ফোনে আড়িপাতা রোধে রিটের আদেশ রোববার
Published : Tuesday, 14 September, 2021 at 12:00 AM
ফোনে আড়িপাতা রোধে ও ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট আবেদনের আদেশ রোববার।
সোমবার সব পক্ষের শুনানি শেষে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ আদেশের জন্য এদিন রাখে।
আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন- বিটিআরসির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব।
গত ১০ আগস্ট আড়িপাতা রোধে ও ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী।
এর আগে গত ২২ জুন ফোনালাপে আড়িপাতা প্রতিরোধে আইন অনুযায়ী গৃহীত পদক্ষেপ জানতে চেয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিস দেন তারা। সেটির জবাব না পাওয়ায় তারা আবেদনটি করেছেন বলে উল্লেখ করেন।
সব পক্ষের শুনানির পর বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “কেউ যদি ফোনে আড়িপাতে, কেউ যদি রেকর্ড করে এটা চিহ্নিত করার বিষয় আছে। তৃতীয় পক্ষ যদি কেউ রেকর্ড করে বিভিন্ন মিডিয়ায় দেয়, আর মিডিয়া যদি সেটা প্রচার করে, এক্ষেত্রে কিন্তু মিডিয়ারও একটা ভূমিকা আছে।”
সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, “রিসেন্টলি আমি একটা মিডিয়ার প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছু কিছু রিপোর্টিংয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। এ রিপোর্টগুলো এত বেশি হাইলাইট করে প্রচার করার কী অছে, জানতে চাইলাম।
“শেষমেশ উনাদের কাছ (সাংবাদিকদের) থেকে যে বক্তব্যটা পেলাম সেটা হল, কিছু ?কিছু খবর প্রচার হওয়ার পর যখন তারা (গণমাধ্যম) এটা (প্রচারিত খবর) ফেইসবুক বা ইউটিউবে দেয় তখন এটাতে লাইক পড়ে, শেয়ার হয়।এতে নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা আয় হয়।”
এই বিচারপতি বলেন, এ বিষয়টা কিন্তু অনেক সময় এ ধরনের নিউজগুলো (অডিও-ভিডিও ফাঁসের) প্রচারের পিছনে কাজ করে। আজকাল নানা ধরনের টিভি হয়েছে, এসবের লাইসেন্সও নাই, ঘরে ঘরে অনলাইন টিভি।
“এই সমস্যাগুলো কিন্তু আছে। যখন এ ধরনের নিউজ মিডিয়ায় পাবলিকলি চলে যায় তখন কিন্তু এসব ব্যক্তিকে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিন্তু কারা করে এটা আমরা জানি না। দুই পক্ষের এক পক্ষ করেও দিতে পারে, তৃতীয়পক্ষ করতে পারে। তৃতীয় পক্ষের কী লাভ, আমার মনে হয় বিটিআরসির এটা দেখা দরকার।”
অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের জবাবে এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে আড়িপাতা যেমন ঠিক না, তেমনি মিডিয়া সগৌরবে যেভাবে প্রচার করে এটাও কিন্তু ঠিক না। রিসেন্টলি জাপানি এক নারী, আরও অনেকে হাই কোর্টে আসেন বিটিআরসিকে নির্দেশ দিতে কন্টেন্টগুলো অপসারন করতে। জাপানি মহিলা এখন কোথাও গেলে রাস্তায় তাকিয়ে থাকে।
“প্রশ্ন হচ্ছে এগুলো যখন মিডিয়ায় চলে যায়, দুইদিন তিনদিন ধরে চলে তখন আর এটাৃ.. এসব বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকা দরকার। আমরা এ বিষয়ে আরও আইন দেখি। রোববার আদেশের জন্য রাখলাম।”
এর আগে শুনানির শুরুতে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে যে কোনো নাগরিকের ফোনালাপ রেকর্ড করার সুযোগ আছে। এটা নিয়ে আমাদের কোনো কথা নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃংখলা রক্ষায় ফোনালাপ রেকর্ড করুক তাতে আপত্তি নেই।
“কিন্তু যে কোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড ও ফাঁস করার আইনগত অধিকার কারও নেই। আমাদের বক্তব্য এখানেই। সংবিধান অনুযায়ী ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষায় বিটিআরসিকে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের বক্তব্য বিটিআরসি আইনের ৩০(চ) ধারা অনুযায়ী ফোনালাপ ফাঁস হবার আগেই বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মধ্যে ফোনালাপসহ যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে সেগুলোর কিছু নজির তুলে ধরে এই আইনজীবী বলেন, “এটা ফাঁস হবার আগেই বিটিআরসি ব্যবস্থা নিতে পারত, এখনও পারে। কারণ মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ, তদারক করার আইনগত ব্যবস্থা বিটিআরসির আছে। সেই ব্যবস্থায় ফোনালাপ ফাঁসও বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে বিটিআরসি।
“এ কারণে ফোনালাপ ফাঁস বন্ধে রুল জারির আবেদন করছি। একই সঙ্গে যেসব ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে, সেসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে বিটিআরসি যেন তদন্ত করে সেই নির্দেশনা চাচ্ছি।”
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানিতে বলেন, যারা রিট আবেদনটি করেছেন, তারা আইনজীবী। তারা নিজেরা ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এ কারণে তাদের এই রিট আবেদন করার আইনগত এখতিয়ার নেই।
“কারও ফোনালাপ ফাঁস হলে তিনি বিটিআরসি আইন অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আইনেই মামলা করতে পারেন। ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে। প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দিষ্ট আইন থাকায় জনস্বার্থে রিট আবেদন করার সুযোগ নেই। তাছাড়া যাদের ফোনলাপ ফাঁস হয়েছে তাদের কেউ এসে কিন্তু রিট আবেদনটি করেননি।”
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, “কেউ কি বিটিআরসি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গিয়ে বলেছে যে, তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন হচ্ছে বা এ ধরনের অভিযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে কি কেউ ব্যর্থ হয়েছেন? এর কম হলে সে আসতে পারে।”
জাবাবে শিশির মনির বলেন, দেশে আইনের শাসন রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য একজন আইনজীবী আইনি কাঠামোর মধ্যে সব করতে পারে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনে যখন একজন আইনজীবী শপথ নেন, এই শপথ অনুযায়ী একজন আইনজীবী দেশের স্বার্থে রিট আবেদন করতে পারেন।
“এই রিট আবেদন করার আগে বিটিআরসিসহ সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এ কারণে আবেদন করা হয়েছে।”
বিটিআরসির আইনজীবী খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, আইনে যদি প্রতিকারের সুযোগ না থাকত তবে সংবিধান অনুযায়ী এই রিট আবেদন করার সুযোগ আছে। যেহেতু আইনে সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, তাই রিট আবেদন করার সুযোগ নেই।”
এসময় তিনি ফেইসবুক ও ইউটিউব থেকে বিভিন্ন কন্টেন্ট সরানোর বিষয়ে বিটিআরসির সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, অন্য একটি বেঞ্চ (হাইকোর্ট) ফেইসবুক ও ইউটিউব থেকে কন্টেন্ট সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আপিল বিভাগ থেকেও প্রধান বিচারপতি এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলেন। এরমধ্যে প্রধান বিচারপতি সংক্রান্ত পোস্টটি সরানো গেছে। বাকিগুলো আমরা কিছু করতে পারিনি।
“সেখানে আমাদের হাত নেই। আপত্তিকর কিছু সরানোর বিষয়ে আমাদের কারও সক্ষমতা নেই। ফেইসবুক বা ইউটিউব কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হয়। তাদের বলতে হয়। এরপর তারা যদি সরাতে চায় তবেই কেবল সেটা সম্ভব। এখানে বিটিআরসি নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না।”
গত ১০ অগাস্ট করা আবেদনটি গত ১৬ আগস্ট শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন এ আবেদনে শুনানি করবেন জানিয়ে ওইদিন রাষ্ট্রপক্ষ সময় চাইলে আদালত রিটের শুনানি দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেয়।
আবেদনে ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত ২০টি আড়িপাতার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ফোনালাপ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনালাপ, প্রয়াত জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ ও রাজশাহী মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসানের ফোনালাপ, ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ, মামুনুল হকের ফোনালাপ, যশোর-৬ আসনের সাংসদ শাহীন চাকলাদারের ফোনালাপ, ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের ফোনালাপ, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের ফোনালাপ রয়েছে।
রিটে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে বিবাদী করা হয়েছে।