
শান্তিরঞ্জ ভৌমক ।।
পর্ব-১১আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় আগে নানা সময়ে মেলা বসতো। বিশেষত পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কুমিল্লা টাউন হল প্রাঙ্গণে বসত মাছের ঐতিহাসিক মেলা। সাথে হাঁড়ি-পাতিল ও মিষ্টির খেলনা, চিড়া-মুড়ির মোয়া, পাঁঠা-খাসি ও মুরগীর দোকান। মেলার প্রবেশ পথে কাঁচা হলুদ কিনে যাত্রা শুরু হতো। তবে মাছের কদরই সবচেয়ে বেশি। নানা ওজনের মাছ, কুমিল্লা শহরে প্রায় সব পরিবারই একাধিক মাছ ক্রয় করতেন এবং আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবদেরকে মাছ উপহার দিতেন। আশির দশকে এরশাদ সরকার যখন বাংলা পঞ্জিকায় পরিবর্তন আনে, তখন পহেলা বৈশাখ আর একদিন নির্ধারিত থাকেনি। বাংলাদেশি পঞ্জিকা প্রকাশ হওয়ায় সনাতনী পঞ্জিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিভাজন সৃষ্টি হয়ে যায়। বাংলাদেশের একশ্রেণি বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশী পঞ্জিকাকে মুসলমানের পঞ্জিকা হিসেবে অপপ্রচার করে পহেলা বৈশাখ ‘আমাদের ও তাদের’ এরূপ বিভাজন রেখা টেনে দেয়। সুতরাং সনাতনী পঞ্জিকা মতে পহেলা বৈশাখ যখন টাউন হল মাঠে মাছের মেলা বসার উদ্যোগ নিল, সরকারের পরোক্ষ ইন্ধনে এ মেলাটি ভেঙে দেয়া হয়। তারপর থেকে বাজারে মাছের মেলা বসে না, মাছবাজার বসে ও সেখানেই শহরবাসী পহেলা বৈশাখে মাছ ক্রয় করে। কাজেই এখন আর আগের মতো জমজমাট মেলা টাউনহল মাঠে বসে না, শুধু হাঁড়ি-পাতিল ও খেলনা মিষ্টির দোকান দেখা যায়।
অন্য একটি মেলা বসে ঠাকুরপাড়া বৌদ্ধমন্দিরের উত্তরে বটগাছতলায়, এখানে পাঁঠার মাংস ব্যাপক বিক্রি হয় ও বটগাছকে দেবতাজ্ঞানে বা দেবতাআশ্রিত অধিষ্ঠান হিসেবে হিন্দু-নারীরা পূজা দিয়ে থাকে। এ মেলাটি সীমিত আকারে এখনও চলমান। পহেলা বৈশাখ বিকেলবেলা দিগম্বরীতলায় একটি মেলা বসত। সেখানে জুয়া খেলাই প্রধান। অন্যান্য দোকান-পাট থাকলেও পার্শ্ববর্তী এলাকার অসাধু কিছু লোক প্রতারণার মাধ্যমে মেলায় আগত লোকদের হয়রানি করত। এখন আর এ মেলাটি বসে না। বৈশাখ মাসের ৭ তারিখ বকুলতলায় বিকেলবেলায় একটি মেলা বসত। বকুলতলা রাণীরবাজার এলাকায় রাসস্থলীর নিকটবর্তী। কেন বকুলতলা তার কোনো বিষয় খোঁজে পাইনি। এছাড়া ষাটের দশকে দেখেছি- কুমিল্লা স্টেডিয়ামে চারদিক টিনের বেড়া দিয়ে প্রদর্শনী/একজিভিশন হতো মাসাধিক কাল ব্যাপী। এ প্রদর্শনীতে নানা প্রকার দোকানপাট ছাড়াও বেডমিণ্টন খেলা, হাডু-ডু খেলা এবং যাত্রাগানের আসর বসত। এখন এ আদলে প্রদর্শনী হয় না। তবে সরকারিভাবে কৃষিমেলা, বৃক্ষমেলা, বইমেলা ইত্যাদি যথানিয়মে হয়ে থাকে। তাতে সাধারণভাবে জনসংস্পৃক্ততা তেমন থাকে না। প্রাণের মেলা বলতে যা বুঝায়, তা অনেকটা পোষাকী হয়ে গেছে। তবে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তা অনেকটাই প্রাণবন্ত। এছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।
আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় এক ঐতিহাসিক আয়োজন ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ৩৮ বছর যাবত পৌরপার্কে জামতলায় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একুশ দিন ব্যাপী ‘তিন নদী পরিষদের’ ব্যবস্থাপনায় ও সঞ্চালনে পরিষদের প্রাণপুরুল সাপ্তাহিক অভিবাদন পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাসানাত বাবুলের নেতৃত্বে সুচারুভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে জামতলার একুশের অনুষ্ঠানটি নানাভাবেই আমার শহর ‘কুমিল্লা’র অহংকার ও গৌরবের স্থানে পৌঁছে গেছে। যদিও ‘তিন নদী পরিষদ’ একসময় অনেকেই তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তা ছিল সীমিত। এখন পরিষদের সভাপতি আবুল হাসানাত বাবুলের প্রায় একক উদ্যোগে ও পরিবারের পক্ষে দায়বদ্ধতায় এবং সম্পাদক জমির উদ্দিন খান জম্পির সহযোগিতায় ও সরকারি তথ্য অফিসের প্রচারযন্ত্রের সরবরাহের ফলে শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উজ্জ্বল ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে এখন এক ঐতিহ্যের সৃষ্টি হয়েছে। দিন দিন তার পরিসর বেড়েই চলেছে, স্বত:ফূর্তভাবে একুশে বইমেলার পদধ্বনি এরই মধ্যে শুনতে ও দেখতে পেয়েছি।
সময় হলো বহতা নদীর মত। প্রতি বর্ষায় তো বন্যা হয় না, কিন্তু বৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও জলমগ্ন হয়। তবে বাংলাদেশে একসময় বন্যা ছিল দুর্ভোগের হাতিয়ার। এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। তাতে লক্ষ্য করা গেছে, আগে জলপথে ব্যবসা বাণিজ্যের মালামাল সরবরাহ হতো, বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে নদীর পাড়ে। এখন কিন্তু সেরূপ আর নেই, তেমনি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় আগের মতো মহররম মিছিল হয় না, জন্মাষ্টমীর শোভা যাত্রা হয় না, জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় প্রথাগত রথ নিয়ে টানাটানি হয়, কিন্তু বিশালতা যে হারিয়ে গেছে। বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতো, তাও সীমিত হয়ে গেছে নানা কারণে। এসব কিন্তু শহর কুমিল্লার একসময় সার্বজনীনতা লাভ করেছিল। এখন এসব চর্চাগুলো অত্যন্ত সীমিত হয়ে গেছে, আন্তরিকতা হারিয়ে গেছে, নিজেদের মধ্যেও সমন্বয় রক্ষিত হচ্ছে না। এছাড়া সুইট হোম নেই, কালুর চা-স্টল নেই, জলযোগে বসবার ব্যবস্থা নেই, দেশপ্রিয় ভেঙে ফেলেছে, আমানিয়া হোটেলের সস্তা খাওয়া নেই, মোবারক বেকারির পাউরুটি নেই, নূর মিঞা বেকারি খাস্তা ও লুনতা বিস্কুট নেই, মনা ঘোষের দই নেই, গোয়ালপট্টির মাঠা ও মাখন নেই, বাতাসাপট্টির ছোট-বড় বাতাসা নেই, তামাকুপট্টিতে ঐতিহাসিক হুক্কা নেই, নেই ময়নামতির শীতল পাটি, খাদির দোকান বেড়েছে, খাঁটি খাদি কাপড় কমে যাচ্ছে, এখন কেউ আর টিনের ট্রাঙ/স্যুটকেস ব্যবহার করে না, নেই হুক্কার ব্যবহার, সেবন করা হয়না সুগন্ধি তামাক, শীতলপাটির চাহিদাও কমে গেছে। তবে লোকসংখ্যার চাহিদার প্রাবল্যে স্বর্ণের দোকান বেড়ে গেছে, ঔষধের দোকান-বেকারি-ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান-মিষ্টির দোকান বেড়ে গেছে। এ তুলনায় শহর কুমিল্লায় মানসম্পন্ন হোটেল (খাবার নয়, থাকার) গড়ে উঠেনি। সরকারিভাবে সার্কিট হাউস, সীমিতভাবে কুমিল্লা ক্লাব ছাড়া ব্যক্তি-উদ্যোগে তেমন স্থাপনা নেই। সেজন্য বার্ডের রেস্টহাউজে যাতায়াত করতে হয়। খাওয়া-দাওয়ার রেস্টুরেন্ট শপিংমলে কয়েকটি হয়েছে, তবে পূর্ব থেকে প্রস্তুতি না নিলে তাৎক্ষণিকের ব্যবস্থাপনা সাধারণ। তবে সন্ধ্যার পর কোনো কোনো এলাকায় চটপটির অস্থায়ী ভেনগাড়ি দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো রাস্তার উপর অস্থায়ী দোকানপাট। ফলে যানজট ও ছিনতাই এর ঘটনা অহরহ ঘটে থাকে।
