকা গ্রহীতারা আক্রান্ত হলেও তাঁদের মধ্যে মৃত্যু খুবই কম। আবার জরুরী অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে আসা সব রোগীকে বিলম্ব না করে অক্সিজেন দিতে থাকলেও সঙ্গে চিকিৎসা চালাতে থাকলে মৃত্যু কমে।’
আইইডিসিআর’এর পরিচালক বলেছেন, ‘গেল কয়েকদিনে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের করোনায় মৃত্যু বাড়ছে। সঙ্গে নারীদের মৃত্যু ঝুঁকি কম, তাও আর পূর্বের মত বলা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন সংক্রমণের সাথে মৃত্যুর আনুপাতিক সম্পর্ক আছে। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বে। এখন সংক্রমণ বৃদ্ধির আসল কারণ ডেলটা প্রকৃতির ভাইরাসের বিস্তৃতি যা ভারত থেকে উৎপত্তি হয়েছে। এর সংক্রমণ ক্ষমতাও বেশি এবং আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের তীব্রতাও বেশি দেখা যায়। তবে কমবয়সী বা নারীদের বেশি মৃত্যুর পেছনে ডেল্টাই একমাত্র দায়ী কিনা গবেষণায় এখনও তা জানা যায়নি। অধ্যাপক রুবিনা ইয়াসমীনের নেতৃত্বে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ফেব্রুয়ারি মার্চ ও এপ্রিল এ তিন মাসে মারা যাওয়া ২০০ করোনা রোগীর তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় মৃত ব্যক্তিদের গড় বয়স ছিল ৬২ বৎসর। তাঁদের ১২০ জন ছিলেন পুরুষ এবং ৮০ জন ছিলেন মহিলা। মৃত ব্যক্তিদের ৬৪ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ ও ৫৬ শতাংশের ডায়বেটিস ছিল। মৃত্যুর সময়ের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায় তাদের ৫১জন অর্থাৎ ২৫.৫ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে। মৃত্যুর কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো হচ্ছে-
১.    আক্রান্তদের অনেকেই শারিরীক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন।
২.    হাসপাতালে পৌছানোর সময় অক্সিজেনের মাত্রা এত কম থাকে যে তখন চিকিৎসকদের আর কিছু করার থাকে না।
৩.    শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার আগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে না।
৪.    বাসায় পালস অক্সিমিটার থাকছে না বলে অক্সিজেন সেচুরেশন জেনে আক্রমণের তীব্রতা অনুভব করতে পারছে না।
৫.    অনেক ক্ষেত্রে জরুরী চিকিৎসা দেয়ার জন্য হাসপাতালগুলো প্রস্তুত থাকছে না।
৬.    কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনবল স্বল্পতা ও দক্ষ জনবলের অভাব এবং আইসিইউ’রও অভাব।
৭.    ঝুঁকিপূর্ণ বা টিকা নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না।
৮.    কিছু কিছু ক্ষেত্রে অক্সিজেন সরবরাহ সংকট।
আশার খবর হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী চিকিৎসকদের পাঠানো ২৫০টি আইসিইউ ভেন্টিলেটর ঢাকায় পৌছেছে। ২৪/০৭/২১ইং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এই পোর্টেবল ভেন্টিলেটরগুলো পৌছেছে। এদিকে একটি দু:খের খবরও আছে- ঢাকা মহানগর জেনালের হাসপাতালের ২০২০ এর অক্টোবরে ৫টি আইসিইউ স্থাপন করা হয় এবং ২০২১ এর এপ্রিলে ১৫টি এইচডিইউ বসেছে, জনবলের অভাবে এখনও তা চালু হয় নাই। কুমিল্লা জেলার তিনটি গ্রামীন হাসপাতালে ছয়টি আইসিইউ লোকবলের অভাবে প্রায় তিনমাস যাবত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রী বলেন, এখন সারাদেশে সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে কোভিড রোগীর জন্য শয্যা আছে ১৫ হাজার এরমধ্যে ঢাকায় ৫,৭০০। আইসিইউ ৮০০ থেকে ১২০০ এর মধ্যে উঠানামা করে। এখন সংক্রমণ বেড়েছে ৬-৭ গুন, মৃত্যু বেড়েছে ১০ গুন, হাসপাতালে শয্যার চাহিদা বেড়েছে ১০ গুন, অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে ৪-৫ গুন। স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা মোকাবেলায় সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও কিছু মানুষ শুধু সমালোচনা করছেন। বিবিএমসিএ’র সভাপতি এম.