মোস্তফা হোসেইন ।।
বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০। সময় এসেছে হিসাব মেলানোর। পাকিস্তানকে গুডবাই বলতে হয়েছিল অর্ধশতাব্দীকাল আগে যে কারণে, আমরা সেই অর্জন কতটা করেছি। আমরা কি পাকিস্তান আমলের পূর্ববাংলা থেকে বাংলাদেশে উত্তরণ হওয়াতেই থেমে আছি, নাকি স্বাধীনতা আন্দোলনের লক্ষ্যগুলো অর্জনে সাফল্য অর্জন করেছি। তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে গবেষণামূলক কোনও প্রবন্ধ নয়, আমার চোখে দেখা পূর্ব পাকিস্তান আর বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো এই লেখায়।
আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে মুক্তিযুদ্ধের আগে। নিজ এলাকার কথা দিয়েই শুরু করি। একেবারে একটি গ্রাম, যা গোটা পূর্ব পাকিস্তানেরই চিত্র বহন করে। মনে হয় গ্রামের বর্ণনা দেওয়াটা বিষয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরতে হয় আমাকে। দেখেছি প্রতিটি গ্রামের চেহারায় কী পরিবর্তন এসেছে। অতি সম্প্রতি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম সদরের অনেক গ্রাম ঘুরে বুঝতেই পারিনি ওই এলাকায় কখনও মঙ্গা কবলিত ছিল। বারবার মিলিয়ে দেখেছি আমার গ্রামের সঙ্গে। আমার গ্রামে যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তার চেয়ে কম বেশি কেমন আর হলেও তা কি কি? মোটামুটি সব গ্রামকেই মনে হয়েছে আমার গ্রামের মতো।
সাবেক ত্রিপুরা জেলায় ও সাবেক বুড়িচং থানার চান্দলা গ্রামে আমার জন্ম। গ্রামটি দুই ভাগে বিভক্ত। উত্তর চান্দলা ও দক্ষিণ চান্দলা। আমার শৈশবে অর্থাৎ পাকিস্তান আমলে অন্য দশটা গ্রাম থেকে ছিল অগ্রসর।
গ্রামের মানুষের প্রায় শতভাগই ছিল কৃষিজীবী। ফসল বলতে আমন, আউশ আর রবিশস্য। প্রায় প্রতিবছরই কৃষককে অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির খড়গের নিচে পড়তে হতো। ফসল মার যাওয়া ছিল নিত্য ঘটনা। ফলন ছিল একরপ্রতি বড়জোর ২৫-৩০ মণ। তবে সেটা নির্ভর করতো প্রকৃতি কতটা সুপ্রসন্ন তার ওপর।
বর্ষায় অধিকাংশ বাড়ি পানিতে তলিয়ে যেত, বন্যা বেশি হলেই। দুই চার বছর পর পর ২৫ মাইল দূরে গোমতী নদীর ভাঙনের কবলে পড়তো গ্রাম। ঘরে বসত করতে হতো মাচার ওপর।
গ্রামে ছিল পায়ে হাঁটা পথ। জমি থেকে বড় জোর ২/৩ ফুট উঁচু। পাশাপাশি দুই জন হাঁটা সম্ভব হতো না। ফলে বর্ষাকালে নৌকাই ছিল যোগাযোগের ভরসা। শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকতো বছরের অন্তত ৩/৪ মাস। অর্থাভাবে শিশুদের স্কুলে যাওয়া হতো না। বেতন বই খাতাই শুধু নয়, বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য একসেট পোশাক দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না কৃষকদের। প্রতিকূলতার মধ্যেও যদি কোনও শিশু স্কুলে যেতো, প্রাইমারি স্কুলের পর আর তাদের যাওয়া সম্ভব হতো না, স্কুলের খরচ চালানো সম্ভব হতো না বলে।
৫/৭ বর্গমাইলের মধ্যে দুয়েকটি পাকা দালান ছিল না। এমনকি ঢেউটিনের ঘরও ছিল কালেভদ্রে। কিছুটা সচ্ছল গৃহস্থ ঘর করতো কেরোসিনের টিন কেটে চাল বানিয়ে। বাকি সবই ছিল ছনের চালের।
আমার পরিবার ছিল একসময়ে ধনী কৃষক জোতদার। কিন্তু গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় আমাদের। তারপরও ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের কথাই বলি। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিল ২১-২২জন। আমার দাদি ছিলেন পরিবারের প্রধান ব্যক্তি। আমার মা ছিলেন চালিকাশক্তি। প্রতিবেলা এত মানুষের খাবারের আয়োজনটা করতে হতো মাকে। তাকে সহযোগিতা করার জন্য কর্মী দরকার। খেয়াল করুন এই বেলা। আমার মায়ের সহযোগী ছিলেন রেজিয়া, ধনীর মা ফুপু এবং জরিনার মার ফুপু।
তারাই লেখার উল্লেখযোগ্য চরিত্র। রেজিয়ার কথাটা বলি। রেজিয়া আমাদের বাড়িতে আসেন আমার শিশুকালে। আমার নানা দিয়েছিলেন আমার মাকে। তার বাড়ি ছিল আমার নানার বাড়ি দেবিদ্বার থানার পাশের থানা বরুরায়। নানার মুরিদান নানাকে গছিয়ে দিয়েছিলেন এই মেয়ে শিশুটিকে। বলেছিলেন, তাকে কোনও এতিমখানায় দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে। আমার নানা মাকে দিয়েছিলেন, তার সহযোগী হিসেবে কাজের সুযোগ দিতে। এই রেজিয়ার বাবা-মা মেয়েকে গছিয়ে দেওয়ার পর কোনও দিনও খোঁজও নেয়নি তার। সুতরাং রেজিয়ার পারিশ্রমিকের প্রশ্নই আসে না।
আমার মা তাকে প্রথম বিয়ে দেন সাধ্য অনুযায়ী খরচপাতি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য রেজিয়ার। মৎস্যজীবী স্বামীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৃশংসভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। রেজিয়া একটি মেয়েসহ আমার মায়ের কাছেই আশ্রয় নেন। আমার মা তাকে আবার বিয়ে দেন, স্বামী বুড়ো মানুষ। ছেলে সন্তানের আশায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। কিন্তু সতীনের সংসারে টিকতে পারেনি রেজিয়া। আবার আমার মায়ের কাছেই আশ্রয়। কিন্তু নিয়তি বিরূপ। রেজিয়া হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে। থেকে গেলো রেজিয়ার মেয়ে। তাকেও আমার মা লালনপালন করলেন এবং বিয়ে দিলেন। রেজিয়া এবং তার মেয়ে ফিরোজা পারিশ্রমিক হিসেবে পেলো তাদের বিয়ের কিছু খরচ।
এবার আসি ধনীর মা ফুপুর কথায়। তিনি আমাদের প্রতিবেশী। বাড়ির দক্ষিণে সরকারি রাস্তা ও খাল। ওপারেই তাদের বসত। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধেরও অন্তত ৪০ বছর আগে। বিধবা হওয়ার পর আমার দাদির সহকারী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দাদির মৃত্যু পর্যন্তই শুধু নয়, অনেক পর পর্যন্ত ছিলেন আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে। আমরা তাকে ডাকতাম ধনীর মা ফুপু বলে। ধনীর মা ফুপু দাদির সার্বক্ষণিক সহকারী ছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের খাওয়ানো ইত্যাদি কাজেও সময় দিতেন। এই যে বছরের পর বছর শ্রম দেওয়া, তার বিনিময়ে পেতেন শুধু তিন বেলা খাবার। দাদির সেবা করতেন বলে আমার বাবা কাকারা কাপড়চোপড় আর ওষুধটা দিতেন। আমার ফুপুরা বেড়াতে এলে হয়তো এক দুই টাকা বকশিশ দিতেন।
জরিনার মা ফুপুও ছিলেন একই রকম। তিনি আমার মায়ের রান্নার সহযোগী ছিলেন। তারও বাড়ি ছিল ধনীর মা ফুপুর পাশেই, একই বাড়িতে। আমরা ছোটকালেই দেখেছি তিনি নানা রোগে ভুগতেন। আমার বাবা মাঝে মাঝে ব্যথানাশক ওষুধ দিতেন খাওয়ার বাইরে। ব্যথায় অস্থির হয়ে আব্বাকে বলতেন, ‘ভাইসাব আমারে হুমার দানা উসুদডা আইনা দেন না’ (শসার বিচির মতো চ্যাপ্টা ট্যাবলেট)। মাঝে মাঝে জাকাতের কাপড় পেতেন তিনি ধনীর মা ফুপুর সঙ্গে।
তাদের ছাড়াও সপ্তাহান্তে আতিথ্য গ্রহণ করতেন শামসুর মা নামে আরেক মহিলা। ধনীর মা ফুপু কিংবা জরিনার মা ফুপু শামসুর মার আসাটা পছন্দ করতেন না। কিন্তু আম্মার হাতে পায়ে ধরে দু’চারদিন থেকে যেতেন তিনি। শুধু দুয়েক দিন দু’মুঠো খাবারের আশায়। শামসুর মায়ের মতো ছিল এয়াকুবের মা-ও। তারা মাঝে মাঝে এসে আম্মাকে বলতেন, কয়েক দিন ধরে ভাত খেতে পারছেন না। দুয়েক দিন অন্তত খাবার যেন তারা পান।
বাইর বাড়িতেও এমন উটকো মানুষ ছিল। আকাব্বর আলী ছিল প্রায় নিয়মিত। সকাল ১০টা ১১টার দিকে আসতেন। এসেই এক দফা হুক্কা টানতেন বসে বসে। যেই বেঞ্চিতে বসে হুক্কা টানতেন সেখানেই শুয়ে পড়তেন। আর খুক খুক করে কাশতেন। এই আকাব্বর আলীই ছিল উটকো মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত। কারণ, তিনি অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারতেন না। কিন্তু দুপুরে যখন গৃহকর্মীরা জমি থেকে এসে খাবার খেতে বসতেন, তিনি তাদের সঙ্গে বাইর বাড়ির ঘরে বসে যেতেন। ফলে স্থায়ী গৃহকর্মীরা তাকে প্রায়ই দুরছাই করতেন। তাদের মন্তব্য থেকে বাঁচার জন্য তিনি ভেতর বাড়িতে চলে যেতেন, আম্মার কাছে। বলতেন, বাউজ (ভাবি) পেটটাত রাইজ্যের ভুক। একটু ডাইল-ভাত দেন। আম্মা বাইর বাড়ির ঘর দেখিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত খাবারও পাঠিয়ে দিতেন। তবে সেই খাবারটা ছিল অপমানজনক। মাঝে মাঝে জমিতে যেতেন কাজ করার বিনিময়ে খাবার পাবেন সেই আশায়। কিন্তু স্থায়ী গৃহকর্মীরা তাকে পছন্দ করতো না। কারণ, তিনি তাদের সঙ্গে কাজে তাল মিলাতে পারতেন না অসুস্থতার কারণে। ফলে বাইর বাড়ির ঘরে শুয়ে থাকাই ছিল তার জন্য নিরাপদ। তার থাকার ঘরে বৃষ্টি পড়তো, বেড়া ছিল ভাঙা। মুক্তিযুদ্ধের কিছু দিন আগে আমার কাকা তাকে দুই বান্ডেল টিন দিয়ে ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, সেই আলী আকাব্বরের পক্ষে টিনের ঘরে বেশি দিন থাকা সম্ভব হলো না। পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যরা খুন করে তাদের প্রতিপক্ষ ভেবে।
এবার আসা যাক আমাদের ঘরে যেসব কৃষি শ্রমিক কাজ করতেন তাদের কথা। ধানের ফলন কম হলেও চাষাবাদ করতে হতো। তার জন্য প্রয়োজন হতো শ্রমিক। পরিবারের কৌলিন্য বজায় রাখতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের কেউই জমিতে যেতেন না। কখনও ১ জন কখনও ২ জন বার্ষিক চুক্তিভিত্তিক কৃষি শ্রমিক নিয়োগ পেতেন আমাদের পরিবারে।
মনে আছে, তাদের পারিশ্রমিক ছিল বার্ষিক ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। সেই পারিশ্রমিক পরিশোধ করা হতো সপ্তাহের হাটবারে বুধবার ও রবিবারে। পরিমাণ হতো দেড় টাকা কিংবা পৌনে দুই টাকা। একটু হিসাব করে দেখি তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে তাদের সংসার কেমন চলতো।
বাজারে চালের দাম ছিল প্রতি সের (১ কেজির চেয়ে কম) আট আনা (৫০ পয়সা)। কারো পরিবারেই সন্তানের সংখ্যাসহ সদস্য সংখ্যা ৭-৮ জনের কম ছিল না। হিসাব মিলিয়ে নিলে দেখা যাবে- অর্ধসপ্তাহে তার সক্ষমতা ছিল ৩ সের চাল ক্রয় করা। প্রশ্ন হচ্ছে বাকি চাহিদা পূরণ হতো কীভাবে? সোজা কথা, অপূরণই থাকতো তাদের চাহিদাগুলো।
অনিবার্য কিছু চাহিদা তারপরও থেকে যায়। যেমন, চিকিৎসার বিষয়টি। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল স্বপ্নের মতো। ভালো চিকিৎসা বলতে ছিল উমেশ ঠাকুরের হোমিওপ্যাথি ওষুধের পুড়িয়া। চন্দ্র ডাক্তারের মিকচার। তাও চার আনা থেকে আট আনার কমে নয়। ফলে রোগ হলে ভরসা ছিল পানি পড়া কিংবা তাবিজ। এই নিয়েই যখন মানুষ মৃত্যুশয্যায় পড়তো তখন পরিবারের মানুষ চাইতো মরণকালে ফল খাইয়ে বিদায় দিতে। বাড়িতে আম-কলা ছাড়া খুব একটা ফল হতো না। তবে মরণকালে আঙ্গুর বেদানা খাওয়ানোটা ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষা। সেই সুযোগ পেতো হাতেগোনা দুয়েকজন।
আমার প্রতিবেশী একজনের কথা মনে আছে, তার বাবা মৃত্যুশয্যায় যাওয়ার পর সাত মাইল হেঁটে নয়নপুর স্টেশনে গিয়ে রেলে চড়ে গেলেন কুমিল্লা শহরে। সেখান থেকে এক পোয়া (আড়াইশ গ্রাম প্রায়) আঙ্গুর আনলেন বাবাকে খাওয়াবেন বলে। বেদানাও আনলেন একটা। বাবার মৃত্যুর পর সন্তানের আর আফসোস রইলো না। কারণ, বাবার মৃত্যুর আগে কোনও ফল খাওয়াতে পেরেছেন তাই।
আগেই বলেছি, ওই সময় আমাদের গ্রাম ছিল আশপাশের ৫-১০টা গ্রাম থেকে এগিয়ে। শিক্ষার কথাই যদি বলি, এখানে ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুল। যা মাইনর স্কুল হিসেবে পরিচিত ছিল। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ছিল সেই স্কুল। ধনী পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কুমিল্লা কিংবা কলকাতায় পাঠাতেন লেখাপড়া করার জন্য।
পুরো থানার মধ্যে এত শিক্ষিতের সংখ্যা অন্য কোনও গ্রামে ছিল এমন তথ্য পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে আমার দাদা বশারত আলী সরকারের উল্লেখিত একটি তথ্য যুক্ত করা যেতে পারে। তার ডায়েরির ১৩৩৭ বাংলা সনের ৮ আষাঢ় তারিখের একটি ভুক্তি ছিল নিম্নরূপ- গ্রামের চাকরিজীবী,পেশাজীবী, ছাত্র উপশিরোনামে লিখেন-
বাবু যোগেশ চন্দ্র লোধ এমএ বিএল মুন্সেফ ( ১৯২৯ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত)। বাবু সুরেশ চন্দ্র দেব, এমএ বিএল- উকিল, কুমিল্লা। বাবু যোগেন্দ্রনাথ ধর, বিএ বিএল, উকিল, কুমিল্লা। বাবু শশীভূষণ দাস, বিএ। বাবু শ্রী চন্দ্র দেব, বিএ (অনুত্তীর্ণ) মোক্তার, কুমিল্লা। এম আলী আকবর খান, বিএ (অনুত্তীর্ণ), মোক্তার, কুমিল্লা।
এম আব্দুল হালিম, বিএ (অনুত্তীর্ণ) মোক্তার, কুমিল্লা। এম মমতাজউদ্দীন আহমেদ,বিএসসি ৪র্থ বর্ষ,,জামশেদপুর টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। এম মতিউর রহমান, বিএ স্টুডেন্ট। এম আলী আজগর, মেট্রিকুলেশন, মোক্তার। এম তোরাফ আলী মিয়া, মেট্রিকুলেশন, কারণিক, পোস্ট অফিস। শরাফত আলী মিয়া, মেট্রিকুলেশন, এএসআই, পুলিশ। বাবু অনঙ্গ দত্ত, গভ. প্রিন্টিংয়ের কারণিক। বাবু ইন্দুভূষণ দাস, মেট্রিকুলেশন,মোক্তার,কুমিল্লা। বাবু বসন্ত কুমার দত্ত,মোক্তার, কুমিল্লা। বাবু নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, করণিক, পোস্ট অফিস। বাবু অমর চন্দ্র ধর, রেলওয়ে কর্মচারী। বাবু এন এন দাস, রেলওয়ে কর্মচারী।
এই তথ্য সংযোজন মাধ্যমে অনুমান হয় পুরো গ্রামে শিক্ষিত সংখ্যা ছিল খুবই কম। এই প্রসঙ্গে আমরা ড. মো. মাহবুবুর রহমান সম্পাদিত ‘মো. বশারত আলীর ডায়েরি (১৯২৩-৪৩) কুমিল্লা জেলার এক জোতদার পরিবারের ইতিহাস ও তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অবস্থা’ গ্রন্থে উল্লেখিত একটি তথ্য উল্লেখ করতে পারি।
১৯৭১ সালের আগে এই গ্রামে নারী শিক্ষার হার ছিল প্রায় শূন্য। ১৯৭৪ সালে ওই গ্রামে মোট শিক্ষিতের হার ছিল ১১%। স্বাধীনতার দশম বছরে গ্রামে নারী শিক্ষার হার দাঁড়ায় ১২.৬% এবং মোট শিক্ষিতের হার ১৮.৯%। জনশুমারি ২০০১ অনুযায়ী সেই গ্রামে মোট শিক্ষিতের হার ৪৩.৬১%। সেখানে পুরুষ শিক্ষিতের হার ৪৯.২% নারী ৩৮.১৫%।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে হবে, গোটা দেশে দুটি বড় ধাক্কা লেগেছিল ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধকালে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ মাধ্যমে। ষাটের দশকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গার কারণে ওই গ্রামের অনেক হিন্দু পরিবার দেশত্যাগ করায় গ্রামের শিক্ষিত মানুষের হার হঠাৎ করে নিম্নগামী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শিক্ষা প্রসারে রেকর্ড সৃষ্টি হয়।
পাকিস্তান আমলে গ্রামের একমাত্র হাই স্কুলে প্রথমদিকে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। সহশিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৬৭ সালে। মেয়েদের প্রথম ব্যাচ এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ১৯৭২ সালে। তখন স্কুলে শিক্ষার্থী ছিল ৩৫০ জন। এখন ওই স্কুলেই শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫শ’ । যার মধ্যে অধিকাংশই নারী। সম্প্রতি গ্রামে আরেকটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। পাকিস্তান আমলে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে ছিল একটি কলেজ। ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল আরেকটি। এখন ওই গ্রামেই দুটি হাই স্কুল এবং এরমধ্যে একটি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। ইউনিয়নে ৩টি হাইস্কুল ও দুটি কলেজ।
শিক্ষা ব্যবস্থা সম্প্রসারণের পাশাপাশি বেড়েছে শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিতের হার। পাকিস্তান আমলে পুরো গ্রামে এমবিবিএস ডাক্তার ছিল একজন মাত্র। এখন অন্তত ৬ জন। পিএইচডি ডিগ্রি ছিল পাকিস্তান আমলে মাত্র ১ জন। এখন অন্তত ৭/৮ জন। উচ্চশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার ছিল ১ জন। এখন ৭-৮ জন। শিক্ষার ফলস্বরূপ এখন এই গ্রামে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাও বেড়েছে লক্ষণীয় মাত্রায়। পাকিস্তান আমলে ইপিসিএস ছিলেন ২ জন। এখন ৪ জন। ওই সময় লে.কর্নেল ছিলেন একজন। বাংলাদেশ আমলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ১ জন। বর্তমানে লে. কর্নেল একজন।
এবার আসা যাক অবকাঠামোগত পরিবর্তনের কথা। গ্রামে ষাটের দশকে প্রথম সরকারি পাকা দালান হয় চান্দলা খাদ্য গুদাম। এখন কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনসহ বেশ কিছু সরকারি ভবন হয়েছে। যে স্কুলটি ছিল ভাঙা বেড়ার, সেটি এখন তিনতলা পাকা ভবন। আগে যেখানে ৬/৭ বর্গমাইলের মধ্যে কোনও পাকা বাড়ি ছিল না। এখন প্রতিটি বাড়িতে ২-৪টি পাকা ভবন।
সত্তরের দশকেও ঢাকা থেকে গ্রামে যেতে হলে প্রস্তুতি নিতে হতো অনেক আগে থেকে। কারণ, ট্রেন স্টেশন থেকে বাড়ির দূরত্ব ছিল ১০ কিলোমিটার আর সড়কপথে ৭ কিলোমিটার। এই পথটুকু শুকনো মৌসুমে যেতে হতো হেঁটে। বর্ষায় নৌকায়। এখন সকালে ঢাকা থেকে রওনা হয়ে বাড়ি গিয়ে নাশতা খাওয়া যায়। গ্রামের ভিতরের রাস্তাগুলোও প্রায় সবই পাকা। অন্যদিকে বিদ্যুৎ সুবিধা শুধু সেচযন্ত্রেই নয়। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে।
জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের একটি উদাহরণ দেই। আমাদের শৈশবে, মাঘের শীতের ভোরবেলা, বাড়ি থেকে বেরিয়ে খালপাড়ে গিয়ে দেখা যেতো মানুষ খোলা জায়গায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছে। আজকে খোলা জায়গায় থাক দূরের কথা, জঙ্গলে গিয়েও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হয় না কাউকে । কারণ, প্রতিটি ঘরে স্যানিটারি পায়খানা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে চলে টেলিভিশন। শহরের সব সুবিধা এখন ওই গ্রামের ঘরে ঘরে।
লেখার প্রথমাংশে আমাদের গৃহকর্মীদের অর্থনৈতিক দীনতার কথা বলেছিলাম। এবার ওই পাড়ার মানুষগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখা যাক । যে মানুষটি পুরো সপ্তাহ কাজ করে দৈনিক দুই বেলার ভাতের জোগাড় করতে পারতো না, সেই পাড়ায় দিনমজুরের সংখ্যা এখন কমে গিয়ে ১০-১২%-এ ঠেকেছে। দৈনিক সর্বনিম্ন আয় তাদের ৩০০ টাকা। কর্মসময় ৩-৪ ঘণ্টা। বাকি সময়টুকু এখন তারা নিজের জমিতে কাজ করে। গ্রামে কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি হওয়ায় ফসলের মৌসুমে ৩/৪ ঘণ্টার কাজের বিনিময়ে দিতে হয় ৭/৮শ টাকা পর্যন্ত । আগে যেখানে একর প্রতি ফলন হতো ৩০/৩৫ মণ সর্বোচ্চ, এখন ৯০ মণের বেশি। নেই বন্যার ভয়। অনাবৃষ্টি হলেও ফসলের জমিতে সবুজের ঘাটতি হয় না। প্রতি ঘরে ঘরে এক দুই জন করে প্রবাসী শ্রমিক আছে। ফলে স্বাচ্ছন্দ্য সচ্ছলতা প্রতি ঘরে ঘরে।
যারা পরাধীন বাংলা দেখেনি তাদের পক্ষে স্বাধীনতায় প্রাপ্তি মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে না। সেই সুযোগটি নিচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তাদের প্রাণান্ত চেষ্টা পাকিস্তান আমলকে স্বাধীন বাংলাদেশ আমলের চেয়ে সেরা হিসেবে বিশ্বাস করানো। বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু চান্দলা গ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামেই লেগেছে স্বাধীনতার ছোঁয়া। যারা বলে যে উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তা কি অর্জন হয়েছে, তাদের অন্তত অতীতের দিকে ফিরে তাকানো উচিত। তাদের মনে করতে হবে, এমনি এমনি সাড়ে ৭ কোটি মানুষ জীবন দিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বঞ্চনা দারিদ্র্য এবং আত্মপরিচয়ের সংকটে তাদের অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে। আজকের বাংলাদেশ উপহার তাদেরই শ্রমের দান।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক