বিশ্বাস রাখি আপন সংস্কৃতিতে
Published : Sunday, 2 January, 2022 at 12:00 AM
তুষার আবদুল্লাহ ||
আমরা
কেমন সেই প্রমাণই যেন রাখলাম নতুনের সূচনা লগ্নে। আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উদযাপন
করতেও যে আমরা অভ্যস্ত হইনি, ৩১ ডিসেম্বর রাতে সেই প্রমাণ পাওয়া গেলো।
উদযাপনের এই প্রকাশ নতুন নয়। প্রতিবারই কোনও না কোনোভাবে আমাদের অনভ্যস্ততা
প্রকাশিত হয়ে যায়। ফলে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের বিধিতেও নতুন-নতুন শর্ত যোগ
হয়। কিন্তু ওই বিধি বা নিষেধের মধ্যেই সুন্দর উদযাপন আয়োজনে আমরা অভ্যস্ত
হতে পারিনি।
তিন-চার দশক আগেও নতুন ইংরেজি নববর্ষ বরণের উচ্ছ্বাস প্রকাশ
করতে মানুষ পথে নেমে আসতো। সপরিবারেই বের হতো রাত বারোটায়। শুরুতে
নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা ভাবতে হতো না। তখন ঢাকায় এত ক্লাব, অভিজাত হোটেল,
কফি শপ ছিল না। তবে রাজধানীর মানুষের ধারণা ছিল– ইংরেজি নববর্ষের সব আনন্দ
বুঝি বড়লোক পাড়া গুলশান-বনানীতে। নগরীর অন্য এলাকা থেকে ওদিকেই ছুটে আসতো
উৎসবের উত্তাপ খুঁজতে থাকা মানুষ। এখনও সেই চল আছে।
তবে শহরজুড়ে ইংরেজি
নববর্ষ বরণের আয়োজন-উপকরণ এখন ছড়ানো ছিটানো। আর বড়লোক দেশের অনুকরণে আমাদের
সব উৎসব ঘর বা মর্ত থেকে বেরিয়ে আকাশমুখী। বাজি আর ফানুসে আকাশ রাঙানো এবং
শহর কাঁপানোতেই যেন এখন উৎসবের প্রকাশ। আমাদের এই প্রকাশ কিন্তু অনুকরণ
করা। নিজেদের সংস্কৃতির নয়। সেজন্য এর প্রকাশে আমরা আনকোড়া ও অসংযমী। তাই
নিজে আনন্দ করতে গিয়ে অন্যকে বিপদে ফেলছি। ফানুস-আতশবাজিতে ঘটছে দুর্ঘটনা।
শুধু ঢাকাতেই ঘটেছে ২০০ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ফানুসের আগুনে ৩১ ডিসেম্বর রাতে
ভয়াবহভাবে জ্বলতে দেখা গেছে ঢাকার বেশ কয়েকটি বাড়ি। শহর কেঁপেছে
রণক্ষেত্রের মতো। হাসপাতাল এলাকা ও আবাসিক এলাকার অসুস্থ মানুষের কথা
ভাবনায় আসেনি কারও।
১৯৯৯ সালে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে
থার্টি ফার্স্ট উদযাপন করতে গিয়ে যৌন নিপীড়নের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম
হয়েছিল, তেমনভাবে হয়তো এবার কিছু প্রকাশ পায়নি। তবে ওই ঘটনার দুই বছর আগেই ১
জানুয়ারি লিখেছিলাম– ডার্টি থার্টি ফার্স্ট। কারণ পথেঘাটে বখাটেদের
উৎপাতের কবলে পড়তে দেখেছি মেয়েদের। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। নারী-পুরুষসহ
সভ্যভাবে সংযম ও পরিমিতির পরিচয় দিয়ে আনন্দ উদযাপন করতে শেখেনি যারা, তারা
কীভাবে নতুন বছরে ‘শুভ ইশতেহার’ দেবে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দু’দিন
ধরে নাগরিকেরা ব্যক্তিগত ইশতেহার তুলে ধরছেন। নিজের জন্য যেমন, তেমনই
অন্যকে নিয়েও তাদের অপার প্রত্যাশা। ক্ষুদে বার্তায়ও এমন প্রত্যাশার ঢেউ।
কেউ কিন্তু বিশ্বাস করে এসব প্রত্যাশা বা ইশতেহার দিচ্ছেন না। এসব শুধুই
আনুষ্ঠানিকতা। যেখানে বিশ্বাস ও আস্থা অনুপস্থিত, সেই ইশতেহার পূরণ হওয়ার
নয়। তাই তো বছরের পর বছর বাংলা, ইংরেজি দুই বছরের লগ্নে বদলে যাওয়ার কথা
বলেও আমরা বদলে যেতে পারিনি আচরণে এবং বিশ্বাসে।
আমাদের ফিরিয়ে আনতে হবে
নিজেদের সংস্কৃতির ওপর বিশ্বাস। অবশ্যই এখন আমাদের ঘরকুনো থাকার সুযোগ
নেই। আমরা বিশ্বায়ন নামক গ্রামে বাস করছি। আমাদের গ্রামবাংলার দিকে যদি
তাকাই, সেখানে একেকটি বাড়ি স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে
আছে। সামষ্টিক সেই ঐতিহ্য ওই গ্রামের সংস্কৃতি। তেমনই বিশ্বায়ন নামক
গ্রামেও আমাদের নিজস্বতা নিয়ে উজ্জ্বল থাকতে হবে। ইংরেজি নববর্ষ আমরা
অবশ্যই পালন করবো, তবে সেটা যেন শতভাগ ভিনদেশি সংস্কৃতি নির্ভর হয়ে না যায়।
সচ্ছলতা
প্রয়োজন ব্যক্তি ও সমষ্টির। কিন্তু সেই সচ্ছলতা যদি অতীতকে অস্বীকার করে
এবং ফেলে আসা দিনের লড়াই ও সম্পর্ককে না চেনার ভান করে, তাহলে ওই সচ্ছলতায়
অহংকারের ছত্রাক বসে। দৃশ্যমান অহংবোধ মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তৈরি
করে। দূরত্ব নিয়ে ব্যক্তি বা সমষ্টি কোনও শুভ’তে গিয়ে পৌঁছাতে পারে না।
তাই লক্ষ্য হওয়া উচিত দূরত্ব কমিয়ে আনার। প্রথমে শুরু করতে হবে ব্যক্তির
সঙ্গে ব্যক্তির। তবেই ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব কমে আসবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি এই ইশতেহার ঘোষণার সক্ষমতায় পৌঁছাতে পেরেছি? দুঃখিত, নতুনের প্রথমেই এই প্রশ্ন সামনে আনায়।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী