লাশের যাপনচিত্র
মো. আরিফুল হাসান
হেমন্তলোক থেকে যাপনলোকে
সে সহজেই পৌঁছুয়। তারপর আবার পেছন ফিরে চায়। ফেলে আসা পথে তার মায়া লেগে
থাকে। পথের রোশনাই তার চোখেমুখে ঝিকিমিকি করে। সে স্তব্ধ হয়ে ক্ষাণিক্ষণ
দাঁড়ায়। তারপর আবার পথ চলতে থাকে। না, থামলে চলবে না। এ যাত্রা তার
দূরপরবর্তী যাত্রা। এ যাত্রা তার চোখের বাঁধন। যেতে যেতে সে কতকিছু তুলে
নিতে চায়। কতকিছুতে হাত লাগায়, ছুঁয়ে দেয়। আবার হাত সরিয়েও নেয়। না, এ
যাত্রা তার কোনকিছু নেবার নয়। এ যাত্রা তার দেবারও নয়। মন কাঁদে, কত অভাব
অভিযোগ দেখে তার চোখ ভিজে আসে। সে নীরবে চোখ মুছে। পথের দূরত্ব তাকে
দুঃখবোধের বেদনা হতে নিষ্কৃতি দেয়। সে আবারও পথ চলে। পথ চলতে থাকে এঁকেবেকে
তার সাথে। গ্রামের পরেই মাঠ। সেখান থেকে আরেকটু এগুলে জলা। সেখানে শীত
থাকে। আর তার ওপাড়ে আছে বসন্ত। আপাতত মাঠের এই যাপনচিত্রটাকে সে অতিক্রম
করে। দুপুরের রোদ তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে যায়। এক পশলা সবুজ বাতাস তাকে দোল
দিয়ে আবার কোথায় মিলিয়ে যায়! সব মিলে সুন্দর এক যাত্রাপথে তার কেবল
গ্রামের কথা ভাসে। গ্রামে কে আছে তার? মেয়েটির নাম লুৎফা। বড় অভাবী
পরিবারের মেয়ে। কোনো রকমে খেয়ে পড়ে মানুষ। শিক্ষা কি জিনিস সে জানে না। ফলে
ভালোবাসার কোনো ছকে বাঁধা সংজ্ঞা তার জানা নেই। তবে যেটুকু আছে, সেটুকু
হৃদয় নিংড়ানো উজার করা প্রেম। সেখানে খামখেয়ালি থাকতে পারে, তবে তাতে
প্রতারণা নেই। সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তবে তাতে কপটতা নেই। এ কথাটি
জানা। তবু তাকে ফেলে যেতে হয় অনিবার্য কারণে। আর এই ছেড়ে যাওয়া পথটিই
দীর্ঘতর হয়ে যায় বিস্তীর্ণ বিষাদের মতো। যে চিত্রটি যাপনের, তখন তা শুধু
একটি লাশের শবযাত্রার অনুকূল। এখান থেকে পেছনে ফিরলে সে লুৎফাকে হয়তো পেতে
পারে। আবার নাও পেতে পারে সে। লুৎফা হতে পারে গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে, লুৎফা
হতে পারে রূপচর্চার প্রসাধনহীন সাধারণ সুন্দর। কিন্তু তার মনের ভেতর যে
ঐশ্বর্য, সেখানে পরাজিত না হয়ে পারা যায় না। আপনি ডুবে যায় তরী। কূল-তীর
হারা গহীন গহনে ডুবতে ডুবতে তল পায় না শেষমেশ। তাই লুৎফাকে নিয়ে যত সহজভাবে
ভাবার অবকাশ আছে, আছে ততটাই জটিলতা তাকে না পাবার। গ্রামের মন, একবার যদি
না করে দেয় তাকে আর হ্যাঁ বলানোর সাধ্য আছে কার? সুতরাং দ্বিধায় পথ
দ্বিধাবিভক্ত হতে থাকে। পথ ফুরোলো না। রথ ফুরোলো না। দুপুরের সূর্যটা আগের
মতোই চলতে থাকে। মাথার উপর ছায়া ফেলে ফেলে চলতে থাকে একটুকরো মেঘ। মেঘটিকে
লুৎফা মনে হয়। না হলে এই হেমন্তের নভে, যাপনের মাঠে আসার সঙ্গ কি সে এমনি
এমনি দিচ্ছে। মেঘটিকে মনে হয় জ্বরেরঘোরে লুৎফার হাতের জলপট্টি। আর রোদটাকে
মনে হয় লুৎফার উষ্ণ আলিঙ্গন। পথ অনেক দূরে। এভাবে চলতে চলতে সন্ধ্যা হয়ে
যাবে একসময়। এই তো, অদূরেই তো জলাশয়। কিন্তু অদূরে নয়। যেতে যেতে পথের
হিসেব যখন ধূলিকণা হয়, তখন এক কদমেও কয়েকশো প্রয়াস থাকে। বিশেষ করে মন যখন
দ্বিধার চলক, তখন তো মন বলে চলো না, আর্ দ্বিধাবিভক্ত পাগুলো সরে যায় সামনে
অথবা পিছে, বিপরিত গোলার্ধের অন্তরালে। তবু পথ যেতে হবে। এ পথ যে বিশাল।
সবে মাত্র যাপনলোকের প্রস্তর শুরু হয়েছে। তারপর আছে মিহিদানার প্রান্তর।
এখানে মিহিদানার প্রান্তরে মানুষ শষ্য চাষ করে। এখনও চাষের কার্যক্রম চলছে।
তবে হেমন্তচিত্রটি এখন আর মাঠে নেই। মাঠের হেমন্তের ফসল এখন কৃষকের ঘরে
ঘরে জ্বলন্ত আগুনে সুস্বাধু হচ্ছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। অথবা তারা মহাজনের
গদিতে জমা হচ্ছে আগত কোনো দুর্ভিক্ষের জন্য। কিংবা এমনিতেই জমা করছে
মহাজনা। হয়তো বদমতলব আছে। হয়তো তারা দাম বাড়লে চড়া দামে বিক্রি করবে সেসব।
তবে মাঠে যে হেমন্ত শষ্যের কোনো চিহ্ন নেই এ বিষয়টি নিশ্চিত। দুটো হাল দেয়া
শুকনো খরখরে মাটিগুলো যুবতীর প্রতিক্ষিত জরায়ুর মতো উন্মুখ হয়ে আছে নতুন
বীজ গ্রহণ করতে। ক্ষেতের আলপথ ঘাসে ঢাকা। ঘাসের চাদরে পথ আটকে যায় পায়ে
পায়ে। আলের দু পাশের জমিগুলোতে জৈষ্ঠ্যে যে ধান বুনা হয় তা হেমন্তে আসে।
বর্ষার দিনে এ ধানগাছগুলো জলে ডুবে বেঁচে থাকে। জল সাঁতরে ভেসে থাকে। জল
ফড়িঙেরা ধান গাছের পাতায় পাতায় উড়ে বেড়ায়। ইঁদুরেরা বাসা বানায় এসে
ধানক্ষেতে। কৃষক জাল পাতে ধান গাছ ফাঁক করে। মেনি, টেংরা পুটি শিং, কখনো
কখনো গজারটাও লেগে থাকে জালে। জাল তুলে এনে কৃষকেরা মাছ দেখিয়ে নতুন বৌয়ের
হাসিমুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করে। বধুয়ারা মাছ কুটতে বসে যায়। কৃষকেরা জল
খাবার খেয়ে আবার ছুটে ক্ষেতে। মাঠের ইঁদুর তাড়াতে হবে। না হলে আমন ধান
রক্ষা করা কঠিন। আমন ধানের চারাগুলো জলের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
কখনো কখনো দশ ফুট বারো ফুট পর্যন্ত হয়ে যায়। জল চলে গেলে ধানগাছগুলো বিছিয়ে
পড়ে থাকে মাটিতে। কিছু দিনের মধ্যেই মোচার মতো শীষ আসে সারামাঠ হেসে।
ধানের স্বপ্নে কৃষকের ঘুম চলে যায়। মোচা থেকে ধানফুল ফুটটে থাকে। ফুলগুলো
দুধ হয়ে ধানের ভেতরে ঠাঁই নেই। তারপর পাকা ধানের সুবাসে কার্তিক অগ্রহায়ণ
হেসে উঠে গোলায় গোলায়। নবান্ন উৎসবে মেতে উঠে চিরায়ত গ্রামবাংলা। হেমন্ত
উৎসব শেষ। এখন একটি যাপনের ভেতর দিয়ে শীতের ভেতর প্রত্যক্ষণ করা ছাড়া আর
গতি নেই। কিন্তু ফিরে যাবারও কোনো জো নেই পেছনের দিকে। যদিও পেছন থেকে
লুৎফার হাতছানি। যদিও পেছন থেকে নবান্নের প্রাণের উৎসব, কিন্তু কোনো উপায়
নেই। যাপন পথের নিজের ভেরতটাকে দুচালকে রেখে জীবনের কাটা ঘোরানো সম্ভব নয়।
এমনি অবশ্যম্ভাবী যাত্রায় যদি মন কাঁদে তবু সে ফিরে আসতে পারে না। এ লোকটা
শেষ হলেই শীতলোক। সেখানে লুৎফার বুনা সুয়েটারের মতো উষ্ণতা দরকার হয়। শীত
নিবারণের জন্য চাই এক মালশা আগুন। যা লুৎফা রান্নার পর যত্ন করে তুলে রাখে
রাতের হীমের বিপরিতে। আরও দরকার হয় পান করার জন্য উষ্ণ পানিয়। যা কেবল
লুৎফার কমলার কোয়ার মতো দু ঠোঁটেই পাওয়া যায়। এতকিছু ছেড়েও সে হেমন্তলোক
থেকে যাপনলোকে এসে পৌঁছে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে আসতে হয়। আসতে বাধ্য
করা হয়। লুৎফা যে গরিব ঘরের মেয়ে। কোনো ধনকুবেরের চোখে সে যদি পড়ে তবে আর
তাকে তার প্রেমিক কখনো ফিরে পায় কি? লুৎফার বাবা বিয়ে দিতে প্রস্তুত।
কিন্তু লুৎফা মন থেকে ভালোবাসাকে মুছে ফেলতে পারে না। প্রস্তাব করে তাকে
নিয়ে পালিয়ে যেতে। শেষদিন, সে পায়ে পড়ে কাঁদে। এই বিরহের চেয়ে মৃত্যু অনেক
সহজ জানায়। কিন্তু লুৎফাকে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে
লুৎফাও অভিমান করে বিয়েতে রাজি হয়। জানা আছে, আবার যদি সে লুৎফার হাত ধরে,
যদি বলে নিতে এসেছি, তাহলে লুৎফা বিবাহবাসর থেকে উঠে চলে আসবে। কিন্তু এ
কথা বলতে সায় দেয় না মন। মনে হয়, বড় ঘরে লুৎফা নিশ্চয়ই সুখেই থাকবে। পথ
চলতে চলতে একদিন পথ ফুরায়। যাপন লোকের শেষ সীমানার কাছাকাছি এসে একটি সাপ
মুখোমুখি হয় তার। সামনেই জলা। ভেবেছিলো জল থেকে কোনো ঢোঁড়া সাপ হয়তো উঠে
এসেছে। কিন্তু ফণা তুলতেই দেখা গেলো তার মস্তকে বিষচক্রের ত্রিশূল। সাপটি
ডানে বাঁয়ে দুলতে লাগলো বিপদজনক ভাবে। সামনের দিকে ঝুঁকে ছোবল মারতে থাকলো
হিসহিস করতে করতে। সাপটিকে হয়তো এড়ানো যেতে। কিংবা আঘাতে আঘাতে সাপটিকে
হত্যা করা যেতো। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হলো যে সাপটিকে সে পোষ মানাতে চায়। ঠিক
একই রকম মনে হয়েছিলো লুৎফাকে যখন প্রথম দেখেছে সে। লুৎফাও পোষ মেনেছে।
বুকের গহীণে লুকিয়ে রয়েছে দুরন্ত সর্পিণী। কিন্তু কখনো তাকে ছোবল মারেনি।
একবার মনে হলো, লুৎফা তো মানুষ, রক্তমাংসের গড়া আমারই মতো মানুষ, মানুষকে
আদর করে বুকে রাখা যায়। তা বলে সত্যিকারের সাপকে কি পোষ মানানো উচিত? সমস্ত
প্রশ্ন এবং দ্বিধার দেয়াল ভেদ করে সে আরেকটু এগিয়ে যায় সাপটির দিকে।
কোনোকিছু চিন্তা না করে খপ করে ধরে ফেলে সাপটির ফনা। ফনাবদ্ধ সাপটি তার
হাতের মধ্যে পেঁচিয়ে যায়। বাঁ হাতে প্যাঁচ খুলে সে সাপটিকে ছেড়ে দেয় জামার
ভেতরে নিজের বুকের মধ্যে। সমান্তরাল দুটো বিষবিন্দু হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি
মৃত্যুঘুম ছড়াতে থাকে। ঠিক তখনই বিবাহের আসরে বিষপান করে আত্মহত্যা করে
লুৎফা।
মো. আরিফুল হাসান কুমিল্লা, বাংলাদেশ ০১৭৬৩৭১৩৫৪
দ্বিতীয়
সাহিত্য সমালোচনা
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর
২.
কখনো সমালোচক লেখকের চেয়ে অধিক পরিচিত। সামনের সারির। তাঁর বিচার, তাঁর
মন্তব্য অপরের আলোচ্য বিষয়। তিনি কী বলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি
পণ্ডিত ব্যক্তি । না হলে আলোচ্য বিষয়ে পারঙ্গম।
লেখক অসহায়। লেখা শেষ
হওয়ার পর লেখকের আর কোন কাজ নেই। এবার তিনি অন্যের মুখের ঝাল খাবেন, মধু
খাবেন অথবা চাতক হয়ে বরিষণের অপেক্ষায় থাকবনে, চেয়ে চেয়ে দিন গুজরান
করবেন। তিনি লেখক একটি কম্পমান হৃদয় নিয়ে অথবা স্থির হৃদয় নিয়ে দন্ডায়মান ,
অথবা মনের অতলে শায়ীত।
আলোচনা শেষে লেখকের দায় মুক্তির পরিসর খুব বড়
নয়। বলা যায় লেখার শেষে তার বিষয়- বস্তুর দ্বন্ধময় পরিস্থিতির ঢাকঢোল থেকে
উত্থিত বা নিঃসৃত ধনুর্বাণ শব্দের বাসিন্দা তিনি। আসলে কী ধনুর্বাণ
যুদ্ধ(?) কখনো হয়! সভ্য পাঠক হয় বলে জানে। নাম তার সাহিত্যের কাজিয়া বা
ঝগড়া। আমরা বলছি সমালোচানার কথা। ঐ কাজিয়াতেও সমালোচনা থাকে। কাজিয়া হলো মত
ও পথের ভিন্নতায় বিষময় সমালোচনা। তবে তা থেকেও অমৃত জন্ম নিয়েছে কখনো
সখনো। মত ও পথের ভিন্নতার ভিন্ন ভিন্ন কারণ থাকে। বিশ^ ব্যবস্থা তার
নিরপেক্ষতা হারিয়েছে (কোন কালে নিরপেক্ষ ছিল কি?)। বাজার ব্যবস্থা বা
ব্যবস্থার বাজার সব কিছুতে প্রভাব ফেলেছে। নীতি হয়েছে আপেক্ষিক, কখনো
অনৈতিক। তৈরি করা বস্তবতায় আমাদের বাস। প্রকৃতি বা স্বাভাবিক ভ্রুণর জন্ম
বৃদ্ধি শৈশব কৈশোর যৌবন বৃদ্ধ মৃত্যু ঘাটে ঘাটে নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন।
লেখক সমালোচক উভয় এই জারনে জারিত দ্রবীভূত। এ অবস্থায় লেখক ঘরে বসে থাকবেন।
অথবা এসে অনুযোগের সুরে বলবেন, আপনারা যা বলছেন আমি তা বলতে চায়নি। আপনারা
এর অপব্যাখ্যা করছেন। এমনটি বলার সুযোগও নেই। লেখকের মুখ বন্ধ। তিনি বলে
ফেলেছেন। বলেছেন বিস্তর। সত্য মিথ্যা সব বলেছেন। বস্তু থেকে বলেছেন। অবস্তু
থেকে বলেছেন। বলতে গিয়ে মাটি ও প্রকৃতি থেকে নিয়েছেন। আকাশ ও চিদাকাশ থেকে
নিয়েছেন। মরু থেকে নিয়েছেন। বরফ থেকে নিয়েছন। তাঁর ভূগোল থেকে নিয়েছেন।
তিনি যে মিলাবে মিলবে দেশের বাসিন্দা। তারপর তিনি তাঁর কর্মকে সাহিত্য দাবি
করছেন। সমালোচক বিচার করতে বসেছেন। বিচারকের রায় মাথা পেতে নিতে হবে।
বিচারক ঈশ^র। লেখকের দণ্ড (?) ঘোষণা করবেন বিচারক। কী ভয়ানক অবস্থা। অথচ
লেখক বাঁচতে চায়। ইহদেহে বাঁচতে চায়। আরও সরল কথা, তাঁর সাহিত্যে বাঁচতে
চায়। এই আকুতি তিনি প্রকাশ করে বসে আছেন। শুনতে দরিদ্রের মত শুনায়। কিন্তু
তিনি করেছেন মহৎ কাজ। কারণ তার লেখায় তাঁর সাহিত্যে তিনি নিজের কথার সঙ্গে
অন্যের কথাও বলেছেন। কবিতা হলে বিশ^ মানুষের কথা বলেছেন। ব্যক্তি থেকে
সমষ্টির কথায় ডুবেছেন। আরোহণ করেছেন, অবরোহণ করেছেন, থিসিস এন্টি থিসিস
সিনথিসিস করেছেন অথবা করেছেন সংশ্লেষণ অথবা বিশ্লেষন অথবা দ্বৈরাজ্য অথবা
নৈরাজ্য অথবা স্বরাজ্য যা ইচ্ছা তিনি তাই করেছেন সুতরাং তাঁর আকুতি
(সাহিত্যে বাঁচতে চাই) অন্যায্য নয়। কিন্তু পণ্ডিত সমালোচক এখন তাকে কী
বলবেন, সেই অপেক্ষায় তিনি (লেখক) অপেক্ষমান বা কম্পমান। কম্পমান কেন?
হৃদয় কাঁপতে ভালোবাসে। নিজের জন্য এবং অন্যের জন্যও। কম্প বন্ধ হলে সবশেষ।
কিন্তু এই কম্প যে ভয়ের। সমালোচক পণ্ডিত ঈশ^র কম্পমান লেখকের মুখের দিকে
তাকালেন। তিনি লেখকের কপাল পাঠ করলেন। সেখানে লেখাঃ আমার লেখা (সাহিত্য) না
থাকলে আপনার অস্তিত্ব থাকে না। সমালোচক চোখ বন্ধ করলেন। তিনি ভাবলেন, এমন
গুহ্য কথা জনান্তিকে প্রকাশ করা ঠিক হবে না। কিন্তু তিনি যে সমালোচনার দায়
নিয়েছেন। বলতে তাকে হবেই।
এই যখন অবস্থা তখন সমালোচক কী বলে বা এ
পর্যন্ত কী কী বলে এসেছে আমরা দেখে নিতে পারি (বলার ইতিহাস)। তিনি বলেন, এই
লেখক কালের হয়েও আগামীর। তিনি ইতিহসের। তিনি এখানকার মাটি ও মানুষের কথা
বলেছেন। তিনি হৃদয় স্পর্শ করে গেছেন। তিনি চিন্তাকে (মগজ বা জ্ঞান) উতলে
দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। ওনার সাহিত্যে রস আছে তিনি রাজনীতি সচেতন বা রাজনীতিকে
এড়িয়ে চলেন, আরও বলেন, তাঁর নিজের একটা গদ্য ভাষা আছে। তাঁর নিজের বলার
একটা ঢং বা রীতি (ফর্ম) আছে। তাঁর সাহিত্য জীবন ঘনিষ্ঠ ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদি
কোন কমতি থাকে বা ক্ষামতি থাকে তাও বলেন। হৃদয় যদি স্পর্শ না করে, মগজ যদি
উতলে না ওঠে, চিন্তা যদি উদ্বেলিত না হয়, ভালই যদি না লাগে এর প্রাপ্যও
দূর্ভাগ্যবান শ্রমিক লেখক নগদ পেয়ে যান।
(আগামী সংখ্যায় সকল সমালোচনা অতিক্রম করে লেখক কিভাবে এগিয়ে যান তা নিয়ে কিছু উদাহরণ থাকবে)
একটি কবিতার খসড়া
আনোয়ারুল হক
যেনো তৃষ্ণার জলের মতো মুখের আদল
সাতরং চুলে কালো নয় মেঘের আরঙ
সবুজ শীতল কোন হাওয়ার কানাকানি
যে কথা আর কেউ কোনদিন বলেনি
একটু একটু করে
মাড়িয়ে এলে দীর্ঘ পথ, আমি কী করে বলি
যাবো না।
আমি যাবো
সে যেনো পাল তোলা নৌকোর ঘরবাড়ি
পাটাতনে শুয়ে থাকা বিকেলের রঙ, সন্ধ্যার শিশির
যেদিকে খুশি ভাসিয়ে নিয়ে যায় যদি, যাক।
এভাবে ভাসালে নাও
আমি সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেবো জলে
মৃত্তিকার কোলে।
যেনো প্রিয় কোন কবিতার বই
কালো কালো অক্ষরের মেয়ে চুলখোলা মেঘের শরীর
প্রেমের পত্রপুট নীল খাম
যে চিঠি হয়নি বিলি ও বলা তখন
আজ বলি-
নাহ থাক, অন্য কোনদিন
বলবো তোমাকে।
হঠাৎ দেখা
কলমে- দিল আফরোজা রুনা
পঁচিশ বছর পর হঠাৎ দেখা
মোহনার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা
সেই নীল শার্ট আর অফ হোয়াইট প্যান্ট
চোখে সোনালী ফ্রেমের ভারী গ্লাস
হাত ঘড়ি সোনালী ডায়াল
হাত দুখানি প্যান্টের পকেটে আধো ডুকানো
নীল আকাশের পানে তাকানোর গভীরতায়
কৌতুহলী মন ছুটে গেলো আমার,
দূর থেকেই তাকিয়ে থেকে
ফিরে আসছিলাম ।
এমন সময় বলে উঠা -- 'এক্সকিউজ মি'
হঠাৎ পিছনে ফিরে তাকানো
মুহূর্তেই নিঃস্তব্ধ নিথর দুটি প্রাণ
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা
এভাবেই কেটে গেলো বেশ খানিকটা সময়।
চাঁদনী তুমি, এখানে?
ভাষা বিহীন মুখে চোখের কোন দিয়ে
গড়িয়ে পড়া জলের ধারাই বলছিলো
এ যে চোখের জল নয়,
এটা ছিলো হৃদয় থেকে বয়ে চলা
ভালোবাসার ঝর্ণাধারা!
হঠাৎ চমকে উঠে
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো শুভ্র তুমি!
আবারও নিরব দু'জন।
মন চাইছে অনেক কিছু
কিন্তু কিছু না বলেও
বলা হয়ে গেলো অনেক কথা।
সেই যে পঁচিশ বছর আগের
ভালোলাগা তোমাকে,
বিধাতা এই সায়াহ্নে দু'জনকে এভাবে
মিলিয়ে দিবে বুঝিনি আগে।
সেই থেকে প্রায় দেখা হওয়া
মাঝে মাঝে একসাথে
ঘুরে বেড়ানো সেই প্রিয় নদীর তীরে বসন্তের বিকালে,
আর বৃষ্টির দিনে
দুজন দুজনার হাতে ধরে ভিজা
বৃষ্টির পানিতে এক সাথে ।
তোমার ওই চাঁদনী ডাক আজও মনে পড়ে
মমতা আর ভালোবাসায় কিভাবে তুমি জড়ালে আমায়
তুমি যে হয়ে গেলে আমার নিঃশ্বাস
তোমায় বিনে কি করে নেই
আমার এই প্রশ্বাস।
যখন আমরা একসাথে ঘুরে বেড়াই
বাঙলো বাড়ির বাগানে
রাজ্যের কথা, গল্প বাধ ভাঙা হাসির
থাকেনা কোনো পরিসীমা
মনে হয় দুনিয়াতে পেয়ে যাই
আমরা স্বর্গের ঠিকানা।
তোমায় যে আমি বাসি ভাল
অনেক অনেক করে
তুমি আছো তুমি থাকবে
আমার বুকের মাঝে জীবনের শেষ বেলাতে
তোমাকে যে আমার মন প্রাণ ভালোবাসা সব দিয়েছি বিলিয়ে
থাকিবে তাহা শুধুই তোমার জন্যে
সারাটি জীবন ধরে।