ইকরাম আহমেদ ||
করোনা মহামারি মোকাবিলায় সারাবিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। প্রায় দেড় বছর ধরে বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে এই মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল প্রায় সব দেশই এককথায় পরাস্তই হয়েছে বলা চলে। কোনো কোনো দেশে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় পরিকল্পনাহীনতা, সমন্বয়হীনতা, দায়িত্বহীনতা এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ সৃষ্টি হয়, মন্ত্রিত্বের রদবদল পর্যন্ত ঘটেছে। ব্যর্থতা বা বিচ্যুতির দায়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো েেত্র নীতিনির্ধারক রাজনীতিক এবং বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের ঘটনাও ঘটেছে।
এই প্রোপটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো তাদের দ জনশক্তি, বিশাল আর্থিক সামর্থ্য প্রভৃতির কারণে অদূর ভবিষ্যতে এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠে অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখবে, এটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই যুদ্ধ অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী এবং বহুমাত্রিক। বাংলাদেশকে যে শুধু আগামীতে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে রাষ্ট্র এবং সমাজজীবনকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে তাই নয়; বরং উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার গতি অব্যাহত রাখার জন্য নিতে হবে সর্বাত্মক কর্মসূচি, গড়ে তুলতে হবে দ জনশক্তি, সুশৃঙ্খল এবং উঁচু মানসম্পন্ন একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা। প্রণয়ন করতে হবে নিখুঁত পরিকল্পনা, সৃষ্টি করতে হবে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতির প্রকৃত মেলবন্ধন। কিন্তু এই মেলবন্ধনের অভাবটাই যথেষ্ট প্রকটভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে এই দুর্যোগকালীন এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে। পারস্পরিক দোষারোপ, দায়িত্ব সম্পাদনে ব্যর্থতার দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া প্রভৃতির ফলে বৃহত্তর জনগণ বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে- পরিণতিতে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট, যা মোটেই কাম্য নয়।
এ নিয়ে এখন আর সম্ভবত কোনোরূপ বিভ্রান্তির অবকাশ নেই, প্রশাসনযন্ত্র বা ব্যুরোক্রেসি পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থা নির্বিশেষে সর্বাপো প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য একটি অঙ্গ। একজন পরিবারপ্রধান তার পরিবারের প্রশাসন পরিচালনা করেন। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনি প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, আইনজীবী, বিজ্ঞানী, শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী যা-ই হোন না কেন, তার অধীন সংগঠন পরিচালনার কাজে একজন প্রশাসক হিসেবেই কাজ করেন। এমনকি বলা হয়ে থাকে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পরিচালনা করা হতো দৃঢ়কঠিন প্রশাসনিক বা আমলাতান্ত্রিক আদলে। প্রাচীনকাল থেকেই গ্রিক, রোমান, পারসিক, চৈনিক বা ভারতীয় রাজা এবং সম্র্রাটদের অধীনেও একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো বা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা সাম্রাজ্যের বা রাষ্ট্রের প্রশাসন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকত। আধুনিককালের ম্যাক্স ওয়েবার প্রমুখসহ ভারতে চাণক্য বা কৌটিল্য, চীনের কনফুসিয়াস প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যুরোক্রেসির আবশ্যকতা এবং যোগ্যতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। আধুনিক কল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও ব্যুরোক্রেসি একটি সুগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং দ প্রশাসন কাঠামো হিসেবে রাজনৈতিক কর্তৃপরে প্রণীত বা বিঘোষিত নীতিমালা বাস্তবায়নে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রখ্যাত মার্কিন শাসনতান্ত্রিক বিশেষজ্ঞ জন রোর একটি রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থা জনপ্রশাসনের ওপর সর্বাধিক পরিমাণে নির্ভরশীল মর্মে মত প্রকাশ করেছেন।
প্রণিধানযোগ্য, এমনকি আইনসভা বা বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাও দৃশ্যমান প্রশাসনিক পদ্ধতিতেই চলমান থাকে। প্রাচীনকাল এবং মধ্যযুগে প্রশাসনের প্রধানতম দায়িত্ব ছিল দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। অর্থাৎ রাজার মতা নিরবচ্ছিন্ন রাখা ছিল রাজকর্মচারীদের প্রধানতম কাজ। এর সঙ্গে নিয়মিত খাজনা আদায় করে কোষাগার স্টম্ফীত রাখাও তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্রাট হর্ষবর্ধন, মৌর্য্য সম্রাটরা এবং মোগল সম্র্রাটদের সময়ে দৃঢ় কঠিন প্রশাসনযন্ত্রের আওতায় রাজার মতা অপ্রতিহত রাখা হতো। এসব সম্রাট প্রজাবৎসল হওয়ার মানসে মাঝেমধ্যে প্রশাসনিক এবং রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার সাধনেও ব্রতী হতেন। টোডরমল্লের রাজস্ব সংস্কার এখনও ইতিহাসবিদদের গবেষণার বিষয়। পাঠান সম্রাট শেরশাহ প্রবর্তিত ঘোড়ার ডাক, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড প্রভৃতি প্রজাদরদি শাসনব্যবস্থার পরিচয় বহন করে। মোগল সম্রাটদের সময়ে 'সুবেদার' এবং পরবর্তীকালে ইংরেজদের সময়ে কালেক্টর এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ সে সময়ের ঊর্ধ্বতন রাজকর্মচারীদের দায়িত্বের যথার্থ পরিচয় তুলে ধরে। সময়ের ব্যাপ্ত পরিসরে ভূ-রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ববাদী শাসকরা কঠোর শাসনের পাশাপাশি কিছু কিছু জনকল্যাণকর কর্মসূচির আবরণে কর্তৃত্ববাদী কিন্তু জনদরদি (বেনেভোলেন্ট ডেসপট) হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। এই উপমহাদেশে বিগত শতকের ষাটের দশকে স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের 'ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস (প্রভু নয় বন্ধু)' এরই সূত্রবাহী। এই পুস্তক এবং 'ডিকেড অব রিফর্মস' নামক ভুল তথ্য এবং পরিসংখ্যানে ভরপুর একটি বিপুল বপুর পুস্তককে ভিত্তি করে অনেকেই আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের তল্পিবহন করাকে যৌক্তিকতা দানের অপপ্রয়াসও পেয়েছিল।
সংস্কারের এবং বিবর্তনের ধারাকে অব্যাহত রেখে গত শতকের ষাটের দশকেই জেলার কালেক্টর এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাজের সঙ্গে উন্নয়ন কর্মসূচির তদারকি, সমন্বয় এবং বাস্তবায়নের কাজ যুক্ত করে মাঠপর্যায়ে সরকারের এই কর্মকর্তার নতুন নামকরণ করা হয় ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক। পরে জেলার উন্নয়নমূলক কর্মকা- পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তাদেরও ধীরে ধীরে পদায়ন করা হয়। জেলা প্রশাসক প্রধানত আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সমন্বয়ক এবং তদারককারীর ভূমিকা পালন করেন। জনান্তিকে উল্লেখ্য, 'জেলা প্রশাসক' শব্দটার মধ্যে আমাদের দেশে কেউ কেউ ঔপনিবেশিকতার গন্ধ খুঁজে পান, যা একেবারেই অমূলক। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে এই কমকর্তাদের 'জেলা শাসক' হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা কিংবা সাধারণ নাগরিকরা এর পেছনে ঔপনিবেশিকতার গন্ধ আবিস্কারের অর্থহীন প্রয়াসে সময়ের অপচয় করেন না।
বাস্তবতা হচ্ছে, কয়েক শতাব্দী ধরে বিশ্বের সর্বত্র সমাজব্যবস্থার ধরন নির্বিশেষে সরকার এবং ব্যুরোক্রেসির আন্তঃসম্পর্কের েেত্র প্রভূত রূপান্তর ঘটেছে। প্রশাসন (বৃহত্তর অর্থে) বর্তমানে সরকারগুলোর সর্বাপো নির্ভরযোগ্য সহযোগী এবং অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। শত সমালোচনা, বিরোধিতা অথবা অসহযোগিতা প্রভৃতি পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও সরকারের বিঘোষিত নীতিমালার বাস্তবায়ন এবং জনপ্রতিনিধিদের প্রণীত আইনের কাঠামোর ভেতরে থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য অপরাধ দমনসহ সর্বত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক রাখার জন্য নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যান প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা। দিনরাত রোদ-বৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা-খরা-মহামারি যে কোনো পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র কখনোই থেমে থাকে না। জরুরি প্রয়োজনের সময়ে কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য কোথায় কার কাছে যেতে হবে কিংবা সংবাদ পৌঁছাতে হবে সেটা জনগণ জানে এবং প্রত্যাশা করে।
স্মরণ করা যেতে পারে, গত শতকের শেষ দশকে দীর্ঘ প্রলম্বিত বন্যায় যখন দেশের অধিকাংশ অঞ্চল প্লাবিত হয়, যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ কাজকর্ম ফেলে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছিল, তখন তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন আপামর জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে, তাদের মাথা গোঁজার ন্যূনতম আশ্রয়ের ব্যবস্থা, তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের দোরগোড়ায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া ও গবাদি পশুর শুকনো খাদ্যের সংস্থান করার জন্য। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ নেওয়ার সুযোগ বা সময় তাদের অনেকেরই ছিল না। ত্রেবিশেষে কিছু বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং জনদরদি ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সমগ্র বন্যাকবলিত এলাকায় সমন্বিতভাবে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, বিতরণ, কারচুপি রোধ, অপরাধ দমন এবং মহামারি প্রতিরোধসহ বন্যায় তিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষের পুনর্বাসনের েেত্র রাতদিন একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন রাষ্ট্রের সুশীল সেবকরা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাটা আমি দায়িত্ব নিয়েই বলতে পারি। এর স্বীকৃতি মেলে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এসএএমএস কিবরিয়া কর্তৃক তার বন্যা-উত্তর বাজেট বক্তৃতায় দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকার প্রতি অকুণ্ঠ প্রশংসাবাদ দ্বারা।
তিনি খুবই মিতভাষী এবং সংযতবাক একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাজেট বক্তৃতায় তার কণ্ঠে উচ্চারিত এই প্রশংসাবাক্য সরকারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কর্মোদ্যম এবং প্রেরণা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল নিঃসন্দেহে। প্রকৃতপে গত অর্ধশতাব্দীকালব্যাপী দেশকে যত রকম দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মুখোমুখি হতে হয়েছে, এর সবগুলোর েেত্রই সরকারি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই ভূমিকা অটুট ছিল। পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন কর্মকা- এবং নিয়মিত দাপ্তরিক কর্মসম্পাদনেও তাদের বিরত থাকার কোনো সুযোগ ছিল না। কভিড-১৯ প্যানডামিককালেও কোনো কোনো মহল থেকে অনেক কিছু না জেনেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পর্কে মাঝে মাঝে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য করা হলেও এর দ্বারা হতোদ্যম না হয়ে তারা তাদের কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। এরই স্বীকৃতি মেলে সাম্প্রতিক বাজেট অধিবেশনের সমাপ্তিলগ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক দুর্যোগ মোকাবিলা করে দেশের অগ্রযাত্রা নিরবচ্ছিন্ন রাখার েেত্র সরকারি কর্মচারীদের উদারকণ্ঠে প্রশংসা জ্ঞাপনের মাধ্যমে। এর ফলে দেশের প্রয়োজনে তাদের যে কোনো ত্যাগ স্বীকার এবং নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ার প্রেরণা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে নিঃসন্দেহে।
সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন