হে অগ্রপথিক
(কবি আজফার আজিজ স্মরণে)
ভূঁইয়া তাজুল ইসলাম
মৃত্যু মানুষকে পৌঁছে দেয়
ইহ জগৎ থেকে পর জগৎতে
যে যাওয়ার সে চলে যায়
সংসারে রেখে যায় অপার শূণ্যতা
সেই স ্থান হয় কী তা কখনো পূরণ
খা খা ফাঁকা বারান্দা, খালি চেয়ার
তার মাঝে বেঁচে থাকা
সামনে চলা, কথামালা
কখনো ককনো স্মৃতিকাতর আত্মজ
প্রিয় বন্ধু সজ্জন
বুকের গহীনে বাড়ে জ্বালা
চোখের কোনে মায়াবী নীরব জলধারা
ভাষাহীন ঋণ, কে কাকে দিবে প্রবোধ সান্ত¦না।
বেঁচে থাকার তাগিদে কাজে কর্মে
দিনে দিনে বাড়ে ব্যস্ততা
ভুলে শোক যন্ত্রণা, হারায় কাজের মাঝে
বছরে একদিন পািরবার বন্ধুবান্ধব
আত্মজের স্মরণ সভা।
মানুষ বেঁচে থাকে অনাধিকাল
সৃষ্টিকর্মে কীর্তির সৌরভে গৌরবে
তুমি তাদেরই সহজাত, আত্মজন
শ্রমে ঘামে চিন্তা ভাবনা শিল্পসাহিত্য
সাংবাদিকতায় রেখে গেছো অবদান
তুমি অগ্রপথিক, তোমার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, সম্মান।।
বাংলাদেশ
লেখক শিবির এর বার্ষিক সম্মেলন হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক
মিলনায়তন কেন্দ্রে। সময়টা ছিল ১৯৭৭ সাল। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা থেকে
সংগঠনের কর্মীরা ছুটে এসেছেন সম্মেলনকে স্বার্থক করে তুলতে। কুমিল্লা থেকে
আমরাও কয়েকজন গেলাম। আমাদের দলে ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কবি
বাবুল ইসলাম, পিয়াস করিম, প্রয়াত কবি ও প্রাবন্ধিক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন,
আবৃত্তিকার প্রয়াত আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কাজী আরিফ, সংগঠনের অর্থ সচিব
নাজির হোসেন ভূঁঞা, এডভোকেট শরীফ উদ্দিন (সোনা রাঙ কম্পাউন্ড) এবং আমি।
সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে সংগঠনের মূল প্রতিবেদন পড়ার দায়িত্ব ছিল আমার উপর।
প্রথম দিনের কর্মকাণ্ড ছিল বিভাগীয় কেন্দ্রিক। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম
খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের সাংগঠনিক রিপোর্ট ছিল খুবই দীর্ঘ। কুমিল্লা জেলার
রিপোর্ট নিয়ে আমি খুব ভয়ে ছিলাম। কবি বাবুল ইসলাম আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন,
আমাদের ডাক পড়বে চট্টগ্রাম জেলার পর। আমরা টিএসসির সবুজ চত্বরে বসে অপেক্ষা
করছিলাম। এমন সময় গৌঢ় বর্ণের এক তরুণ প্যান্টের দুপকেটে দুহাত ঢুকিয়ে
টিএসসির লেন থেকে সোজা আমাদের দিকে হেঁটে আসতে লাগলেন। তার সারা মুখে ছড়িয়ে
থাকা দিপ্তীর সঙ্গে ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। বাবুল তাকে অভ্যর্থনা জানালেন।
তিনি খুব সাবলিল ভাবে ঘাসের উপর বসে পড়লেন। বাবুল আমাকে দেখিয়ে বললেন-
আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী মোহাম্মদ ইউনুস, আর ইনি হলেন কেন্দ্রীয় লেখক
শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক আজফার আজিজ। সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতা বিশেষ করে
শাহরিয়ার ভাই, খালেদ বিন জয়নুদ্দিন, মহসিন শস্রপানি, আনু ভাই (ড. আনু
মুহাম্মদ) এদের সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় ছিল। কিন্তু, আজকের এই আগন্তুককে আমি
এর আগে কখনোই দেখিনি। আশ্চর্য্যরে ব্যাপার এই যে পরিচয়ের প্রথম পর্বে তিনি
আমাকে গাজী ভাই বলে সম্বোধন করে মুহূর্তেই আপন করে নিলেন। আমার হাতে ছিল
সাংগঠনিক প্রতিবেদনটি যা, কিছুক্ষণ পরেই পড়া হবে। হুট করে বাবুল ইসলাম
বললেন, ‘আজফার দেখতো আমাদের রিপোর্টটি ক্যামন হয়েছে।’ এটা শুনে সত্যি আমি
বিব্রত বোধ করতে লাগলাম। কেন না একজন কেন্দ্রীয় নেতার দৃষ্টিতে মফস্বল
কেন্দ্রিক সংগঠনের ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পরবেই পরবে। তিনি রিপোর্টটা পড়লেন।
তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, দারুন হয়েছে গাজী ভাই। আমি বললাম এটা আমি
একা তৈরি করিনি। বাবুল আমাকে সাহায্য করেছে।
সেদিন এভাবেই আমাদের পরিচয়
হল। এ ঘটনার পর তার সঙ্গে কুমিল্লায় আবারও দেখা হল আমার। ধীরে ধীরে আরো
ঘনিষ্ঠ হলাম আমরা। এই ঘনিষ্ঠতার ভেতর দিয়ে তাকে যতটা দেখেছি সে অভিজ্ঞতার
আলোকে বলব, প্রথম দিকে তিনি ছিলেন একজন সঙ্গীত পাগল মানুষ। সঙ্গীতের প্রতি
গভীর আকর্ষণ থেকে বেহালা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের
খুঁটিনাটি বিষয়গুলি খুব ভালোভাবে রপ্ত করে ছিলেন। বেহালায় যখন বিভিন্ন রাগ
বাজাতেন তখন সুরের মুর্ছনায় আমরা বিভোর হয়ে থাকতাম। আর তিনি সেখান থেকে
অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে লিখে ফেললেন ‘উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রাগ লক্ষণ’ নামক
এক মূল্যবান গ্রন্থ। সেই ধারাবাহিকতায় শুরু করলেন কাব্যচর্চা। বাংলা ইংরেজি
দুই ভাষাতেই তিনি লিখতে শুরু করলেন। দেশ বিদেশে তার লেখা ছাপা হতে লাগল।
শুধু কবিতাই নয় গল্প প্রবন্ধ উপন্যাসও লিখলেন। ঠিক এর পাশাপাশি সাংবাদিকতার
দিকেও ঝুঁকলেন। সেখানেও অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করলেন।
দেশি বিদেশি অসংখ্য পত্রিকা ও জার্নালে তার লেখা ছাপা হতে লাগল। এই
বিষয়গুলিকে আত্মস্থ করে হঠাৎই অধ্যাত্বের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। শুরু হল এক
দীর্ঘ পথযাত্রা যার শুরু আছে শেষ নেই। অধ্যাত্বের এই চারণ ভূমিতে বিচরণ
করতে যেয়ে তিনি নিজেই এক ‘অলীক’ মানুষ হয়ে গেলেন। এই সফরে নেমে কত ঘাটেই না
নোঙ্গর ফেললেন। সেই লালন থেকে ‘মলয়া’ আবার সেখান থেকে মাইজভান্ডার হয়ে
কাশেম আলী চিশতী - কোথাও তিনি স্থির হতে পারলেন না। যে সত্যের সন্ধান করতে
যেয়ে অধ্যাত্বের বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিলেন ঠিকই কিন্তু, কোথাও তিনি তার সত্য
ও সুন্দরের দর্শন পেয়েছিলেন কি না তা অজানাই থেকে গেছে। তিনি ছিলেন এক
অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ। নিজেই নিজের প্রভু ছিলেন; তাই পথ দেখাতে কারো
সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি কখনও। একলা চলার নীতি তাকে তার পরিবার বন্ধুস্বজন
থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে ছিল। তাই জীবনের শেষ মুহূর্তটায় ঠিক কী
ঘটেছিল তা আর জানা হল না। আজফার আজিজ চলে গেছেন ঠিকই তবে এটাকে ‘যাওয়া’ বলা
যাবে না। আমি মনে করি এখন থেকে তার অনন্তের যাত্রা শুরু হল। তিনি সেখাইে
থাকুন না কেন ভালো থাকুন শান্তিতে থাকুন এ কামনা রইল।
গাজী মোহাম্মদ ইউনুস
গল্পকার উপন্যাসিক