শহর কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্র হলো কান্দিরপাড়। আর বীরচন্দ্র নগরমিলনায়তন হলো কুমিল্লা শহরের প্রতীক। সম্মুখের মাঠদ্বয়ের যেরূপ নান্দনিক পরিচর্চা হওয়া দরকার, এ ব্যাপারে দায়িত্বশীলরা উদাসীন। আসলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নির্বাচনে যদি প্রতিযোগিতা না থাকে, তবে দায়বদ্ধতা পরিদৃশ্য হয় না, কর্মপ্রবাহে স্থবিরতা চলে আসে। যোগ্য লোকের প্রাথমিক যোগ্যতা হলো প্রতিযোগিতায় প্রতিশ্রুতি প্রদানে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন। বন্ধ্যাত্ব ব্যাপারটি হলো কুক্ষিগত নেতৃত্ব এবং পেশীশক্তির দাপট। যার ফলে তখন স্বাভাবিক স্বজনশীলতার অপমৃত্যু ঘটে। জনবান্ধব প্রতিষ্ঠান যখন জনগণের ব্যাপক উপস্থিতিতে সোচ্চার না হয়, তখন সে সকল প্রতিষ্ঠান হয়ে যায় কাগুজে, অনাগ্রহের ছাড়াবাড়ি। বলতে দ্বিধা নেই-কোনো প্রতিষ্ঠানেই যোগ্য লোকের স্থান নেই। এ ক্ষেত্রে কুমিল্লা সর্বাংশে স্থবির।
বর্ষাকালে বৃষ্টিতে যখন শহর কুমিল্লা ডুবে গেল, যাদের বাড়িঘর তলিয়ে গেলো, তাদের পাশে প্রথাগত দায়িত্ববানদের উপস্থিতি দেখা গেলো না। কোনো মন্তব্যও শোনা গেল না, প্রতিশ্রুতি তো আগেই তলিয়ে গেছে। পথহারা মেয়র কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। এমনটি আমার শহর ‘কুমিল্লা’য় কখনও ছিল না। আসলে জবাবদিহিতা না থাকলে অশুভ শক্তির উত্থান ঘটে, যার পরিণতি ভয়াবহ। আমার এরূপ মূল্যায়নে কেউ কেউ মনে ক্ষোভ পোষণ করতে পারেন, তবে বিবেকের কাছে প্রশ্ন করলে নিশ্চয়ই উত্তর পেয়ে যাবেন। চুপ করে থাকা, অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ না করার অর্থ মেনে নেওয়া নয়। ক্ষোভকে পোষা। নীরব থাকা কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদ। শহর কুমিল্লা ডুবলে কিন্তু বাংলাদেশ ডুববে না। আবার বাংলাদেশ যখন অগ্রগতির শিখরে উন্নত হবে, কুমিল্লা কিন্তু পিছিয়ে থাকবে না। এসব ফাউ কথা দিয়ে শিশুকে ভোলানো যায়, বুদ্ধিমানরা হাসে।
আমার শহর ‘কুমিল্লা’ শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান্ধব ও উদারচেতনাবাহী শহর। আদর্শ যাপনে ভিন্নতা থাকলেও অন্তর্গত সখ্যতার একটি সরল মেলবন্ধন আছে, এটাই শহরবাসীর ঐক্যসূত্র। কিন্তু জনপ্রতিনিধিত্বে এ উদারতা নিরাশজনক। সেজন্য কারও কারও মুখে উচ্চারিত হয়, আগেই ভালো ছিলাম, পৌরসভাই ভালো ছিল, আগের রাস্তাঘাট ও নর্দমাই ভালো ছিল, পুকুরগুলো থাকলে জলাধারের ঘাটতি হতো না, গলাকাটা করের বোঝা বহন করতে হতো না। এসব প্রশ্নগুলোর উত্তর অবশ্যই খুঁজতে হবে। এসব কথা অন্তর থেকে ধিক্কা দেওয়ার সামিল। জনবান্ধব হতে হলে জনসমর্থন চাই, পেশী শক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষা করা যায়, জনগণের উপকার করা যায় না। বরং মানবিক মূল্যবোধ ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। তখনই চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়। একদিন না একদিন মানুষ তাদের আপন লোককে খুঁজে নিবে। তার কাছে জবাবও চাইবে, উত্তরও পাবে।
ক্রমশ
লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক ও সাবেক অধ্যাপক
মোবাইল: ০১৭১১-৩৪১৭৩৫