এ. মুবিন খান জানান বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কোভিডের জন্য আরও দুই হাজার শয্যা প্রস্তুত করতে চায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সরকারের হাতে ১ কোটির ওপরে টিকা আছে। আগামী মাসের মধ্যেই আরও ২ কোটি টিকা সরকারের হাতে চলে আসবে। এভাবে চীন থেকে ৩ কোটি, রাশিয়া থেকে ৭ কোটি, জনসন এন্ড জনসনের ৭ কোটি, অ্যস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটিসহ আগামী বছরের শুরুতেই সরকারের হাতে প্রায় ২১ কোটি টিকা চলে আসবে। প্রতিশ্রুতির টিকাগুলি দেয়া গেলে ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনা থেকে সুরক্ষা দেয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিপিএমসি’এর সাধারণ সম্পাদক সাংসদ আনোয়ার হোসেন খান বলেন বিপুল সংখ্যক লোককে টিকার আওতায় আনতে হলে টিকা দেয়ার সময় বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বাড়াতে হবে।
টেক্সাস বেলর কলেজ অব মেডিসিনে কর্মরত ডা. শরীফ মহিউদ্দিন জানিয়েছেন গর্ভবতী নারীদের ভেক্সিন নেয়া কেন জরুরী। গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুরহার এখন বেশি। ৩৫,০০০ নারীর উপর একটি সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় ফাইজারের ভেক্সিন নেয়ার পর তাদের কোন বিরুপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় নাই। মডার্না, এস্ট্রাজেনেকা বা ফাইজারের ভেক্সিনও যে গর্ভবতীরা নিচ্ছেন কোন ক্ষতিকারক দিক পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশে এ সকল ভেক্সিন পাওয়া যাচ্ছে। গর্ভবতী মায়েরা ভেক্সিন নিলে আক্রান্ত না হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। গর্ভবতীদের ভেক্সিন নেয়ার পরামর্শ দিতে তিনি বাংলাদেশের সকল চিকিৎসকদের অনুরোধ জানান। যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভবতীদের ভেক্সিন দেয়া হচ্ছে এবং মটিভেশনেল কাজও চলছে। ভেক্সিন গর্ভবতীর অনাগত শিশুরও স্বাস্থ্য ভাল থাকবে বলে তিনি জানান।
লুইজিয়ানা, নিউঅরলিয়েন্স থেকে একজন ইন্টারনেল মেডিসিনের চিকিৎসক কোভিড ডেলটা সম্পর্কে বলেছেন- কোন কাশি নাই, কোন জ্বর নাই। হঠাৎ গলায় ব্যথা বা অনেকগুলো জয়েন্টে ব্যাথা, মাথা ব্যথা, ঘাড়ে বা কোমড় ব্যথা, সাধারণ দূর্বলতা এবং নিউমোনিয়া-এটাই কোভিট ডেলটা। তীব্র সংক্রামক, মৃত্যুহার অত্যধিক এবং তীব্রতর পর্যায়ে পৌছতে খুব কম সময় নেয়। অনেক সময় কোন লক্ষণই পরিলক্ষিত হয় না। মানুষকে আরও বেশি সতর্ক থাকা উচিত। এ ভেরাইটি নেজোফেরিঞ্জিয়ান এলাকায় বসবাস করে না। এখন যে সরাসরি ফুসফুসে চলে যায় এবং উইনডো পিরিয়ড অত্যন্ত স্বল্প। বেশি কিছু রোগী পাওয়া গিয়েছে জ্বর এবং ব্যথা ছাড়া শুধুমাত্র সামান্য (সরষফ) চেষ্ট নিউমোনিয়া মাত্র, যা এক্সরেতে ধরা পড়ে। নেসাল সোয়াব প্রায় সময়ই নিগেটিভ এবং অনেক ভধষংব নেগেটিভ কেইসও পাওয়া যাচ্ছে। এসব মিলিয়ে দেখা যায় সংক্রমণটি তীব্র এবং জীবন ধ্বংসকারী। তাই এই ঢেউটি প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক মারাত্মক। সবাইকে আরও সাবধান ও যত্মবান হতে হবে। দয়া করে ভেক্সিন নেন আর না নেন সাবধান হোন, জনবহুল স্থান পরিত্যাগ করুন, ১.৫ মিটার দুরত্ব বজায় রাখুন, ডাবল মাস্ক ব্যবহার করুন, ফেইস মাস্ক এবং হাত ধৌত করা বা সেনিটাইজার ব্যবহার অবশ্যই করবেন।
আর একটু পর ভর্তি হব এটা যেন না হয়। একটু লক্ষণ দেখলেই হাসপাতালে ভর্তি হোন। হাসপাতালে কোভিট বেড সংখ্যা বৃদ্ধি করুন। আইসিইউ, এইচডিইউ ও দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করুন। যেখানে দক্ষ জনবল আছে সেখানে নবাগত / পড়ে থাকা আইসিইউ / ভেন্টিলেটরগুলো স্থাপন করুন নতুবা শবযাত্রায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চাঁকা থামিয়ে দেবে মৃত্যুর মিছিল।  

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল