ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক ও সূধীজনদের সাথে বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম রুজীর যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ
Published : Wednesday, 13 October, 2021 at 12:00 AM
এবিএম আতিকুর রহমান বাশার ঃ
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাবে সাংবাদিক ও সূধীজনদের সাথে বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম রুজীর (৬৯) উপস্থিতিতে যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ নিয়ে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
দেবীদ্বার উপজেলা প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা, লেখক, কলামিষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক সাংবাদিক এবিএম আতিকুর রহমান বাশারের উপাস্থাপনায় মতবিনিময়কালে বীর গেরিলা মুক্তিযাদ্ধা মমতাজ বেগম রুজী যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে কেঁেদ ফেললেন। তিনি ক্ষোভের সাথে বললেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি এমন একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নয়, যে দেশের ধনী- গরিবের ব্যবধান আকাশ-পাতালসম, বেকারের অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বিপদগামী হচ্ছে লক্ষ লক্ষ যুব-তরুণ, শ্রমিক তার ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেনা। দুই অঞ্চলের মানুষের সেতুবন্ধনে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ হয়, আর সেই পদ্মাসেতুর বিরুধিতায় রয়েছে একদল মানুষ। এ বৈশি^ক মহামারীতে প্রধানমন্ত্রী কর্মহীন ও অসহায়াদের খাদ্য সহ নানা সামগ্রী সহায়তা দেন, আর সে সাহায্য- সহায়তা ভোক্তাদের ভাগ্যে জুটেনা, লুটেরা গোষ্ঠী তা চুরি ও লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধদিনের স্মৃতি যদি এদেশের মানুষের হৃদয়ঙ্গম হত, তাহলে এমন দৃশ্য আমাদের দেখতে হতনা। তিনি যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে যেয়ে বলেন, আমরা মার্চ মাসের শুরু থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। আমি তখন ঢাকা গভ: গার্লস কলেজে (বর্তমান বদরুন্নেছা কলেজে) ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সাথে আমরাও ডেমি বন্দুক নিয়ে রাজপথে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম, আমাদের এসব প্রশিক্ষণ, বক্তৃতা- সমাবেশ ছিল সাধারন মানুষকে জাগ্রত করা।
২৫ মার্চের আগে কি ঘটতে যাচ্ছে, কি হবে, তার আতঙ্ক আমাদের সবাইকে তাড়া করছিল। কিন্তু ২৫শে মার্চের কালো রাতে এমন নির্মমতা প্রত্যক্ষ করতে হবে তা কখনো ভাবিনি। সেই কালো রাত্রীতে পাকসেনাদের নির্মম, হৃদয় বিদারক, লোমহর্ষক, হত্যাযজ্ঞে যে তান্ডব চালিয়েছিল তা স্বচুক্ষে দেখেছি। শুধু গুলির আওয়াজ আর মানুষের আর্তনাদ শোনেছি। কি ঘটতেছে তাও বুঝতে পারছিনা। পরদিন ২ ঘন্টার জন্য কারফিউ তুলে দিলে, ওই সময়টাতে আমি ও আমার ছোট ভাই হোসেন হায়দার হিরু (ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন’র ১৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার ছিল), দুই ভাই বোন ছাত্র ইউনিয়ন করতাম।) ছুটে গেলাম চিপা গলি ধরে নীলক্ষেত এলাকা দিয়ে জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে। গিয়ে দেখি এক নিদারুন লোমহর্ষক দৃশ্য, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে আগুনের লেলিহান শিখা তখনো প্রজ্জলিত ছিল, নেভানোর কেউ ছিলনা, যাবার পথে তখনো কিছু মানুষের আর্তনাদ আর গোঙ্গানী শুনতে পাচ্ছিলাম, কিছুই করার ছিলনা, পথিমধ্যে একজনকে রিক্সার উপর বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই। জঘন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রাবাসে যেয়ে দেখি, ওখানে শুধু লাশ আর লাশ, বাতরোমে একের উপর এক লাশ পড়ে আছে, তাদের গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করেছে। কারোর চোখ বেড়িয়ে আছে, কারোর মুখমন্ডল বিকৃত। রোকেয়া হল, সামসুন্নাহার হলের অসংখ্য ছাত্রীকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে গেছে তাদের ক্যান্টনমেন্টে। এ দৃশ্যগুলো আমাকে এক মাস পিড়া দিয়েছিল। এসব বিভৎস ঘটনার কথা কেউ লিখেছে কিনা জানিনা। তবে মাঝে মাঝে বিশেষ দিনে পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে,- রোকেয়া আপার নেতৃত্বে ডেমি রাইফেল নিয়ে কোচকাওয়াজ ও প্রশিক্ষণ মহড়ার ছবিটি আর নীলক্ষেত এলাকায় একজন রিক্সার উপর বুকে গুলিবিদ্ধ সেই রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা শহীদের ছবিটি ঘুরে ফিরে দেখা যায়। রোকেয়া আপার নেতৃত্বে ডেমি বন্দুক নিয়ে প্রশিক্ষণ মহড়াটির তৃতীয় সারির (বামে) তৃতীয় ব্যক্তিটি ছিলাম আমি, আমার পেছনের জন বর্তমান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম’র ছোট বোন নাজনীন সুলতানা নিনার।
আলোচনার এক পর্যায়ে আগামী বাংলাদেশটি কেমন প্রত্যাশা করেন ? জানতে চাইলে তিনি জানান, ধনী-গরিবের বৈষম্যের ব্যবধান কমিয়ে আনা, শ্রমজীবী ও বেকারদের কর্মসংস্থান, শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়াসহ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, উপযুক্ত বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা, মানবিক চিকিৎসা, কুসংস্কারমুক্ত সংস্কৃতি বাস্তবায়ন করা।  
এসময় উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলফু ফকির, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট নাজমা বেগম, প্রইভেট হাসপাতাল এন্ড ডায়গনেষ্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক ভিপি ময়নাল হোসেন, সিনিয়র সহ-সভাপতি, মোঃ সফিকুল ইসলাম,  ড্রাগ এনাড ক্যামিষ্ট সমিতির সাধারন সম্পাদক আব্দুল খালেক বাবুল সরকার, সাংবাদিক  এম, জে, এ মামুন, মোঃ মামুনুর রশীদ, মোঃ সোহেল রানা, আল আমিন কিবরিয়া, শাহ্ সবুর, আব্দুল্লাহ আল মামুন, কাজী সাগর প্রমুখ।
মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াকু এ বীর সেনানী মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম রুজী, তিনি দেবীদ্বার উপজেলার সুবিল ইউনিয়নের উত্তর রাঘবপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত কাষ্টমস কর্মকর্তা মরহুম হাজী আব্দুল হালিম’র সুযোগ্য কণ্যা।
তবে পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার দেবীদ্বারে হলেও স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ঢাকা ধানমন্ডির ভূতেরগলীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং তার স্বামীর বাড়ি ঢাকা হাতিরপুল এলিফেন্টরোডে।
স্বামী টিএনটি বোর্ড’র ইঞ্জিনিয়ারিং সুপারভাইজর ও সিবিএ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ কুতুবুর রহমান। মমতাজ বেগম রুজী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ফিলোসুফিতে অনার্স এবং ডিপ্লমা ইন এডুকেশনে মাষ্টার্স ডিগ্রী লাভ করে জাতীয় খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী উপ- পরিচালক পদে চাকুরি শেষে বর্তমানে অবসরে আছেন। ১৯৭৫ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর সংসার জীবনে তিনি এক পুত্র সন্তানের জননী। পুত্র সাঈদ মাহাদীন আকরাম উচ্চ শিক্ষা শেষে বর্তমানে ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন।
রত্নগভা মায়ের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম ৩ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সকল ভাই বোন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন এবং সবাই ছাত্র ইউনিয়ন’র নেতা-কর্মী ছিলেন। ৩ ভাই সাবেক ঢাকা আইডিয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম ভিপি মরহুম রুহুল আমিন কালন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন’র ১৬নং ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার মরহুম হোসেন হায়দার হিরু ও আমেরিকা নর্থকেরোলিনা ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড. এবিএম নাছির। বাকী ৩ বোন জাহাঙ্গীর নগর বিশ^ বিদ্যালয়ের (অবঃ) অধ্যাপক রোকেয়া বেগম রুবি, পানি উন্নয়ন বোডের কর্মকর্তা তাহমিনা বেগম জলি, আমেরিকায় কর্মরত কুহীনূর বেগম ডেইজি।