সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ||
কিছু
মানুষের আয় বেড়েছে মানে অন্য অনেকের আয় কমেছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে যখন
কথা হয় তখন এটাই আসলে নিদারুণ কঠিন সত্য। আর সত্যটি হলো আয় ও সম্পদের
বৈষম্য বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে করোনার দেড় বছরে কোটিপতি হয়েছেন
১৭ হাজারেরও বেশি মানুষ। অন্যদিকে দেশে করোনাকালে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন
করে দরিদ্র হয়েছে। বলতে গেলে এই ছবিটিকে সাথে করেই আমরা আজ ২০২২ নতুন বছরে
পা রাখলাম ২০২১-কে বিদায় জানিয়ে।
বাংলাদেশে যত দ্রুত কোটিপতির সংখ্যা
বাড়ছে, বোধ করি এমনটা আর কোন দেশে হচ্ছে না। বাস্তবতা হলো, বৈষম্য আগেও
ছিল, বেড়েও যাচ্ছিল এবং করোনায় তা আরও দ্রুত হয়েছে। দুর্যোগের সময়,
অর্থনীতির চাকা না ঘুরলে এক ধাক্কায় বহু মানুষের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটে
এবং রাষ্ট্র তখন প্রয়োজনীয় কাজটি করতে পারে না। ফলে অনিবার্যই ছিল
করোনাকালে এমনটা হওয়া।
জাতীয় আয়কে সব দেশবাসীর আয়ের যোগফল হিসেবে দেখলে
বৈষম্যের ছবিটা স্পষ্ট হয় প্যারিসের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাব কর্তৃক
প্রকাশিত অসাম্য প্রতিবেদন 'ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট-২০২২'-এ বলা
হয়েছে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ মাত্র ১ শতাংশ মানুষের
হাতে কুক্ষিগত। বিপরীতে নিচু তলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট আয়ের ১৭
দশমিক ১ শতাংশ। যা দারিদ্র্যতার পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটি অসাম্যের দেশ
হিসেবে রূপ দিয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে করপূর্ব জাতীয়
আয়ের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল ১ শতাংশ মানুষের হাতে। বিপরীতে নিচু তলার ৫০
শতাংশ মানুষের হাতে ছিল সম্পদের ২০ শতাংশ।
বোঝা যায় কত দ্রুত কিছু মানুষ
সম্পদের পাহাড় করেছে আর কত মানুষ দ্রুত গরিব হয়েছে। ফলে গড় হিসেবে যখন
প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার দেখানো হয়, তখন প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতোই
সংখ্যাগরিষ্ঠদের কথা আলোচনায় আসে না।
আয়ের এই অদ্ভুত নির্মম পুনর্বণ্টন
ঘটে চলা, যা ঘটছে বহু মানুষের আয় কমে যাওয়া এবং অল্প কিছু মানুষের আয়
ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে। ক্রমবর্ধমান আয় পকেটে আসা সেই ভাগ্যবানদের
সৌভাগ্যের বহরও হয়েছে ক্ষমতা কাঠামোর ভেতর তাদের শক্ত অবস্থানের কারণে।
সম্প্রতি
ঢাকায় এক সম্মেলনে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভাগের গবেষণা
(ইউএন–ডেসা) প্রধান নজরুল ইসলাম বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে
দেশে স্পষ্টত অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। এ বৈষম্য দূর করা না গেলে বাংলাদেশ
মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে যাবে। তাতে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশের উচ্চ আয়ের দেশে
পরিণত হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বৈষম্যের গভীরতাটি দেখলে অতিমারিকেই
পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। অতিমারি আসলে যা করছে, তা হল সমাজ-অর্থনীতির
অন্তঃস্থলে যে বৈষম্য বিরাজমান তাকেই আরও গভীর ও তীব্র করেছে। তাই
অর্থনীতির পুনরুত্থান প্রচেষ্টায় সেখানে কোন ইতিবাচক ছাপ পড়েনি। কোভিডের
প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এখন আছড়ে পড়তে যাচ্ছে ওমিক্রন ঝড়। ফলে আবারও
শঙ্কা সবার মনে।
সরকারের আয় প্রত্যক্ষ কর অর্থাৎ আয়কর থেকে যতটা হওয়ার
কথা সেটা হচ্ছে না। ভ্যাট নামের পরোক্ষ করের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতারও
একটি অবাঞ্ছিত পরিণতি আছে বৈষম্য বাড়ানোয়। প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থায় বেশি
আয়ের মালিককে আনুপাতিক ভাবে বেশি কর দিতে হয়। মাস-মাইনের চাকরি করেন যারা,
তাদের নির্ধারিত হারে করটুকু দিতেই হয়।
কিন্তু কর্পোরেট জগতের বড়
সাহেবরা সিস্টেম করে রেখেছেন এমন করে যে, দেখা যায় তাদের কর্মীদের চেয়েও
তাদের কর কম। কিন্তু মূল্য সংযোজন নামের কর ধনী দরিদ্র প্রভেদ করে না।
লবণের উপর সালমান এফ রহমান যতটা কর দেবেন, দরিদ্রতম মানুষটিও ততটাই দেবেন।
তাই আয়কর বাবদ সংগ্রহ কমে ভ্যাট থেকে সংগ্রহ বাড়লে আর্থিক অসাম্য বাড়ে।
বিষয়টি নিয়ে ২০২২ সালেই ভাবা শুরু হোক।
রাস্তাঘাট, অবকাঠামোর উন্নয়নের
ফলে বড় গ্রামগুলো খুব দ্রুত শহরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেখানকার শ্রমজীবী
মানুষ কৃষি ছেড়ে নির্মাণশিল্প, হোটেল, পরিবহন, হাটবাজারের মতো নানা
ক্ষেত্রে কাজ পাচ্ছে। ছোট গ্রামসমূহে এই সুযোগ অনেক কম। ফলে, গ্রামের সঙ্গে
গ্রামের তফাৎ বেড়েছে। উন্নয়ন তার পরিধিতে ক্রমশই বৃহত্তর এলাকাকে ঢুকিয়ে
নেয়, কিন্তু তার বাইরের এলাকা তুলনায় আরও পিছিয়ে পড়ে। এটা একটা চলমান
প্রক্রিয়া।
রাজনৈতিক বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান, নারীর প্রতি
সহিংসতা বৃদ্ধিসহ নানা অসঙ্গতির সাথে আয়ের অনৈক্য আমাদের সমাজ কাঠামোতে বড়
বিভাজন টেনে রেখেছে বহুকাল ধরে। করোনাকালে সেটা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে।
জাতীয় আয় বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং কোটিপতি ও দরিদ্র মানুষ সমানতালে
বেড়ে চলেছে।
তাই নতুন বছরে নতুন ভাবনা আসুক শাসন ব্যবস্থায়। অতি
দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানে নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াতে
হবে। তাদের জন্য খাদ্যসহায়তাও জরুরি। এটা করতে অতি ধনী ও ধনীদের থেকে বড়
আকারে সম্পদ কর আরোপ করে। প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, সামাজিক
নিরাপত্তা, এগুলোর অসাম্য কমানো যায় রাষ্ট্র একটু উদ্যমী হলেই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।