শাহীন শাহ ||
মানুষের যাবতীয় সৃষ্ট কর্মের মধ্যে দেশ বা রাষ্ট্রই হলো সার্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব দৃশ্যমান ছাড়া অন্যসব মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষের কথা চিন্তা করা অত্যন্ত দুরুহ ও জটিল। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিষ্টোটলের মতে,‘‘মানুষ স্বভাবগতভাবে সামাজিকজীব”। এখানে গ্রীক পণ্ডিত সমাজকে রাষ্ট্্র অর্থে প্রয়োগ করেছেন। ফলে প্রতিটি মানুষের আচরণই সমাজবদ্ধ আচরণ। তার যতসব কল্পনা,বাসনা, কামনা একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। জীবনকে নানানভাবে রাঙিয়ে স্বার্থকতার ষোলোকলা পূরণই তার চাওয়া- পাওয়া। না পাওয়ার বেদনা- গল্প ও তাদের আছে। আছে শত দুঃখ কষ্টকে মেনে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা। নিভৃত্বে রজনীর বাঁকে বাঁকে মানবের শিরা- উপশিরায় যত ভয়,যত অস্থিরতা তা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতরেই। দার্শনিক হেগেল মন্তব্য করেছেন, ‘‘জনসমাজ যখন রাষ্ট্রীয় সমাজে রুপান্তরীত হয়, তখনই সে সাবালকত্ব অর্জন করে এবং বিশ্বসমাজের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। যাদের দেশ নেই তাদেরকে আমরা কোন কাতারে রাখবনা তারা কাতারহীন মানুষ নয়,তাদের পরিচয় অভিশাপে ঠাসা। তাদের সমস্ত কিছুই অনিশ্চিত। তাদের নেই আকাশ, নেই তাদের মাটি। তারা কোনো ভেষজ উদ্ভিদ নয়, তাদের জন্মউদ্ভিদের মতো মাটি ভেদ করে হয়নি। তাদের জন্ম অপরাপর মানুষের মতোই। তাদের চোখের জল, মায়া- মমতা অন্যসব মানুষের মতোই। তাদের নেই কেবল একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড। যে ভূ-খণ্ডের মাটি,পানি, বায়ূ,শিক্ষা, অন্ন -বস্ত্র-বাসস্থান তাদের করে হয়না। তারা দেশহীন উদবাস্তু ও শরণার্থী শিবিরের হৃদয়হীন নাগরিক। প্রকৃতপক্ষে জন্মসূত্রে পৃথিবীর কোনো নাগরিকই দেশহীন নয়। শোষণকারী- নিপীড়ণকারী দানবদের রোষাণলে পতিত হয়ে কিংবাদুর্ভাগ্য পীড়িত হয়ে,দুর্বল থেকে অতি দুর্বল মানুষেরা দেশহীন হয়। এদের সম্ভ্রমের কোনোমূল্য নেই। এদেরপ্রিয় মানচিত্রের স্বপ্নদেখা যেন নিষেধ। এদেরপ্রিয়জন সর্বদা পরিত্যাজ্য। এদের পরিচয় এরা অধিকারহীন মানুষ। হায়েনাদের থাবায় এদের বসত -ভিটে রক্তে রঞ্জিত হয়। মৃত মায়ের শুকনো স্তন চোষে-বুকের শিশু। মৃত্যু এদের আলিঙ্গন করে, জাতিসংঘ করেনা। দিনকে দিন দেশহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। দেশহীন মানুষের ধর্মচিন্তা, সংস্কৃতিচিন্তা, ইতিহাসচিন্তা, বিজ্ঞানচিন্তা এবং সাহিত্যচিন্তা থাকে না। যাদের দেশ নেই তারা সবদিক দিয়েই বঞ্চিত। বর্তমান বিশ্বসভ্যতায় কোনো কোনো দেশ যখন সভ্যতার শীর্ষে আনন্দ উপভোগে দোলখায় পক্ষান্তরে দেশহীন মানুষের নির্মম যাপিত জীবন এবং পৃথিবীর সমস্ত আধুনিককর্মকাণ্ডেরও সভ্যতার পথটুকুকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়। ঠিকানাবিহীন মানুষের আর্ত-বেদনায় থমকে যায় মানবিকদিকগুলো। ইতিহাসের চোরাগোপ্তা স্রোতে কবলিত দেশহীন মানুষেরা। পৃথিবীতে দেশের সংখ্যা ২০০ এর সামান্য কিছু বেশি। যাদের দেশ নেই এদের সংখ্যা দেড় কোটি। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ৭০০ কোটির বেশি । এদের তুলনায় দেশহীন মানুষের সংখ্যা খুববেশি নয়। এদের যাপিত জীবন কাটে বিভিন্ন দেশের আশ্রয় শিবিরে। কোনো মানচিত্রে এদের ঠাঁই হয় না। রাষ্ট্রের কোনো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা এদের ভাগ্যে জুটে না। সম্প্রীতির পরিবেশ,শিক্ষার অধিকার এবং কর্মের সুযোগ এদের ভাগ্যে জুটেনা। এদের মৃত লাশ ঠাঁই হয় অন্য দেশের গণকবরে। যে সব দেশ এইসব শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে আশ্রয় শিবির খুলেছে,বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠি প্রায় দশ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আইভরিকোস্টে আছে ছয় লাখ বিরানব্বই হাজার শরণার্থী। থাইল্যান্ডে আছে প্রায় পাঁচ লাখ। লাটভিয়ায় আশ্রয় শিবিরে আছে দুই লাখ ২৫ হাজার শরণার্থী। তাছাড়া সিরিয়া, কুয়েত ছাড়াও মধ্যও পূর্ব ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে এই দেড় কোটি শরণার্থী মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সম্প্রতি নতুন করে নাগরিকত্ব হারাতে যাচ্ছে ভারতের আসাম রাজ্যের প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ। একক দেশ হিসেবে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় দেশহীন মানুষদেরকে জায়গা করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এমনিতেই বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ হয়ে আছে। অদূর ভবিষ্যতে এই বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির অতিরিক্ত চাপ সামলানোর দায়ভার বাংলাদেশকে বেশ ঝুঁকিতে ফেলবে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। মানুষ জন্ম নেয় রাষ্ট্রে, সে বেড়েও উঠে রাষ্ট্রে। আবার মৃত্যুবরণও করে কোনো এক রাষ্ট্রের অধীনে। রাষ্ট্র একজন মানুষের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারসহ নিজস্ব পরিচয়ের একটি জায়গা করে দেয়। কিন্তু কেমন হবে যদি কোনোদিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান আপনার কোনো রাষ্ট্র নেই। শুনতে অনেকটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি যে, পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যাদের কোনো দেশ নেই। যারা কোনো দেশের পরিচয় বহন করেনা। বাস্তবে পৃথিবীর কোনো দেশই তাদেরকে নিজের দেশের নাগরিক মনে করে না এবং মেনে নেয় না। এই যে ফেরারী জীবন কতটা দুঃসহ ও অমানবিক তা ব্যাখ্যা করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। যুগে যুগে কবির কলমে গুনগুনিয়ে বেরিয়ে এসেছে মায়াবী মধুর লেখা- মা, মাটি, মাতৃভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী। যাদের দেশ নেই, এই একটি মাত্র শব্দই জীবনকে শূন্য করে দেয়, করে দেয় নির্বাক, করে দেয় শিকলবন্দী পরাধীন। জীবনের সমস্ত কিছু অর্জন নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে যায়। আঘাত আসে তাদের ভাবনার জায়গাটায়। তাদের চলা- বলা, স্বাধীনতা, তাদের শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও তাদের কর্মের নিশ্চয়তা থেমে যায় চিরকালের জন্য। রাষ্ট্র যদি জঘন্যতম স্বৈরশাসক দ্বারা পরিচালিত থাকে তবুও ঐ রাষ্ট্রটিকে দেশহীন মানুষেরা বেছে নিবে যাপিত জীবনের জন্য। বুক সমান দুঃখকে নিয়েও বাঁচতে চাইবে। সবশেষে তারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করবে। বলতে দ্বিধা নেই, নেই কোন সংকোচবোধ, একদিন আমরাও ছিলাম দেশহীন বাঙালি। সেই দিনটি বেশি দূরের নয়, মাত্রই পঞ্চাশ বছর আগের কথা। দেশহীনতায় কী যে যন্ত্রণা, কী যে দুর্ভোগ এসব প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা আছে দারুণভাবে। ১৯৭১ সালের ২৫মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস এর পূর্বে ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার পরে পূর্বপাকিস্তান মানে আজকের বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ পাকিস্তানের শাসকবর্গের পক্ষপাততুষ্ট আচরণের নির্মম শিকার এদেশের প্রতিটি মানুষ। বৈরী আচরণের শিকার আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও কর্মের জায়গাটা। ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা যুদ্ধে দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী লড়াই- সংগ্রাম করে আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা পেয়েছি, পেয়েছি গর্বে বুকভরা একটি মানচিত্র। আমাদের সুফলা মাটি আমাদের হয়েছে। বিনিময়ে এক সাগর রক্তে ভেসেছিল আমাদের নদী। বাংলার মাটির নিচে সমাধী হয়েছে লক্ষ শহীদের। যুদ্ধচলাকালীন প্রায় দুইকোটি স্বাধীনতাকামী মানুষ পাশের দেশ ভারতে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দেশহীন এই দুই কোটি মানুষের ভেতরেও রাষ্ট্রের গুরুত্ব ও দেশপ্রেম দারুণভাবে উপলব্ধিতে এসেছিল। কোনো জনসমিষ্টি যখন তার দেশ হারায়, তখন সে প্রথমে হারায় তার নাগরিক অধিকার, হারায় তার সংস্কৃতি, সভ্যতা, হারায় প্রিয়জনের নিখাঁদ ভালোবাসা। সবশেষে হারায় তিলে তিলে গড়া অর্জিত সম্পদ। মানবিক মর্যাদা ও মূল্যবোধ চলে যায় নির্বাসনে। দেশহীন মানুষের জীবন ও কর্মের নানাদিক বিশ্লেষণ করলে একটা সত্য বেরিয়ে আসে যে, তারা এমনি এমনি দেশহীন হয়নি। এর পেছনে যথেষ্ট পরিমানে কারণ থাকে বটে। দেশহীনতার ক্ষেত্রেকোনো কারণই গ্রহণযোগ্য নয়। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব সেখানে নিরীহ মানুষের মাথা আর খুলির জঘন্য উৎসবে মেতে উঠেছে মিয়ানমারের জ্যান্তা সরকার।
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, লুট যেকায়দায় সংগঠিত হয়েছে তা বর্ণনাতীত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীদ্বারা যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তা ইতিহাসের নির্মম ঘটনাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম পীড়াদায়ক ঘটনা। মূলত রাখাইন প্রদেশটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। এর আয়তন ৩৬হাজার ৭৭৮ বর্গ কি.মি.। এই প্রদেশটিতে শুমারী মোতাবেক রোহিঙ্গার সংখ্যা ৮ লাখ। মিয়ানমারের সামরিক সরকার এদের চলাফেরা, বিয়ে, ভ্রমণ এমন কি চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেই ক্ষান্ত থাকেননি। বন্ধ করে দিয়েছে ভোটাধিকার ও পরিচয়পত্র। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলছিল। এমত অবস্থায় সমগ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে পুশব্যাক করেছেন এই আট লাখ রোহিঙ্গাবাসীকে। রোহিঙ্গারা জাতীসংঘের ভাষায় এক রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী। একজন নাগরিক যখন দেশহীন হয়ে যায় তখন তার জীবনবোধ বলতে আর কিছুই থাকেনা। দুর্বোধ্য জীবন কেউ আশা করেনা। এছাড়া আরো অনেক সম্প্রদায় তাদের প্রিয় ভূখণ্ড থেকে চিরতরে সরে যেতে বাধ্য হয়েছে, তাদের মধ্যে বিশেষ করে নুবিয়ান সম্প্রদায়। নুবিয়ানরা মূলত সুদানের নাগরিক ছিলেন। বৃটিশদের ষড়যন্ত্রে কাবু হয়ে বর্তমানে নামিবিয়া ও কেনিয়ায় দেশহীন হয়ে বসবাস করছে। তাদের নেই কোনো পতাকা, নেই নাগরিকত্বও। ইউরোপীয়ান শরণার্থী সংখ্যায় প্রায় ছয় লাখ। এদের না আছে দেশ, না আছে কোনো পরিচয়পত্র। এরা এস্তোনিয়া ও লাটভিয়াতে বসবাস করে নাগরিকত্বহীন জীবন নিয়ে। সবশেষে দলিত সম্প্রদায়ের এক বিরাট সংখ্যা যা দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ নেপালে বাস করে নাগরিকত্ব ছাড়া। এতদসত্ত্বেও সময় এসেছে বিশ্বকে মানবিক বিশ্ব হিসেবে গড়ে তোলার। অসম্প্রদায়িক চেতনাবোধ তৈরি করা এবং সঞ্চালন করা মানব থেকে মানবের হৃদয়ে। মূল্যদিতে হবে প্রতিটি নাগরিককে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে। আর যেন কাঁটাতারের বেড়ায় পিষ্ট হয় না কেনো মানুষের লাশ। কাঁটাতারের বেড়ায় ক্ষত হয় না কোনো মানবের হৃদয়। স্বপ্ন দেখি আগামীর পৃথিবীটা হবে সকলের। ছোটদের, বড়দের, সকলের। দেশহীন মানুষের সংখ্যা নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। শক্তির মহড়া চাইনা, চাই ভালোবাসার বাসযোগ্য পৃথিবী। সাম্য, শান্তি, প্রগতি মূল্যবোধে দ্বীপ্ত হবে আমাদের আগামীর ভাবনা। প্রতিটি মানুষই হবে মানবিক, যেন ফুলের বাগানের সুগন্ধি হাওয়া। বুকসমান দুঃখকে ঢেকে দিবে বুকসমান ভালোবাসার সবুজ চাদর। দেশহীন মানুষের কথা ও আবেগ ধারণ করার সহমর্মিতায় জেগে উঠবে ধূলিধূসর পৃথিবী।
শাহীন শাহ
অধ্যাপক কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক