সজল চৌধুরী ।।
গত
১০ জুলাই একটি জাতীয় দৈনিকে 'পোলা লইয়া পুলিশের দৌড়ানি খাইয়াও দোকান খুলি'
শিরোনামে একটি খবরে চোখ আটকে গেল। মা সুমি তার কোলের ছয় মাসের শিশু
তাকবীরকে রাস্তার পাশে একটি উঁচু টুল জাতীয় জায়গায় ঘুম পাড়িয়ে পাশেই
রাস্তায় বসে পান বিক্রি করছেন। ছবিটি তোলা হয়েছিল ঢাকার তেজগাঁওয়ের
তেজকুনিপাড়া থেকে। চারদিকে যখন করোনার দাপট; লাশ ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে
আত্মীয়স্বজন; বাসায় বসে অফিসের কাজ করতে হচ্ছে, ঠিক তখনই সুমিদের রাস্তায়
নামতে হয় জীবনের তাগিদে। প্রয়োজনের ধরন কিংবা কারণ হয়তো অনেক ধাঁচের হয়।
কিন্তু ছবির সেই ছোট্ট শিশুটিকে যখন পরম নিশ্চিন্তে রাস্তার ওপর খোলা
আকাশের নিচে সাদা চাদরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখি, তখন অজান্তেই চোখের কোনায় জল
আসে। নিজের ভেতরে একটি আর্তনাদ অনুভব করি। সব মা-বাবাই চান শিশুসন্তানকে
পরম আদরে বড় করতে। তবে সুমিরা তার থেকে যোজন যোজন দূরে থাকে, যাদের কাছে
ইচ্ছা পূরণের চেয়ে জীবন ধারণই প্রধান। সুমিদের কাঁধে থাকে সংসারের ভার। মাস
গেলে অতিকষ্টে মেটাতে হয় ঘর ভাড়ার টাকা। নইলে ঘরছাড়া হয়ে রাস্তায় বের হয়ে
মুখোমুখি হতে হয় যান্ত্রিক অযাচিত ঝামেলার। এভাবেই দিনের পর দিন বাড়তে থাকে
ধুলাবালি মাখা ভালোবাসাহীন রাস্তার গল্প, যেখানে সুমিদের জীবন ঘিরে থাকে
শুধু অনিশ্চয়তা।
সংবাদটি প্রকাশের পরদিন দৈনিকটিতে প্রকাশিত হয় 'ছেলে
নিয়ে সুমিকে আর দৌড়াতে হবে না' শিরোনামে আরেকটি খবর। ঢাকা উত্তর সিটি
করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রয়োজনীয় চাল-ডাল, বাচ্চার খাবারসহ
আনুষঙ্গিক দ্রব্যসহ প্রায় দুই মাসের উপহারসামগ্রী পাঠিয়েছেন সুমির কাছে। এই
ভয়াবহ সময়ে এ উপহার যে একজন অসহায় মায়ের জন্য কত বড় পাওয়া, সেটি হয়তো লিখে
বোঝাতে হবে না। এমনকি স্থায়ী কাজের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত মা ও ছেলের
ঘর ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন মেয়র। এমন
সাহায্য-সহযোগিতা এই সময়ে অনেকেই করছেন মানবতার হাত সম্প্রসারণ করে। তবে
ছবির ছোট্ট শিশুটিকে মায়ের কোলে বসে তাকিয়ে থাকার মধ্যে যে ভাবলেশহীন
ভালোবাসা আর আস্থার বহিঃপ্রকাশ দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে, ছয় মাসের তাকবীর
সবাইকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে চাচ্ছে একটি নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা, তার
মতো সব তাকবীরের জন্য।
ছোট্ট একটি ঘরে থাকে সুমি ও তাকবীর। দেয়ালে ময়লা।
মাথার ওপরে ভাঙাচোরা ছোট্ট একটি ফ্যান। এই গরমের মধ্যেও ঠিকমতো চলে কিনা,
কে জানে! তার পাশে সামান্য যা আছে, সেগুলোই ব্যাগের মধ্যে ঝুলিয়ে রাখা। এই
ছোট্ট ঘরেই তাদের সব স্বপ্ট¤œ। তবুও তারা খুশি! তারা বসে নেই। জীবন
সংগ্রামের যান্ত্রিকতায় এসব ভাবার সময় কোথায়! রাতে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমানোর
জায়গা হলেই তো চলে! এমন সুমি আর তাকবীরের সংখ্যা গুনে হয়তো শেষ করা যাবে
না। আমরা কি পারি না তাদের জন্য ছোট্ট হলেও পরিপূর্ণ একটি আবাসস্থলের
ব্যবস্থা করে দিতে? যেখানে তাকবীররা পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। ঘুম থেকে উঠে
জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করা ভোরের আলোয় পৃথিবীকে দেখবে।
এবার আসা
যাক আরেকটি গল্পে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বপ্ট¤œ দেখেছিলেন- দেশের কোনো
মানুষ আশ্রয়হীন থাকবে না। স্বপ্ট¤œ দেখেছিলেন এমন একটি বাংলাদেশের, যেখানে
গ্রামীণ অর্থনীতি হবে সুদৃঢ়। স্বপ্ট¤œ দেখেছিলেন, প্রতিটি মানুষ হবে
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল প্রখর, স্বতন্ত্র ও
বৈশিষ্ট্যম-িত। ১৯৭১-এ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞে
তিগ্রস্ত প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষকে পুনর্বাসনের চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল জাতির
পিতাকে। তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন- তার দেশের প্রতিটি মানুষ খাবার পাবে,
আশ্রয় পাবে, শিা পাবে; উন্নত জীবনের অধিকারী হবে। তার ভাষায়- 'এই হচ্ছে
আমার স্বপ্ট¤œ'। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার সে
স্বপ্ট¤œকে বুকে ধারণ করেই পথ চলছেন বাংলার মানুষের জন্য সম্পূর্ণ
স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যম-িত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তিনি সেখানে যুক্ত করলেন নতুন
একটি মাত্রা।
মুজিববর্ষ উপলে দেশের সব ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষকে
পুনর্বাসনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে আর
কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না- এই প্রত্যয়ে গত বছরের মে মাসে ভূমিহীন ও
গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। ইতোমধ্যে লাধিক
হতদরিদ্র পরিবারের হাতে তাদের জমি এবং বাড়ি হস্তান্তর করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের
বিষয়, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এই লাধিক নির্মিত বাড়ির মধ্যে বেশকিছু বাড়ির
নির্মাণকাজে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা ইতোমধ্যে
দেখেছি, অনেক বাড়ির দেয়াল ভেঙে পড়েছে; বাড়ির নিচের মাটি সরে গেছে;
কনস্ট্রাকশনে ফাটল ধরেছে; বসবাসের অনুপযুক্ত হয়েছে। এ ধরনের গৃহনির্মাণে
ত্রুটির কারণে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আমরা জানি,
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন না। দেশকে সোনার
বাংলা গঠনকল্পে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করার উদ্দেশ্যে, দেশকে
অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নয়নের ল্েয তিনি সর্বদা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি
লাখো সুমিকে নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাহলে
এই দায় কার? জাতি হিসেবে আমরা কি লজ্জিত হচ্ছি না? যে অবহেলার কারণে
স্বপ্নের গৃহায়ন প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তা যদি সঠিক সময়ে সঠিক পন্থায়
পর্যবেণ এবং চিহ্নিত করা না হয়, তাহলে সব প্রাপ্তি ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে। আর
রাস্তায় পড়ে থাকা সুমিদের স্বপ্ট¤œ সব সময় স্বপ্ট¤œই থেকে যাবে। একজন
নাগরিক হিসেবে আশা করব, কোনো ধরনের অশুভ তৎপরতা যেন এই মহৎ উদ্যোগকে ব্যাহত
না করে। গৃহহীন মানুষ যেন পরম নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারে তাদের গৃহে।
লেখক:শিক্ষক ও স্থাপত্য-পরিবেশবিষয়ক পিএইচডি গবেষক