ই-পেপার ভিডিও ছবি বিজ্ঞাপন কুমিল্লার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যোগাযোগ কুমিল্লার কাগজ পরিবার
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শতবর্ষ উপলক্ষে স্মারক
Published : Tuesday, 4 January, 2022 at 12:00 AM
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার শতবর্ষ উপলক্ষে স্মারকশান্তিরঞ্জন ভৌমিক ||

বিদ্রোহী কবিতার প্রতিকৃতি
‘বিদ্রোহী' কবিতায় এগারটি স্তবক ও মোট ১৩৮টি পংক্তি (নজরুল রচনাবলী ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ অনুযায়ী)। এই কবিতায় ‘বিদ্রোহ’ শব্দটি একবার মাত্র উল্লেখ আছে।
‘আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া’
(৬ষ্ঠ স্তবক)
‘বিদ্রোহী’ শব্দটি সাতবার উল্লেখ আছে,
১. আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর।    (২য় স্তবক)
২. মহা-বিদ্রোহী, রণ-ক্লান্ত।        (নবম স্তবক)
৩. বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত। (নবম স্তবক)।
৪. আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।        (১০ম স্তবক)
৫. আমি বিদ্রোহী ভৃগু ...
৬. আমি চির-বিদ্রোহী বীর        (একাদশ স্তবক)।

১৪৩ (একশত তেতাল্লিশ) বার ‘আমি’ সর্বনামটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় উল্লেখ আছে। অর্থাৎ কবিতাটি উত্তম পুরুষের জবানীতে বর্ণিত। সেজন্য অনেকেই কবির ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ের সাথে ভাববিন্যাসের দ্বন্দ্বের কথা বলতে চেয়েছেন। মূলত ‘আমি’ সর্বনামটি এই কবিতায় রাশি রাশি উপমা ও প্রতীকে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি ব্যক্তিত্বের, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের, আত্মবিশ্বাসের, আত্মপ্রত্যয়ের, আত্মশক্তির উদ্বোধন, জাগরণ ও প্রকাশ। এ কবিতায় কোন মহত্তর সত্তার কাছে আত্মসমর্পণে অনিচ্ছা ও অনীহা স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহের রূপকে বার বার প্রবলভাবে উচ্চারিত আর শেষে পৃথিবী থেকে উৎপীড়ন ও অত্যাচার দূরীকরণের সংকল্প ঘোষিত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুরুতে আত্মগত, কবির আত্ম-জাগরণের মধ্য দিয়ে যার উদ্বোধন শেষের দিকে তা বস্তুগত, যেখানে কবি এ পৃথিবীতে উৎপীড়ন ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অক্লান্ত সংগ্রামীর ভূমিকায় স্থিতিশীল। সবশেষে কবি শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির খামখেয়ালীর বিরুদ্ধে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে চির বিদ্রোহী বীরের এবং চির-উন্নত শিরের মহিমা অক্ষুন্ন রেখেছেন।
[কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন ও সৃষ্টি।
পূর্বোক্ত। পৃ:২৮৩]
‘বিদ্রোহী’ কবিতাতে ভাবোচ্ছ্বাসের আতিশয্য ঘটেছে। এজন্য শিল্পগত মর্যাদাকে ক্ষুন্নও করেছে। তবে ভাবোচ্ছ্বাসের অন্তরালে যে মুহূর্তে কবি নিজ সত্তার বিরাটত্বের কথা জানতে পেরেছেন, সে মুহূর্তে তিনি যে উল্লাসের তীব্রতা অনুভব করেছেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি সেই উল্লাসেরই অভিব্যক্তি।

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুলের অহমিকা বাহ্যত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে যখনই তিনি নিজেকে চিনতে পেরেছেন ও মানবাত্মার বিরাট স্বরূপ অনুভব করেছেন, সেই মুহূর্তেই কবিতাটি রচিত হয়েছে। এখানে ‘আমি’ বা অহমিকার প্রসঙ্গ বিবেচনা করা কবির প্রতি অবিচার।







বিদ্রোহী কবিতার স্তবক বিন্যাসে অর্থক্রম
‘বিদ্রোহী’ কবিতার স্তবক-বিন্যাসে অর্থগত ক্রম আলোচনা করা যেতে পারে।

বিদ্রোহী
কাজী নজরুল ইসলাম

[ শ্রীশরচ্চন্দ্র গুহ বি. এ. কর্তৃক আর্য পাবলিশিং হাউস্, কলেজ স্ট্রীট মার্কেট (দোতলা), কলিকাতা হতে প্রকাশিত এবং কান্তিক প্রেস, ২২ সুকিয়া স্ট্রীট, কলিকাতা হতে মুদ্রিত ‘অগ্নি-বীণ’র দ্বিতীয় সংস্করণ হতে উদ্ধৃত। প্রকাশকাল, আশ্বিন, ১৩৩০]

বল  বীর-
বল  উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল  বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি’,
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!
মম  ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল  বীর
আমি চির-উন্নত শির!
কবি তার আবির্ভাবের বিঘোষণা দান করেছেন। তিনি বীর, উন্নত তাঁর শির, এই শির কখনো নত হয় না, হিমাদ্রির মত ‘মহাবিশ্বের মহাকাল ফাড়ি’ ‘চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা ছাড়ি’ ‘ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদ করে খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদ করে বিশ্ব বিধাতার চির বিস্ময় হয়ে ললাটে ভগবানের রাজটীকা পরিধান করে তাঁর আবির্ভাব।
আমি     চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস,
আমি     মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর!
আমি  দুর্বার,
আমি     ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি     অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল,
আমি     দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম-কানুন শৃঙ্খল!
আমি     মানিনাকো কোন আইন,
আমি     ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম।
ভাসমান মাইন্,
আমি     ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর,
আমি     বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাত্রীর!
বল  বীর –
চির     উন্নত মম শির!
কবি ধ্বংসাত্মক ভূমিকার পূর্বাভাস দিয়েছেন। চির দুর্দম, দুবিনীত, নৃশংস ইত্যাদি প্রতীকের পাশাপাশি নটরাজ, সাইক্লোন, ধ্বংস, দুর্বার, উচ্ছল, টর্পেডো, মাইন, বিদ্রোহী ইত্যাদি পরিচয়ে নিজেকে উপস্থাপিত করেছেন।

আমি ঝঞা, আমি ঘূর্ণি
আমি     পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি     আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ!
আমি     হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল!
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি     তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি     শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি     মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর।
আমি     শাসন-ত্রাসন, সংহার, আমি উষ্ণ চির-অধীর।
বল  বীর -
আমি     চির-উন্নত শির।
কবি এখানে ঝঞ্ঝা ও ঘূর্ণি, তিনি নৃত্য-পাগল; তাই ‘পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’ এবং নিজের তালে নেচে যান; কারণ তিনি মুক্ত জীবনানন্দ।’
কবির উচ্ছ্বাস ও আবেগ এখানে অবারিত। তাই তিনি নিজেকে ‘হাম্বীর’ ‘ছায়ানট’ ‘হিন্দোল’ ‘চল-চঞ্চল’ এমনকি ‘উন্মাদ’ বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেননি। তাই তিনি ‘ঠমকি ছমকি’ ‘পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ‘ফিং দিয়া ‘তিন দোল্’ দিয়ে চলেন। মনে যা চায় তা-ই করেন, শত্রুর সাথে গলাগলি করেন, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা ধরেন, মহামারী সেজে ‘ধরিত্রীর’ ভয়ের কারণ হন এবং ‘শাসন-ত্রাসন, সংহার’ ও ‘উষ্ণ চির-অধীর’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ঘোষণা দেন ‘আমি চির-উন্নত শির।’

আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি     দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর-মদ।
আমি     হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি     যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি!
আমি     সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি     অবসান, নিশাবসান!
আমি     ইন্দ্রাণী-সূত হাতে-চাঁদ ভালে সূর্য,
মম     এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য।
আমি     কৃষ্ণ-কণ্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধির!
আমি     ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল  বীর -
চির     উন্নত মম শির!
এখানে সৃষ্টি ও ধ্বংস, লোকালয় ও শ্মশান ইত্যাদি পরস্পর বিরোধী শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে প্রতীকরূপে। কবি নিজেকে পরিচয় দিয়েছেন চির দুরন্ত দুর্মদ ‘হোম-শিখা’, ‘সাগ্নিক জমদগ্নি’, ‘যজ্ঞ’, ‘পুরোহিত’, ‘অগ্নি’ রূপে।
কবি নিজের পরিচয়ের একটি শাশ্বত স্বরূপ উপস্থাপিত করেছেন নিজেকে ‘ইন্দ্রাণী-সূত’ ‘কৃষ্ণ-কণ্ঠ’ ‘ব্যোমকেশ’ হিসেবে। তাই তাঁর যেমন ‘হাতে চাঁদ ভালে সূর্য’ শোভা পায় তেমনি ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’ও রয়েছে। অর্থাৎ আত্মশক্তিতে শক্তিমান কবি এই ভাবটি স্পষ্ট ও অবিসম্ভাবী হয়েছে এখানে।

আমি     সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি     যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক!
আমি     বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি     আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ!
আমি     বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি     ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি     পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি     চক্র মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচণ্ড!
আমি     ক্ষ্যাপা দুর্বাসা-বিশ্বামিত্র-শিষ্য
আমি     দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব!
আমি     প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি     মহা-প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি     কভু প্রশান্ত, - কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি     অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি     প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি     উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি     উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল্-দোল।
কবি গৈরিকধারী যুবরাজ বা সৈনিকের বেশধারী হয়েও বেদুঈন এবং ইতিহাস খ্যাত ধ্বংসের নায়ক চেঙ্গিস। ‘এই স্তবকে কবি সকল মন্ত্রের আদ্যাক্ষর ওঙ্কার ধ্বনি এবং ধ্বংসের বার্তা ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কারকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে, পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ডচক্র, মহাশঙ্খ প্রভৃতি পৌরাণিক অস্ত্র, বাদ্যযন্ত্র এবং ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র, তেজের আধার দুর্বাশা প্রভৃতি পৌরাণিক চরিত্রের উল্লেখে বিশ্বদাহনকারী, সৃষ্টি বৈরী মহাত্রাস, মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহুগ্রাস এবং বিধির দর্পহারী রূপে নিজের পরিচয়কে তুলে ধরেছেন।’ এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই কবি নিজেকে ‘প্রভঞ্জনের উচ্ছ্বাস’, ‘বারিধির মহাকল্লোল’, ‘উজ্জ্বল’ ‘প্রোজ্জ্বল’ ‘হিন্দোল-দোল্’ হিসাবে পুনরায় বিঘোষণা দিয়েছেন।

আমি     বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি     ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি     উন্মন-মন উদাসীর,
আমি     বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর!
আমি     বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের,
আমি     অবমানিতের মরম-বেদন, বিষজ্বালা, প্রিয়-লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের।
আমি     অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিতা     -চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি     গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে দেখা-অনুখন,
আমি     চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন চুড়ির কন্-কন্।
এই অংশটি গীতি কবিতার রসে পূর্ণ। এখানে মানুষের অন্তর থেকে, হৃদয়ের গভীর থেকে উপমা সংগ্রহ করেছেন কবি, উৎপ্রেক্ষা হলো প্রতীকী বিশেষত্বে সমৃদ্ধ। ‘বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি’, ‘ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম’, ‘উদাসীর উন্মন-মন, ‘বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস’, ‘হুতাশীর হা-হুতাশ’, ‘পথবাসী চির গৃহহারা পথিকের বঞ্চিত ব্যথা,’ ‘অবমানিতের মরম বেদন, প্রিয়-লাঞ্ছিতের বুকে বিষজ্বালা’ ইত্যাদি অত্যন্ত তাৎপর্য। এখানে আবেগের স্তরটিও উৎসারিত। - ‘গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি’, ‘ছল করে দেখা অনুখন’ অথবা ‘চপল মেয়ের ভালোবাসা’, ‘তার কাঁকন-চুড়ির কন্ কন’ - কবিকে রোমান্টিক করে তুলে।

আমি    চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি     যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি নিচোর!
আমি    উত্তরী-বায়ু, মলয়-অনিল, উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি    পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি    আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি,
আমি    মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি-
আমি    তুরীয়ানন্দ ছুটে চলি একি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!
আমি    সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।
আমি    উত্থান, আমি পতন অচেতন-চিতে চেতন,
আমি    বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন,
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া,
স্বর্গ-মর্ত্য করতলে,
ত্যজি র্বোরাক্ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি    বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্নি, কালানল,
আমি    পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি    তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া, দিয়া লম্ফ,
আমি    ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি’ ভূমিকম্প!
ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ -
ধরি    স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’!
কবি ‘অচেতন-চিতে চেতন’ ‘বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী’ ‘মানব-বিজয়-কেতন’ উড়িয়ে স্বর্গ-মর্ত্য করতল করে র্বোরাক্ (হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর স্বর্গ ভ্রমণের বিদ্যুৎগতি সম্পন্ন বাহন) এবং উচ্চৈঃশ্রবা (স্বর্গরাজ ইন্দ্রের বাহন)-কে বাহন করে ঝড়ের মতন করতালি দিয়ে ভূমিকম্প সঞ্চার করবেন, ত্রাস সৃষ্টি করবেন, বাসুকির ফণা জাপটিয়ে ধরবেন, জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটিয়ে ধরবেন; কারণ, তিনি ‘চিরশিশু’ ‘চির কিশোর’।

আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি    ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম ঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করে নিখিল বিশ্বে নিঝ্ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’!
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠে’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে    সপ্ত নরক, হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি শ্রাবণ-প্লাবন বন্যা,
কভু    ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা -
আমি    ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি    অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি    ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি    ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি    জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুস্পের হাসি!
কবি এখানে দেব-শিশু’, ‘চঞ্চল’, তাই ‘দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল’। তিনি ‘অর্ফিয়াসের বাঁশরী’ আবার ‘শ্যামের হাতের বাঁশরী’। সেজন্য ‘রুষে উঠে মহাকাশ ছাপিয়ে’ ছুটেন, ‘সপ্ত নরক’, ‘হাবিয়া দোজখ’ নিভে যায়। তিনি ‘শ্রাবণ-প্লাবণ বন্যা’। তাই ধরণী কখনো বরণীয়া, কখনও বিপুল ‘ধ্বংস-ধন্যা’। তিনি ‘অন্যায়’, ‘উল্কা’, ‘শনি’, ‘ধূমকেতু-জ্বালা’, ‘বিষধর কাল-ফণী’, ‘ছিন্নমত্তা চণ্ডী’, ‘রণদা সর্বনাশী, হয়েও জাহান্নামের আগুনে বসে পুষ্পের হাসি হাসেন।
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি    অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!

আমি    মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি    তাথিয়া তাথিয়া মথিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাতাল মর্ত্য
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি    চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি    উত্তাল, আমি তুঙ্গ, ভয়াল, মহাকাল,
আমি    বিবসন, আজ ধরাতল নভঃ ছেয়েছে আমারি জটাজাল!

আমি ধন্য আমি ধন্য !!
আমি    মুক্ত, আমি সত্য, আমি বীরবিদ্রোহী সৈন্য
আমি ধন্য আমি ধন্য!!
এখানে ধ্বনিত হয়েছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মূল সুর। কারণ কবি নিজেকে চিনেছেন,
‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া
গিয়াছে সব বাঁধ।’
‘জগদীশ্বর ঈশ্বর’ ও ‘পুরুষোত্তম সত্য’ হিসেবে নিজেকে জেনেছেন কবি। এখানে উল্লেখ্য যে, শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় অর্জুন যখন তাঁদের বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পূজনীয় ব্যক্তিদের দেখলেন, তখন তিনি যুদ্ধ না করার অভিপ্রায় শ্রীকৃষ্ণকে জানিয়ে হাতের ‘গাণ্ডীব’ পরিত্যাগ করলেন । শ্রীকৃষ্ণ এই যুদ্ধকে (কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে) ধর্মযুদ্ধ হিসেবে ব্যাখ্যা করে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম কি এবং যুদ্ধ করার হেতু কি ইত্যাদি উপদেশের ছলে বললেন,
বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্ ॥ [ ২/২১]
অর্থাৎ ‘হে পার্থ, যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ ও অব্যয় বলে জানেন, তিনি কিরূপে কাকেই বা হত্যা করেন এবং কাকেই বা হত্যা করান?
তিনি আরও বললেন,
অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়ম ক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থাণুর চলোহয়ং সনাতনঃ ॥ [ ২/২৪]
অর্থাৎ এই অপরোক্ষ আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল এবং সনাতন।
এই সূত্র ধরেই নজরুল বলেন,
আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয় আমি অব্যয়।
আত্মার শাশ্বত রূপকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
আমি    পরশুরামের কঠোর কুঠার,
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি    হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি    উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব-সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না,
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!
কবি এখানে ‘পরশুরামের কঠোর কুঠার’, তা দিয়ে বিশ্বকে নিঃক্ষত্রিয় (অপশক্তিকে ধ্বংস) করবেন, তার স্থলে ‘শান্তি শান্ত উদার’ আনবেন। কৃষ্ণের সহোদর ও সহায়ক বলরামের অস্ত্র ‘হল’ হয়ে সৃষ্টির মহানন্দে ‘অধীন বিশ্ব’কে উপড়ে ফেলার ইচ্ছা প্রকাশের পরে সবশেষে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবির জীবন-দর্শন ঘোষিত হয়েছে। তিনি ‘মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত’ হলে ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’, ‘অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’- ততদিন পর্যন্ত শান্ত হবেন না। এখানে বিদ্রোহের একটি চিরকালীন স্থায়ীত্বের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’ সত্তার আদর্শিক অবস্থানের কথা বলা হয়েছে।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হারা খেয়ালী
বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।
আমি    বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন।
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর -
আমি    বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত-শির!
কবিতার শেষাংশে কবি নিজেকে ‘বিদ্রোহী ভৃগু’ হিসেবে আত্মপরিচয় দিয়ে ভগবানের বুকে পদ-চিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছেন। যেহেতু তিনি মহাবিশ্বের মহাসৃষ্টির অংশ বিশেষ; সেজন্য তিনি ‘স্রষ্টা-সূদন’, ‘চির বিদ্রোহী বীর’ এবং ঘোষণা দিয়েছেন,
‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত-শির।’
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আরম্ভ হয়েছে, ‘বল  বীর, বল  উন্নত  মম  শির’ এই ঘোষণায়। আর শেষ হয়েছে ‘চির বিদ্রোহী বীর’ হিসেবে এবং ‘এক চির-উন্নত শির’ ঘোষণায়। একটি পরিপূর্ণ আত্মবলয়ের উত্তরণ ঘটেছে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প এবং ঐতিহ্যের বর্ণনার স্রোতে। চিরবিদ্রোহী বীরের সমুন্নত মস্তক বিশ্ব অতিক্রম করে আজ উত্থিত।
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি পুরাতন রীতি-নীতি ও ব্যবস্থাদির পরিবর্তে নতুন জীবন ও জগৎ গঠনের স্বপ্ন-ভাবনা প্রকাশ করেছেন। যখন বলেন,
১.    ‘আমি দুর্বার
আমি ভেঙে করি সব চুরমার।’
২.    ‘আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি।’
    নিজেকে উপলব্ধি করার পর জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত কবি চিত্তের উল্লাসের প্রতিফলনই এখানে ঘটেছে।

   ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পরোক্ষভাবে তদানীন্তনকালের বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে নজরুলের রোষাগ্নির প্রতিফলন ঘটেছে, বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের যুগের ভারতবাসীর ধূমায়িত অসন্তোষ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে,
‘আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল।
আমি মানিনা কো কোন আইন,
আমি ভরা তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো আমি
ভীম-ভাসমান মাইন।’
এখানে আধ্যাত্মিক জ্ঞানপথে বলীয়ান মানবাত্মার অসীম শক্তির কথা ঘোষিত হয়েছে। কবিতাটিতে মূলত বিশ্বনিয়ন্তার বিরুদ্ধে নয় বরং বিধাতার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে যারা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত করে তাদের বিরুদ্ধেই কবি তীব্র বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার সর্বাংশে উৎপীড়িত মানুষের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে কবির লেখনী ধারণ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল,
‘আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন শ্বাস হা হুতাশ
আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির-গৃহহারা যত পথিকের।
আমি অবমানিতের মরম বেদন ...’
কবির উপলব্ধিতে প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে।