ডা. পলাশ বসু ||
টিকা
নিয়ে একটা ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা আমরা শুরু থেকেই দেখে আসছি। শিতি, সচেতন
মানুষকেও বলতে শুনেছি করোনা টিকার বিপে কথা বলতে। অনেকে এমন গুজবেও বিশ্বাস
করেছেন- এ টিকা নিলে নাকি মানুষের লিঙ্গ পরিবর্তন হয়ে যাবে! ছেলেদের কণ্ঠ
মেয়েদের কণ্ঠের মতো হয়ে যাবে। মেয়েদের মুখে দাঁড়ি-গোঁফ গজাবে! টিকা নিলে
মানুষের ভেতরের কোষ ও জিনে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যাবে। সেই সাথে টিকা নেয়ার
পর থেকে কোনো এক বিশেষ গোয়েন্দাবাহিনী আপনার সব খবর পেয়ে যাবে! ফলে
গোপনীয়তা বলে নাকি আর কিছুই থাকবে না!
টিকা নিয়ে গুজব সবসময়ই ছিলো। কিছু
মানুষ জেনে বুঝেও এর বিরোধিতা করে থাকে। আর কিছু মানুষ তা হুজুগে পড়ে
বিশ্বাস করে। তবে, হুজুগে পড়া মানুষের সংখ্যা বেশি হয়ে গেলে তখন সমস্যা হয়ে
যায়। টিকা দেয়ার কাজটি তখন তার অভিষ্ট ল্েয পৌঁছতে পারে না।
একসময়
গ্রামে টিকা কর্মী এলে পরিবারের লোকজনই টিকা না দিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে
লুকিয়ে রাখতেন। আবার জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষকে উদ্বুব্ধ করার জন্য
স্বাস্থ্যকর্মীরা যখন বাড়িতে বাড়িতে যাওয়া শুরু করলেন তখন অনেক গ্রামে
তাদেরকে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। মারধোর করার ঘটনাও ঘটেছে। শিশুদের টিকা ও
জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য এখন আর স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে হেনস্তা হতে হয় না। বরং
মানুষ নিজেরাই নিজেদের দায়িত্বে বাচ্চাকে টিকাকেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন।
পরিবার ছোট রাখার জন্য নিজেরাই এখন পরিকল্পনা করছেন। শিশুদের টিকাদানের
েেত্র বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। সন্তান
জন্মের হারও কমেছে।
উপরের এ সাফল্যের পেছনে বিশেষ কিছু কি রয়েছে? নাকি
এমনি এমনিই এসব হয়ে গেছে? এসব প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়-উপরের এমন সাফল্য
এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের নিরলস
যৌথ প্রয়াস। শুরুতে বাধা আসলেও দেখা গেছে নানামুখী প্রচার প্রচারণার ফলে
একসময় মানুষ নিজে থেকেই বুঝতে সম হয়েছে তাদের ভালোর জন্যই সরকার এসব করছে।
ফলে তারাও তখন থেকে এগিয়ে এসেছে।
করোনার টিকা নিয়েও বিভিন্ন মহল থেকে
নানামুখী ভুলবার্তা মানুষের কাছে শুরুর দিকে যেভাবে গেছে এখন সেটা কমেছে
ঠিকই। তবে তাতে অনেকের ধারণায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি বলেই মনে হয়। তারা
এখনও টিকা না দেয়ার মনোভাবই লালন করছে। ইপিআই টিকা তো বছরের পর বছর ধরে
চলমান আছে, থাকবে। কিন্তু করোনা হচ্ছে আশু বিপদ। একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য
আমাদের হাতে সময় খুবই কম। ফলে টিকা নেয়ার ব্যাপারে যেন মানুষ উৎসাহী হয়
সেজন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি কিছুটা বাধ্যবাধকতাও আরোপ করা দরকার বলে আমার
মনে হয়। কারণ টিকা নেয়া বা না নেয়া মানুষের অধিকার বলে যে যত কথাই বলুক না
কেন বাস্তবে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ এখন আর তেমন নেই। টিকা না নিলে বিদেশগমনে
বাধা আসছে। দেশের ভেতরেও নানাবিধ রেসটিকশন দেয়া হচ্ছে।
অনেক দেশ মানুষকে
উদ্বুদ্ধ করার জন্য টিকা নিলে অর্থ দিচ্ছে। কোথাও খাবার ফ্রি দিচ্ছে।
এরপরেও যারা নিচ্ছেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে।
কারণ এ ছাড়া উপায়ও নেই। কিছু মানুষের টিকা না নেয়ার আজগুবি বিশ্বাসের পে
সায় দেয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। আর টিকা দেয়াই হয়ে থাকে সংক্রামক রোগ
প্রতিরোধের জন্য। ফলে করোনা সংক্রামক ব্যাধি হওয়ায় টিকা নেয়ার কোনো বিকল্পও
নেই। শুধু একটা কথাই বলব-নিজেকে, পরিবারের সবাই তথা রাষ্ট্রকে নিরাপদ
রাখতে আমাদের টিকা নিতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। অহেতুক গুজবে কান দিয়ে,
টিকা না নিয়ে নিজের ও পরিবারের তি করবেন না। এটা কোনো সচেতন নাগরিকের কাজ
হতে পারে না।
করোনার টিকা এ মাস থেকেই গণহারে দেয়া শুরু হবে। একদম
প্রত্যন্ত অঞ্চলেও টিকাকেন্দ্র খুলে টিকা দেয়া হবে। আগে থেকে
রেজিস্ট্রেশনেরও কোন প্রয়োজন থাকছে না। ফলে টিকা নেয়াটা এখন একজন সচেতন
মানুষের নৈতিক দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।
এরপরেও যারা টিকা নিবেন না তাদের
ব্যাপারে করণীয় কি হতে পারে? আমার প্রস্তাব হচ্ছে-বিভিন্ন স্থানে যাওয়া
আসা, চাকুরিবাকুরি, ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা, ব্যাংক পরিষেবা, সন্তানদের শিা
প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ইত্যাদি ব্যাপারে সুয়োগ সুবিধা কর্তন করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, টিকা না নিয়ে কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে
ভর্তি হন তবুও তার চিকিৎসার ব্যয়ভার নিজেকেই বহন করতে হবে বলে ঘোষণা দেয়া
যেতে পারে। আমার মনে হয় তাতে বেশ ভালোই কাজ হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্রি তে
দেয়া টিকা না নিয়ে যিনি করোনা আক্রান্ত হবেন তিনি কি করোনা চিকিৎসা ফ্রি তে
পাওয়ার অধিকার রাখেন? যারা করোনা টিকা নিচ্ছেন না তারা তো সমাজ ও
রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরুপ। তারা নির্বিবাদে করোনা ছড়াচ্ছেন। নিজেকে যেমন
মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তেমনিভাবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয়
পরিসেবাকেও ব্যাপক হুমকি ও চাপের মুখে ফেলছেন। ফলে যারা টিকা না নিয়ে
উপরন্তু করোনা বোমা শরীরে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন এবং বলবেন এটা তার অধিকার;
তাহলে বলতেই হবে এদের সে প্রচেষ্টাকে নিবৃত্ত করাও রাষ্ট্রের অধিকারই বটে।
কারণ ব্যক্তির বাহুল্য অধিকার যদি রাষ্ট্র ও জনজীবনকে বিপদাপন্ন করে তোলে
তাহলে সে অধিকার প্রতিপালন করতে না দেয়াটাও রাষ্ট্রের অধিকার বলেই মনে করি।
আশা করি করোনা টিকা প্রযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রও তার অধিকার প্রয়োগে যথাযথ
পদপে নিবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার।