মেহেরুন্নেছা ||
দাদার কাছে শৈশবে প্রাচীন মিশরের ফারাও রাজবংশের গল্প শুনে কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিতাম টেরও পেতাম না। হযরত মুসা (আ.) এর দেশ এই মিশর। রানি নেফারতিতির দেশ মিশর যিনি তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য ফারাও সা¤্রাজ্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। মিশরীয় ভাষায় 'নেপারতিতি' শব্দের মানেই হলো 'একজন সুন্দরীর আগমন হয়েছে'।
মিশরকে বলা হয় পিরামিডের দেশ! মিশর মমির দেশও বটে! 'মমি' কথাটির উদ্ভব হয়েছে আরবি 'মামাইয়া' শব্দ থেকে যার অর্থ হলো মৃতদেহকে মোম অথবা আলকাতরা জাতীয় পদার্থ দিয়ে সংরণ করা। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরেও মানুষ একই রকম থাকবে। এই বিশ্বাস থেকেই তারা মৃতদেহ সংরণের পন্থা উদ্ভাবন করে। মিশরের যে পিরামিড তার কাজ হলো মৃতদেহকে সঠিকভাবে রা করা। মৃতদেহকে সংরণ করার বিশেষ পদ্ধতি হলো মমি করা আর দেহটা হলো মমি।
প্রকৃতপে মমি একটি মৃতদেহ যা ঐ মৃতদেহকে বায়ুর অভাব, অনাবৃষ্টি, মৌসুমীয় অবস্থা এবং বিশেষ দাফন প্রথাগুলো থেকে রা করে। সহজ ভাষায়, মমি মানে ওষুধে মাখানো কাপড়ে জড়ানো মৃতদেহ, যে মৃতদেহ থেকে সমস্ত আর্দ্রতা বের করে দিয়ে শুকিয়ে সংরণের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। হলিউড মুভি 'মাম্মি' যারা দেখেছেন তারা জানেন মমি দেখতে কিরকম! ধাপে ধাপে ব্যান্ডেজে পেঁচানো, হাত দুটো প্রসারিত করে সামনে এগুচ্ছে মানুষের অবয়ব। এরাই মমি! বাস্তবে মমি কখনো জীবিত হয়ে উঠবে না, কারণ মমিগুলো অপচনশীল মৃতদেহ।
কেবল মিশরীয়রা মমি তৈরি করতো তা নয়, ইতিহাস বলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন জনপদে প্রাচীনকালেও মমি সংরণের প্রচলন ছিল। অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, প্রাচীন ইউরোপিয়ান সভ্যতা, ইনকা সভ্যতাসহ আরো বহু সভ্যতার মানুষেরা মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতো এবং হাজার হাজার বছর ধরে তারা মৃতদেহকে মমিকরন করে সংরণ করে রাখতো।
উল্লেখ্য প্রাচীনকালে কিছু মমি সৃষ্টি হয়েছিল দুর্ঘটনাবশত। যেমন, মেক্সিকো এবং গুয়ানাজুয়াতোতে এরূপ একশ-এর বেশি মমির সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের ইচ্ছেকৃতভাবে মমিকরণ ঘটেনি। মনে করা হয়, সেই এলাকার মাটির নিচে বিপুল পরিমাণে সালফার, প্রচন্ড তাপমাত্রা, প্রচুর ঠান্ডা অথবা অন্যান্য খনিজ পদার্থের কারণে মৃতদেহগুলো মমিতে পরিণত হয়। এগুলো হলো স্পন্টেনিয়াস মমি। বলা যায়, প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মমি হলো স্পন্টেনিয়াস মমি।
আমরা এন্ত্রোপজেনিক মমি সম্পর্কেও বইপত্রে পড়ে থাকি। এন্ত্রোপজেনিক মমি হলো সেগুলো যা সংরণের জন্য তৈরি করা হত। যেমন, ধর্মীয় কারণে যে মমিগুলো তৈরি হতো সেগুলো অবশ্যই এন্ত্রোপজেনিক। মমির এই দুই ধরণ, এন্ত্রোপজেনিক ও স্পন্টেনিয়াস, উভয়ই মমির একক সংস্কৃতির অংশ। যেমন, প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতি এবং দণি আমেরিকার অ্যান্ডিন সংস্কৃতি।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালের আগে মিশরীয়রা তাদের মৃতদেহগুলোকে গভীর গুহার ভেতরে কবর দিত। কোনো কোনো গুহা এতোটাই সংকীর্ণ হতো যে, এর ফলে মরুভূমির শুষ্ক ও উত্তপ্ত বালির তাপে প্রাকৃতিক উপায়ে মৃতদেহের মমিকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যেত। এন্ত্রোপজেনিক বা ইচ্ছাকৃত মমিকরণ প্রথার চল শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ সাল থেকে। মিশর যত সমৃদ্ধশালী হচ্ছিলো, ততই মমিকরণ প্রথা হয়ে ওঠে সমাজের পদমর্যাদা ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
একটি মমি বানাতে প্রায় ৭০ দিনের মতো লাগতো। গ্রেকো-রোমান পিরিয়ডের কিছু ডকুমেন্টে মমিকরণের কথা সরাসরি উল্লেখ আছে। দ্য রিচুয়াল অব এম্বলেমিং শীর্ষক বইটিতে মমিকরণের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত যে তথ্য আর চিত্র পাওয়া যায় তা অসম্পূর্ণ। তবে এই পর্যন্ত মমিকরণের যতগুলো বর্ণনা পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিস্তারিত লেখা আছে হেরোডোটাসের হিস্টোরিস এর ২য় পর্বে। সেখানে এও লেখা আছে যে, প্রাচীন মিশরে মমি তৈরিতে ন্যাট্রন ব্যবহার হত। তবে এটা ঠিক যে, বর্ণনাগুলো সংপ্তি ও অস্পষ্ট। মমি আমাদের সামনে প্রাচীন মিশরের চিত্র নিয়ে আসে। কিছু কিছু মমিতে য়প্রাপ্ত দাঁত পাওয়া গেছে। তার মানে তখনকার দিনেও মানুষ মিষ্টি খেতে পছন্দ করতো।
মমি তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রথমে মৃতদেহটিকে ধুয়ে নেয়া হতো। হুকের মতো একটা যন্ত্র ব্যবহার করে নাকের ছিদ্র দিয়ে মাথার মগজ বের করে আনা হতো। অবশ্য মিশরীয়রা মগজ ফেলে দিত। কারণ, তারা ওটা সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তারপর তলপেটের বামদিকে একটা ছেদ কেটে সেই ছেদ দিয়ে নাড়ীভুঁড়ি, যকৃত, ফুসফুস ইত্যাদি অঙ্গ বের করে ফেলা হত। মমির সাথে কিছু মুখবন্ধ পাত্র পাওয়া গেছে যেখানে মানুষের যকৃত, ফুসফুস, পাকস্থলি এবং অন্ত্র ছিল। তবে হৃদপি- রেখে দেয়া হত শরীরের ভেতরেই যাতে পরকালে ব্যবহার করতে পারে। হৃদপি-কে মিশরীয়রা শরীরের অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্র মনে করতো।
দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহ বের করার পর কাটা অংশকে তালের মদ দিয়ে পরিষ্কার করা হতো। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া এবং মসলা দেহের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে একটি আবদ্ধ জারে ৪০ দিন রেখে দেয়া হত। এই ৪০ দিনে দেহটা শুকিয়ে যেত। মিশরীয়রা এসময় 'ন্যাট্রন' নামক একটা বিশেষ লবণের মিশ্রণে মৃতদেহটি মাখিয়ে রেখে দিত। এই ন্যাট্রন মাখানোর কারণে মৃতদেহ থেকে সব আর্দ্রতা বের হয়ে যেত। তারপর শরীর থেকে লবণ পরিষ্কার করে শুষ্ক চামড়ায় রজন এবং সুগন্ধি তেল মিশ্রিত মলম মাখানো হতো। কাঠের গুঁড়া ও কাপড়ের টুকরা দিয়ে শরীর পেঁচানো হতো। কাটা জায়গাটিকে মোম দিয়ে আটকে দেয়া হতো। লিলেন কাপড়ের ব্যান্ডেজ দিয়ে ১৫-২০ দিন ধরে প্রায় ২০ ধাপে মৃতদেহটি প্যাঁচিয়ে রাখা হতো। প্রায় ৪১০ গজ লিলেন কাপড় এ কাজে ব্যয় হতো। অতঃপর মৃত্যু মুখোশ বা ডেথ মাস্ক বসিয়ে দেয়া হত। একটা বড় কাপড়ের টুকরায় আবৃত করা হত ব্যান্ডেজে মোড়ানো মৃতদেহটিকে। পরে লিলেন কাপড়ের টুকরার সাহায্যে শক্ত করে মৃতদেহকে বেঁধে ফেলা হতো। এবার মৃতদেহ কফিনে স্থানান্তরের পালা। এেেত্র কফিন বা নকশাকৃত মমি কেস ব্যবহার করা হতো।
তখনকার দিনে এভাবে মমিকরণ প্রক্রিয়া ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত ও ব্যয়বহুল। অবশ্য হেরোডোটাস আরো দুইধরণের মমি প্রস্তুতের প্রক্রিয়ার কথা বলেন। কিন্তু উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়াটি সেসময় জনপ্রিয়তা লাভ করে।
প্রাচীন মিশরীয়দের আনুবিস নামে শেয়ালমুখো এক দেবতা ছিল। মমি তৈরির বিভিন্ন ধাপে ধাপে
ধর্মগুরু এবং মলম মালিশকারীরা এই দেবতার তরে বিশেষ প্রার্থনা করে যেত। মলম মালিশকারীরা মমির সাথে ব্যান্ডেজে কিছু অলঙ্কার দিয়ে দিতো। কাপড় মোড়ানোর সময় মোড়ানোর কাজে নিয়োজিত লোকজন কখনো কখনো ভয়ে বা আবেগে বিহ্বল হয়ে যেত। তখন কিছু কিছু মমিতে গিরগিটি, ইঁদুর প্রভৃতি একেবারে ব্যান্ডেজের ভিতর ঢুকে পড়তো।
একটা কথা না বললেই নয়, একটা সময় বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরাও নিজেরাই নিজেদেরকে মমিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করতেন। প্রথমে তারা অনশন করতেন এবং অনশনকালীন এমন খাবার খেতেন যা খেলে মানবদেহ য় হয়। এ অবস্থা চলতে চলতে তাদের শরীর একসময় চর্বিহীন হয়ে যেত। তখন তারা বিষাক্ত কিছু সেবন করে প্রচুর বমি করতো। বমির সাথে দেহের জলীয় অংশ বের হয়ে যেত। সেবনকৃত বিষাক্ত পানীয় দেহকে মৃত্যুর পর পোকামাকড়ের হাত থেকেও রা করে। অতঃপর সর্বশেষ ধাপে আত্মঘাতী এই সন্ন্যাসীরা নিজেদের মৃত্যু ও মমিতে পরিণত হওয়ার অপো করে।
যদিও তাদের মৃত্যু হতো ঠিকই, তবে খুব কম সন্ন্যাসীর লাশ মমিতে পরিণত হতো। আফ্রিকা, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা এবং দণি আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও মমির সন্ধান পাওয়া গেছে। একদা যে মমি ছিলো ধর্মের প্রতীক আজ তা সাহিত্যের অংশ। গল্প বা সিনেমায় মমিকে সাধারণত ভূতুড়ে হিসেবে দেখতে পেলেও বাস্তবের মমিগুলো মোটেও ভূতুড়ে নয়। অবশ্য এরা দেখতে ভয়ানক হলেও এদের যে অভিশাপের কাহিনী প্রচলিত সেগুলোও বিজ্ঞানভিত্তিক নয়।
তবে মমি সম্পর্কে যা জানা গেছে তা মোটেই মমির সম্পূর্ণ রহস্য উদঘাটনে যথেষ্ট নয়। মমি নিয়ে যত বেশি গবেষণা হচ্ছে, ততই যেন মমি রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে উঠছে।
মেহেরুন্নেছা
সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ।
কুমিল্লা।