ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
করোনায় সমাজ ও অর্থনীতি
Published : Monday, 9 August, 2021 at 12:00 AM
করোনায় সমাজ ও অর্থনীতিড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ||
মহামারীদের আচার-আচরণ এমনিই নাকি হয়। সহজে তাকে তাড়ানোও যায় না আবার তিনি যেতেও চান না। ১৭২০-এ প্লেগ, ১৮২০-এ কলেরা, ১৯২০-এ স্পানিশ ফু এদের সবার পাঁজিপুথি ঘেঁটে যা দেখা যাচ্ছে, ন্যূনতম দুই থেকে তিন বছরের আগে নিষ্কৃতি মেলেনি কারও, অব্যর্থ প্রতিষেধক আবিষ্কার ও তার প্রয়োগ সাফল্য পেতে পেতে সময় ও জীবন হয়েছে উজাড়, তবে ১৭২০ ও ১৮২০-এ তারা যখন যে এলাকায় ঢুকেছিলেন সেখানেই প্রায় সবাইকে শেষ করে ছেড়েছিলেন অর্থাৎ ব্যাপ্তি ছিল তাদের জনপদ সভ্যতার মধ্যে সীমিত সীমাবদ্ধ অথচ ভয়াবহ। ১৯২০-এ মানুষের চলাচল পরিভ্রমণ বাড়ায় স্পানিশ ফুর ব্যাপ্তি কিছুটা প্রসার লাভ করেছিল, চিকিৎসাব্যবস্থায় বেশকিছু উন্নতি দখলে থাকায় য়তি দীর্ঘমেয়াদি হলেও নতুন মেজাজ পেয়েছিল পরিস্থিতি। আর এবার করোনার বিশ^বিহারের সুযোগ যেমন বেড়েছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও তৈরিতে এখনো পর্যন্ত সাফল্য সুনিশ্চিত না হলেও চেষ্টা-তদবিরে ও আঞ্জাম-আয়োজনে আগের তুলনায় ‘বুদ্ধিমান মানুষের’ হাতজস বেড়েছে। তবে সেটা যতটা না প্রাকরণিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক ভেদবুদ্ধির কারণে। বিশেষ করে যেসব দেশে করোনার সংক্রমণ ও ঘাতকসূচককে ইলাসটিসিটি অব ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের মতো বড়-ছোট করা কোনো ব্যাপারই মনে হয় না। সেখানে করোনার গতিবিধিকে গজেন্দ্রগামী সাব্যস্ত করা চলে।
গত বছর মার্চে বাংলাদেশ করোনার খপ্পরে পড়ে। ইতোমধ্যে ফার্স্ট রাউন্ড শেষ হয়ে বলা হচ্ছিল দ্বিতীয় ধাক্কায় পড়েছি, পড়তে যাচ্ছি, এই শীতকালে বাড়বে সবাই সাবধান হন ইত্যাদি। বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক এমন একটা ভাব তৈরি হলো যেন কিছুই হয়নি, হবেও না। গ্রামের মানুষ, শহরের খেটে খাওয়া মানুষ সবাই যেন ভুলতেই বসেছিল করোনাকে। তাদের দেখিয়ে যাদের কাছে মওকা পয়সা আছে বা জমছে তারা এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে অদরকারি, বেদরকারি, অপব্যয়ে মেতে উঠেছিল। কিন্তু এখন যা শোনা যাচ্ছে না শুধু দেখাও যাচ্ছে করোনা সম্পর্কে তা আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার পর্যায়ে নেই। দোষটা বরাবরের মতো করোনার ওপরই চাপানো চলছে। বেচারা করোনার কী দোষ, তার কথা “আমি যেমন ছিলাম তেমনই আছি, আপনারা আমাকে লুকানো ছাপানোর কাজে ‘বাহাদুরি’ নিয়েছেন, আমি মাঝে মধ্যে ভোল তো পাল্টাতেই পারি, এটা আমার মৌলিক কৌশল।”
করোনার মতিগতি, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি এমনকি রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে করোনার সম্মোহনী শক্তির কাছে সময়, সমাজ ও অর্থনীতি আটকা পড়ছে তো পড়ছেই। বিশ^ব্যাপী এটা এখন উপলব্ধির উপলব্ধিতে পরিণত হয়েছে যে, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চাল চালার জন্য করোনার উদ্ভব ও বিকাশ। এর সঙ্গে ভূরাজনীতি, বিশ^ বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় মোড়লিপনার হাতবদল, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের সূক্ষ্ম সুতা টানাটানির ব্যাপার জড়িত। সুতরাং করোনা সহজে নির্মূল হওয়ার নয়। অতীতের অন্যান্য মহামারীর চেয়ে করোনার প্রকাশ্য পার্থক্য হলো এটি যতটা না প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট তার চেয়ে বেশি এটি ভেদবুদ্ধিপ্রসূত, এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক অর্থনীতির রেজিলিয়েন্ট পাওয়ারসহ মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক শক্তি-সামর্থ্য ধ্বংস করা। অতীতের তুলনায় বর্তমানে মানুষের মবিলিটি মাইগ্রেশন সুযোগ বেশি হওয়ায় মানুষেরই ভেতরে ভাইরাসবাহী করোনা দ্রুত ছড়িয়েছে বিশ^ব্যাপী। সুতরাং করোনাকে সহসা সহজ ভাবার সুযোগ নেই।
এ অবস্থায় রণে ভঙ্গ দিতে করোনার সঙ্গে সহাবস্থানকল্পে ‘জীবনযাপনের নীতি’ নির্দেশনাগুলো অবশ্য পালনীয় ও অনুসরণীয় এবং আটপৌরে জীবন ও অভ্যাস- সংস্কৃতির সঙ্গে স্থিতিশীল হয়ে ওঠা আবশ্যক। সাতঘাটের পানি খেয়ে শেষ অবধি তিনটি বিষয় বা ‘অভ্যাস’কে মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে বিবেচনায় নিতেই হচ্ছে- ১. সামাজিক নয়, দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা, ২. মাস্ক ব্যবহার করা এবং ৩. ঘনঘন হাত ধোয়া। করোনা বিদায় হতে মনে হচ্ছে আরও সময় লাগবে তাই তার সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করা সমীচীন। প্রত্যেকের উচিত নিজের ও সবার স্বার্থে এ নীতি অনুসরণ করা।
লকডাউন, শাটডাউন শব্দগুলো একেক দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে লাগসই হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাঁটব, চলব বাংলাদেশের রাস্তায় আর মাথায় ব্রিটিশ ট্রাফিক আইন ফলাফল যা হওয়ার তাই হবে। করোনার সংক্রমণকে না থামাতে পারলে করোনা থেকে মোম মুক্তি মিলবে না। সংক্রমণের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য চাই সঠিক শনাক্তকরণ পরীা সংপ্তি সময়ে সহজী ও গণমুখীকরণ। সংক্রমণযোগ্যদের সুস্থদের থেকে দ্রুততম সময়ে পৃথক করতে পারলে সংক্রমণ ঠেকানোর নামে সবাইকে লকডাউনের আওতায় আনার প্রয়োজন পড়বে না। ধরা যাক ২০ শতাংশ ক্যারিয়ার, তাদের আলাদা করতে পারলে তাদের পর্যাপ্ত প্রতিষেধনের ব্যবস্থাপনায় আনা সহজতর হবে আর বাকি ৮০ শতাংশকে জীবিকায় ব্যাপৃত রাখা সম্ভব হবে, অর্থনীতি সচল থাকবে। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের আয়-উপার্জনের পথ বন্ধ করে লকডাউন তথা স্বাস্থ্যবিধি পালনে তাদের দায়িত্বশীল পাওয়া যাবে না।
করোনায় উত্তরণের সম্মাহিত এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে টেকসই উত্তরণের পথ পেতে উপযুক্ত পথ-পন্থা অবলম্বনে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রোপট পরিবেশে আর যা যা করণীয়- দেশে-বিদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ও য়তির বেহাল চিত্র দেখে আস্থাহীনতায় বাংলাদেশে আতঙ্ক, আশঙ্কা বেড়েই চলেছে যা মানসিক অশান্তির উপসর্গ। অথচ মানসিক শান্তি বা মনের বল করোনার মতো ভয়াবহ মহামারী মোকাবিলার প্রাণশক্তি। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে, কঠিন বাস্তবতায় করোনা মোকাবিলায় গৃহীত ব্যবস্থার স্বচ্ছতায় ও আন্তরিকতায় সবাইকে শামিল করতে পারলে গৃহীত সব পদেেপ বিচ্যুতির পরিবর্তে সবাইকে অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে আস্থা গড়ে উঠবে। দেখতে হবে পারস্পরিক দোষারোপ কিংবা আত্মপ্রসাদ লাভের ঘেরাটোপের মধ্যে ভেদবুদ্ধির সন্ধানে আস্থার পরিবেশ যেন বিপন্ন না হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই দেশ-কাল-পাত্রভেদে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করতে সবার ভালোর জন্য জোরেশোরেই শুরু হলেও ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরির কর্মসূচি কার্যকর হয়নি। মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহামারী নিয়ন্ত্রণে, মানুষকে কর্মসূচির মতো উদ্ধারে সামাজিক সংহতির ভূমিকাই অগ্রগণ্য। এখানে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ও সামাজিক বন্ধনরীতি যেখানে সুদৃঢ় সেখানে করোনা মোকাবিলায় আক্রান্তের সেবা-শুশ্রƒষায় চিকিৎসাকর্মীর সমানুভূতি, পারিবারিক নৈকট্য, সামাজিক সহানুভূতি বিশেষ টনিক হিসেবে কাজ করবে। ব্যক্তি ও পারিবারিক উদ্যোগে স্বেছাসেবী মনোভাবের দ্বারা উদ¦ুদ্ধ প্রত্যেকে আমরা পরের তরে কর্মসূচি গ্রহণের এটিই শ্রেষ্ঠ সময়। ঢাকা শহরের লালমাটিয়ায় ‘মেহমানখানা’ নিরন্ন মানুষের মুখে খাদ্য সরবরাহ টাইপের কর্মসূচি কি বিত্তবান, ব্যবসায়ী, করপোরট গ্রুপ গ্রহণ করতে পারে না? ফিল্ড হাসপাতাল, গণরেশনিং কিংবা লঙ্গরখানা জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ কারও কাছে মানসম্মানের ব্যাপার মনে হওয়া বিচিত্র নয়, তবে জাতীয় কবির সেই আহ্বান প-বিপ নয়, ‘কা-ারি বল ডুবিছে সন্তান মোর মার।’ অন্তর্ভুর্ক্তির নামে ও পরিচয়ে বিচ্যুতির বলয় থেকে চিন্তা ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় সাধনের বিকল্প দেখিয়েছেন। আর সব সাহায্য নিরাময় নিয়ন্তা যিনি, যার যার বিশ^াসমতে সেই পরম করুণাময়ের কাছে একান্ত আত্মসমর্পণ ও তার কৃপা প্রার্থনাই হবে এই মুহূর্তের অন্যতম দাওয়াই।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকল্পে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদপে হিসেবে অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা রাখতে কার্যকর পদপে নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও জীবিকা পরস্পরের হাত ধরে চলে। তাই করোনা মহামারী থেকে জনগণকে রায় স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ছোট-বড় ম্যানুফ্যাকচারিং, আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা বিপণন, কৃষি (খাদ্য, সবজি, মাছ, মাংস) উৎপাদন, পরিবহন, পর্যটন, সেবা ও আর্থিক খাতে পর্যায়ক্রমে ুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ উদ্যোক্তাদের করোনায় য়তি কাটিয়ে ওঠার জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যথাযথভাবে ডিজবার্স নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর মনুষ্য সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাহাড় যেন জগদ্দল পাথরের মতো গেড়ে না বসে সেদিকে সবার যেন থাকে সজাগ দৃষ্টি। বাংলাদেশের জনগণের সহনীয় (রেজিলিয়েন্ট) শক্তি অটুট থাকা বা রাখার জন্য যা হবে জরুরি।
লেখক: সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান