ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়
নৌ-দুর্ঘটনার ২২ ঘণ্টা পর শনিবার বিকেলে দুর্ঘটনাকবলিত নৌকাটি উদ্ধার না
করেই 'অভিযান সমাপ্ত' ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এ দুর্ঘটনা ঘিরে ওঠা
প্রশ্নগুলো সহজে মিলিয়ে যাবে না। বিশেষত এই প্রশ্ন তিতাস নদী কিংবা লইস্কার
বিল ছাড়াও গোটা দেশের নৌপথ ধরেই উঠতে থাকবে- ফিটনেস সনদ ছাড়া নৌযান চলে
কীভাবে? আমরা জানি, ফিটনেস সনদ থাক বা না থাক; প্রধান রুটগুলোতে বড় নৌযান
ছাড়া রাতের বেলা নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। তারপরও এই যাত্রীবাহী ট্রলার কিংবা
তার সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়া বালুবাহী 'বাল্ক্কহেড' চলছিল কীভাবে? সন্দেহ নেই,
শুক্রবার সন্ধ্যার ওই দুর্ঘটনা যেমন বেদনাদায়ক তেমনই বিােভ-জাগানিয়া।
দুর্ঘটনার পর শনিবার পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ২২টি প্রাণহীন দেহ আমাদের যেন
অপরাধী করে দেয়- কী দোষ ছিল নারী-শিশুসহ নিহত ব্যক্তিদের? তার চেয়েও বড়
প্রশ্ন- নৌপথে কি শৃঙ্খলা ফিরবে না? বাংলাদেশের বিস্তৃত নৌপথে প্রাকৃতিক
কারণে জলযান দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু নেহাত কম নয়। কিন্তু তিতাসের
দুর্ঘটনাটি এমন সময় ঘটল যখন সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে নৌ-দুর্ঘটনা
ক্রমেই কমে আসছে। আমাদের মনে আছে, এর আগে গত এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের
শীতল্যায় আরেকটি বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনায় ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেখানেও
তিতাসের মতো সন্ধ্যার মুখে নদীপথে যাত্রীবাহী ট্রলারের সঙ্গে একটি কার্গো
জাহাজের ধাক্কা লেগেছিল। এবারের মতো সেবারও দুর্ঘটনার পর পালিয়ে গিয়েছিল
কার্গোটি এবং পরে আটক হয়েছিল। আমাদের প্রশ্ন, শুধু উদ্ধার কাজ সমাপ্ত করে
কিংবা দুর্ঘটনার জন্য দায়ী 'বড়' নৌযানকে আটক করেই কি দায়িত্ব শেষ হবে? মনে
রাখা জরুরি, সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাগুলোর প্রায় সবই ঘটছে সন্ধ্যা বা রাতের
বেলা। এর অর্থ, নানা ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দিনের আলোয় নৌযান দুর্ঘটনা কমানো
গেলেও রাতের নৌপথ এখনও ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে। আমাদের প্রশ্ন, দুর্ঘটনা
হ্রাস পাওয়ায় নজরদারি ও সতর্কতা কি কমে এসেছে? আমরা আশঙ্কা করি, রাত নেমে
আসার সঙ্গে সঙ্গে যেমন প্রকৃতিতে আলস্য দেখা দেয়, তেমনই নৌপথের নিয়ম ও
বিধিবিধান প্রয়োগেও সম্ভবত শৈথিল্য চলে আসে। আর এর বলি হতে থাকে মূল্যবান
প্রাণ। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। স্বীকার করতে হবে- তিতাসের দুর্ঘটনার
েেত্র আক্রান্ত ট্রলারটিও দায় এড়াতে পারে না। এ েেত্র শুধু ফিটনেস সনদ না
থাকার বিষয়টি নয়; ধারণমতার অনেক বেশি যাত্রীও ছিল বলে প্রত্যদর্শীরা
জানাচ্ছেন। আমরা মনে করি, নৌপথে শৃঙ্খলা আনতে হলে ছোট-বড় সব পকে নিশ্চয়ই
দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। বস্তুত যত বড় নৌযান, তাদের দায়িত্বশীলতা তত
বেশি হওয়া উচিত। আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে নৌপরিবহন কর্তৃপকে। রাতে বা
দিনে, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া চলবে না। আমরা প্রায়শ এও
দেখছি- বালুবাহী, যাত্রীবাহী, মাছধরা, খেয়া নৌযানের মধ্যে পারস্পরিক
দুর্ঘটনা ঘটছে। সংখ্যায় কম হলেও হতাহতের ঘটনাও ঘটছে। তিতাসের এই অঘটনেও
যাত্রীবাহী নৌযানটি প্রথমে যে একটি ডিঙি নৌকার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিল-
কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে তা বলা হয়েছে। এসব 'ছোট' দুর্ঘটনায় নির্লিপ্ততা যে বড়
দুর্ঘটনার ত্রে প্রস্তুত করে- ২২টি মূল্যবান প্রাণ হারিয়ে তা আরেকবার
প্রমাণ হলো। আমরা নিশ্চয় চাই, তিতাসের দুর্ঘটনায় তিগ্রস্ত পরিবারগুলো
উপযুক্ত তিপূরণ পাবে। যে নৌযানের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটাকেও আনতে হবে
আইনে আওতায়। গঠিত তদন্ত কমিটি যাতে যথাসময়ে প্রতিবেদন জমা দেয় এবং সে
অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে ব্যাপারেও আমরা নজর রাখব। কিন্তু এসব করেই
কর্তৃপরে দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিত করতে নিতে হবে
দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা। দেশের বিস্তৃত নৌপথজুড়ে যে ঐতিহ্যগত এবং অর্থনৈতিক ও
পরিবেশগত দিক থেকে সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, তাতে আর কান্নার রোল
দেখতে চাই না আমরা। বরং দেখতে চাই তিতাসের নৌ-দুর্ঘটনাটিই হয়েছে বেদনার শেষ
অধ্যায়।