ডা. মো. মাসুদ আলম ||
ডেঙ্গু একটি প্রাচীন রোগ। এই রোগের প্রথম উল্লেখ পাওয়া গেছে চীনের চিকিৎসাসংক্রান্ত নথিপত্রে। ডেঙ্গু হলো একটি তীব্র ফিব্রাইল ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার কামড় দ্বারা চারটি ডেঙ্গু ভাইরাল সেরোটাইপ বহন করে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রথম অফিশিয়াল প্রাদুর্ভাব ছিল ২০০০ সালে। ২০১৯ সালে বিগত বছরগুলোর চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়ে।
মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম ও বর্ষার সময়টায়ই ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে এই জ্বর হয় না বললেই চলে। শীতে লার্ভা অবস্থায় ডেঙ্গু মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতেই সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা বিস্তার লাভ করে। সাধারণত শহর অঞ্চলে অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালানকোঠায় এই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গুও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয় বা একেবারেই হয় না বললেই চলে।
ডেঙ্গু ভাইরাস চার ধরনের হয়ে থাকে। তাই ডেঙ্গুও চারবার হতে পারে। যারা আগেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের েেত্র পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু হলে তা মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে শিশুদের েেত্র এটি বেশি দেখা যায়।
কাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বর ঈষধংংরপধষ উবহমঁব ঋবাবৎ সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে শরীরে প্রচ- ব্যথা হয়। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। শরীরে, বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’ (যেটা আগেই বলেছিলাম)। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচ দিনের সময় শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন যার্শ, অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত কান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগী সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায়। তবে রোগীকে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই চলতে হবে। যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতা না হয়।
হালকা জ্বর হলে অনেকেই বিষয়টিকে পাত্তা দেন না। তবে হালকা জ্বর হলে বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
যেসব স্থানে মশা জন্ম নেয়, যেমন বাড়ির ছাদ, ফুলের টব, নালা, পানির ট্যাপের আশপাশের এলাকা, পানির পাম্প, ফ্রিজ বা এসির পানি জমার স্থান, পানির বদনা, বালতি, হাইকমোড, আইসক্রিম বক্স, প্লাস্টিক বক্স, ডাবের খোসা, টায়ার ইত্যাদি। সেসব জায়গা চিহ্নিত করে তিন দিন পর পর পরিষ্কার করতে হবে এবং বাসার ছাদ প্রভৃতি স্থানে জমে থাকা পানিতে এদের বংশবিস্তার ঘটে বলে সেখানে মশা নিধক ওষুধ ছিটিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া বাড়ির আশপাশের নর্দমা ও আবদ্ধ জলাশয়ে ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারতে হবে, ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে।
মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিত। কেননা এডিস মশা সকাল-সন্ধ্যা কামড়ায়। অর্থাৎ ভোরে সূর্যোদয়ের আধাঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধাঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়াতে পছন্দ করে। তাই দিনে ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করুন এবং ডেঙ্গুর কবল থেকে নিজেকে রা করুন। করোনাকালে ডেঙ্গু সম্পর্কে আরো বেশি জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। এ েেত্র আমাদের মূল ল্য হওয়া উচিত, এডিস মশাকে কোনোভাবেই আবাস গাড়তে না দেওয়া। ডেঙ্গুর উপসর্গগুলো দেখা দিলে অবহেলা না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখা থেকে আরো জানানো হয়, সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীার অ্যান্টিজেন কিটের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এ পরীাটি বিনা মূল্যে করার সুযোগ রয়েছে। তাই ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে বিলম্ব না করে সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল ও কিনিকে ডেঙ্গু পরীা তাড়াতাড়ি করে ফেলা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে অনেকেই ভাবছেন জ্বর মানেই কভিড-১৯। আর তাই তাঁরা ডেঙ্গু পরীা না করে বাসায় অপো করছেন। কেউ কেউ কভিড-১৯ নমুনা পরীা করালেও ডেঙ্গু পরীা করাচ্ছেন না। আবার অনেকে কভিড-১৯ ভেবে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ খাচ্ছেন। এতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। দেরিতে পরীার ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পরপরই প্লাটিলেটের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে অনেক কম।
এ পরিস্থিতিতে জ্বর হলেই যেন কভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গুও পরীা করিয়ে নেন—সবার প্রতি এই আহ্বান থাকল। এ ছাড়া সরকারের গৃহীত পদপেগুলো সফল করার পাশাপাশি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব নিজ নিজ বাড়ির চারপাশগুলো যেন এডিস মশার অভয়ারণ্য না হয়ে থাকে. সেদিকে ল করা।
লেখক : চিকিৎসক, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল সদস্য এবং সম্প্রীতি বাংলাদেশ